রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দীর্ঘদিনের সহযোগী সের্গেই শোইগু। তাকে পুতিন নিজের হাতে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের নেতৃত্বও ছিল তার হাতে।
কিন্তু সেই সহযোগী শোইগুকেই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিলেন পুতিন। তার জায়গায় অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেই বেলোসভ নিয়োগ পেতে চলেছেন। তিনি আগে ছিলেন পুতিনের উপ প্রধানমন্ত্রী।
রুশ প্রেসিডেন্ট দপ্তর ক্রেমলিনের এক মুখপাত্র পেসকভ রবিবার সাংবাদিকদের জানান, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্প্রতি আর্থিকভাবে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সেসব মোকাবেলায় আন্দ্রেই বেলোসভই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।
পেশায় অর্থনীতিবিদ বেলোসভ দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছেন। তবে সামরিক বিষয়ে তার কোনও অভিজ্ঞতার কথা জানা নেই। শুধু বেসামরিক বিষয়েই তিনি কাজ করেছেন। বোলোসভ ২০১২ ও ২০১৩ সালের মধ্যে রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। আর রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ পাওয়ার আগে ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। গত ৭ মে পর্যন্ত তিনি উপ প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধানের মতো একটি পদে এমন কাউকে নিয়োগ দেওয়াটা বেশ বিরল ঘটনা। অন্তত রাশিয়ার বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে পেসকভ বলেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে এখন তাদেরই প্রভাব বেশি যারা নতুন নতুন উদ্ভাবনের জন্য আগ্রহী এবং দ্রুততম উপায়ে সেগুলো কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত থাকে।”
ক্রেমলিনের মুখপাত্র আরও বলেন, “রাশিয়ার সামরিক বাজেট দ্রুত গতিতে বাড়ছে, তাই “জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে সামরিক অর্থনীতির সমন্বয় করাও জরুরি হয়ে পড়েছে।”
পেসকভ জানান, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সামরিক বাজেট জাতীয় জিডিপির ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। এটি রাশিয়ার অর্থনীতিতিতে কোনও সংকট তৈরি না করলেও পরিস্থিতি সোভিয়েত যুগের শেষ দিকের মতো হতে শুরু করেছে। সেসময় সোভিয়েত রাশিয়ার সামরিক ব্যয় জিডিপির ৭ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছেছিল।
পেসকভ বলেন, “বেলোসভ কেবল একজন ‘বেসামরিক ব্যক্তি’ নন। তিনি ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে যথেষ্ট সফল’ ছিলেন। তারপরে দীর্ঘ সময় ধরে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক সহাযোগী ও উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
“প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সবচেয়ে উন্নত ধারণার প্রবর্তন ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে উন্মুক্ত হতে হবে।”
এর আগে রাশিয়ান ফেডারেশন কাউন্সিল জানায়, পুতিন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগুর জায়গায় বেলোসভকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। কাউন্সিলের সিনেটররা ১৩ ও ১৪ মে প্রেসিডেন্টের মনোনীত প্রার্থীর বিষয়ে বিবেচনা করে তাদের অনুমোদন দেবেন।
এর আগে রবিবার (১২ মে) প্রেসিডেন্টের ডিক্রির মাধ্যমে শোইগুকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। তিনি নিকোলাই পত্রুশেভের কাছ থেকে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব নেবেন। তবে পত্রুশেভের নতুন পদ কী হবে, তা এখনো জানা যায়নি।
পেসকভ বলেন, “সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবার প্রতিরক্ষা শিল্প কমিটির উপপ্রধান হিসেবে কাজ করবেন। শোইগু যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পে যুক্ত থাকায় এক্ষেত্রে তার ভালো জ্ঞান আছে। তিনি প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রতিটি নির্দিষ্ট উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন হার সম্পর্কেও সচেতন।”
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হয়ে শোইগু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পুতিনের সঙ্গেও শোইগুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সাইবেরিয়ায় মাছ শিকারে যাওয়ার সময়ও পুতিন প্রায়ই শোইগুকে সঙ্গে নিয়ে যান। এমনকি সামরিক বাহিনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও শোইগুকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
শোইগু পেশায় মূলত একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৯০-র দশকে রাশিয়ার দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি পরিচিতি পান। ২০১২ সালে তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেন পুতিন। তার দুই বছর পরই রাশিয়া ক্রিমিয়া আক্রমণ করে।
ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ২০২৩ সালে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী কোম্পানি ভগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের সঙ্গে শোইগু বিরোধে জড়িয়েছিলেন। প্রিগোশিন বারবার শোইগুর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং ইউক্রেন যুদ্ধে ভগনারকে কম অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ করেন।
এই বিরোধের জেরে প্রিগোশিন রাশিয়ার সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করে বসেছিলেন। তার ভাড়াটে যোদ্ধাদের নিয়ে রাজধানী মস্কো অবরোধের চেষ্টা করেন। তবে পুতিনের আশ্বাসে প্রিগোশিন সেই বিদ্রোহ থেকে সরে আসেন। কিন্তু এরপর ২০২৩ সালের আগস্টে সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে মস্কো যাওয়ার সময় এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন প্রিগোশিন।
আর এবার শোইগুকেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে নিলেন পুতিন। শোইগুর একজন সহকারি তৈমুর ইভানভকে গত মাসে ঘুষের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই গ্রেপ্তারকে শোইগুকে বরখাস্তের সম্ভাব্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখানো হয়েছিল।
গত ৭ মে পুতিন পঞ্চমবারের মতো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। তার আগে গত মার্চের নির্বাচনে ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পান তিনি।
তথ্যসূত্র: আরটি