Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

ভারত মিয়ানমার বাংলাদেশে কোন লড়াইয়ে কুকি-চিন

Kuki_Chin
Picture of মাহবুবুল আলম তারেক

মাহবুবুল আলম তারেক

ভারতের সেভেন সিস্টার্সের রাজ্য মণিপুরে চলমান জাতিগত সংঘাত ফের আলোচনায় এনেছে কুকি-চিনদের। সেখানে কুকি-চিনদের সঙ্গে সংঘাত বেঁধেছে মেইতেই জনগোষ্ঠীর। তাতে গত কয়েকদিনে ৬ জন মারাও গেছে। মণিপুরে মেইতেইদের সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরেই থেকে থেকে সংঘাত হচ্ছে কুকি-চিন ও নাগাদের।

শুধু মণিপুরেই নয়, ভারত লাগোয়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারেও রয়েছে কুচি ও চিন নৃগোষ্ঠীর বাস। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চাইছে তারা।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকি-চিনরা একটি সশস্ত্র সংগঠনও গড়ে তুলেছে। নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ), তবে তা বম পার্টি নামেই বেশি পরিচিত।

কেএনএফের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় হত্যা, লুটপাট, মুক্তিপণ দাবিসহ একাধিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ রয়েছে।

২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কেএনএফ রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলার নয়টি উপজেলা নিয়ে বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং জনগণের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাসনার কথাও জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেএনএফ ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমারের চিন রাজ্যে সক্রিয় থাকার ফলে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। তাই এই হুমকি মোকাবেলায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ধারণা করা হয়, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য থেকে অস্ত্র পায় এবং কারেন বিদ্রোহীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। এর সশস্ত্র শাখার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।

মিয়ানমারের চিন রাজ্যে চিনদের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নাম চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ)। সেখানেও তারা স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়ছে।

মণিপুরের কুকি বিদ্রোহীদের সংগঠনের নাম কেএনও বা কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন।

মিজোরামেও কুকি-চিনরা সশস্ত্র লড়াই করেছিল। সেখানে তারা পরিচিত এমএনএফ বা মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে। তবে মিজোরামের কুকি বিদ্রোহীরা এখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে চলে এসেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারতের মণিপুর ও মিয়ানমারের চিন প্রদেশের কুকিরা সশস্ত্র লড়াই অব্যাহত রেখেছে।

এক বছর আগে মণিপুরে মেইতেই-কুকি সংঘাত শুরু হয়। তার বছর দুই আগে মিয়ানমারের চিন প্রদেশে বামারদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়। তার পরপরই বান্দরবানে কুকিরা নজরে আসে কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরে।

মিজোরামের কুকিরাও মণিপুর, চিন, বান্দরবানের কুকিদের সঙ্গে সংহতি দেখিয়ে মিছিল-সমাবেশ করেছে।

ফলে গত এক বছরে কুকি-দুনিয়া বিশেষ মনোযোগ পায় অকুকিদের কাছে। সেই সূত্রেই এই জাতিসত্তাটি নিয়ে অনেকের আগ্রহও তৈরি হয়েছে।

যুগের পর যুগ আশপাশের সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক দাপট তথা হিন্দিভাষী, বাংলাভাষী এবং বার্মিজ সংখ্যাগরিষ্ঠদের ত্রিমুখী চাপে কুকিরা অনেকটাই বিপন্ন। তাই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা করতে তারা হাতে তুলে নেয় অস্ত্র।

নাগাল্যান্ড, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরাতেও ছড়ানো ছিটানোভাবে কুকিদের বসবাস রয়েছে। অরুণাচল প্রদেশ ছাড়া সেভেন সিস্টার্সের তথা উত্তর-পুর্ব ভারতের সবগুলো প্রদেশেই তাদের উপস্থিতি রয়েছে।

কুকি-চিনদের কুকি নামটি পনের শতকে বাঙালিদের দেওয়া। আর বার্মিজরা তাদের নাম দেয় চিন। তবে কুকি-চিনরা নিজেদের মূলত জো নামে ডাকে। মিজো, বম, খিয়াং, লুসাইরাও জো জাতিভুক্ত।

কুকি নারী-পুরুষ।

কুকি-চিনদের আদি ইতিহাস

কুকি-চিনরা মূলত মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। নৃবিজ্ঞানী সি এ সোপিটের মতে, ১১ শতকের আগে থেকেই তারা যাযাবর জীবন ত্যাগ করে মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর পশ্চিম অঞ্চলে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল।

নৃবিজ্ঞানী সোপিট সেসময়কার কুকি জনগোষ্ঠীকে দুটি বড় শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। একটি শ্রেণীতে ছিল হরাংখোলরা। তাদের সহ-জাতিগোষ্ঠী ছিল বিয়াটরা। আর অন্য শ্রেণীতে ছিল চাংসানরা, যাদের সহ-জাতিগোষ্ঠী থাডৌরা। তাদের সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ ছিল আরও অসংখ্য জাতি।

সোপিট বলেন, ১৬ শতকের মধ্যে হরাংখোল ও বিয়াটরা লুসাই পাহাড় অঞ্চলে (বর্তমানে মিজোরাম এবং চিন রাজ্যের মধ্যে বিভক্ত) বসবাস করত। তার বিশ্বাস, পরবর্তীকালে চাংসান ও থাডৌরা তাদের কিছু অংশকে উত্তর কাছাড় পাহাড়, মনিপুর এবং ত্রিপুরার দিকে ঠেলে দেয়।

১৯ শতকে চ্যাংসান-থাডৌ জোট আবার নতুন উপজাতিদের হাতে ইরাবতী নদীর উপত্যকা থেকে বিতাড়িত হয়। তারাও পরে হরাংখোল ও বিয়াটদের মতো উত্তর-পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজরা এই দুই শ্রেণিকে পুরোনো ও নতুন কুকি বলে ডাকত।

১৮৮১ সালের আদমশুমারি অনুসারে উত্তর কাছার পাহাড়ে (বর্তমান দিমা হাসাও জেলা) কুকিদের সংখ্যা ২০ হাজার, নাগা পাহাড়ে (বর্তমান নাগাল্যান্ড) ১৫ হাজার, মণিপুরে ৩০-৪০ হাজার এবং ত্রিপুরায় ৬ হাজার ছিল। এ ছাড়াও কাছাড়ের সমভূমিতে ৬ হাজার কুকি ছিল।

মণিপুর গেজেটিয়ার (১৮৮৬) একই আদমশুমারির উপর ভিত্তি করে উল্লেখ করে, মণিপুরে পুরনো কুকিরা সংখ্যায় প্রায় ৮ হাজার আর নতুন কুকিরা ১৭ হাজার। পরবর্তীতে চুরাচাঁদপুর এবং চান্দেল জেলার কুকি অধ্যুষিত দক্ষিণ অংশগুলো মণিপুরের অধীনে এলে সেখানে কুকিদের জনসংখ্যা ৪০ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়।

মণিপুরের কুকি-চিনরা।

বর্তমানে তিনটি রাষ্ট্রের সীমানায় বহু রাজ্যে কুকিরা থাকলেও প্রান্তিক পর্যায়ে থাকায় তাদের সঠিক সংখ্যা বলতে পারে না কেউ।

অনুমান করা হয়, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি কুকি-চিন আছে মিজোরামে। ১০ লাখ অধিবাসীর রাজ্যটিতে জো (কুকি-চিন) জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা অন্তত ৮ লাখ।

মণিপুরের ৩৬ লাখ মানুষের ১৫-২০ শতাংশ কুকি। এক সময় মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের জনসংখ্যারও ৬-৭ শতাংশ ছিল কুকিরা। এখন সেখানে কুকি নেই বললেই চলে।

মিয়ানমারের চিন প্রদেশে চিন বা কুকি আছে চার-পাঁচ লাখ। সেখানে তারাই সংখ্যায় বেশি। তবে প্রায় ৫০টি গোত্রে বিভক্ত। নাগাল্যান্ডে আছে প্রায় ৩০ হাজার কুকি, আর বান্দরবানে ১৫ হাজারের মতো।

সব মিলিয়ে অনুমান করা হয়, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মিলে কুকি-চিন বা জো জাতির মানুষ আছে আনুমানিক ২০ লাখ।

২০ শতকের গোড়ার দিকে ওয়েলশ ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের হাতে খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত হওয়ার আগে, চিন, কুকি এবং মিজো জনগণ অ্যানিমিস্ট বা প্রকৃতি পুজারি ছিল।

১৯১৭-১৯১৯ সালের অ্যাংলো-কুকি যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয়ের পর কুকিদের ব্যাপকভাবে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া শুরু হয়। কুকিদের অধিকাংশই এখন খ্রিস্টান, তার মধ্যে বেশিরভাগই প্রোটেস্ট্যান্ট।

২০ শতকের শেষদিকে মণিপুর-মিজোরামের কিছু কুকি ইহুদি ধর্ম পালন শুরু করে। তারা নিজেদের ‘বেনে মেনাশে’ নামে ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া একটি গোত্র বলে মনে করে। কিন্তু আদতে তাদের পুর্ব-পুরুষরা ১৭ ও ১৮ শতকে বার্মা থেকে ভারতে এসেছিল।

ইহুদি হওয়া কুকি-চিনদের সংখ্যা প্রায় ৯ হাজার, যাদের কয়েক হাজার আবার ইসরায়েলে চলে যায়। মণিপুরে আছে প্রায় ৫ হাজার, যাদের অনেকে অবশ্য মেইতেইদের তাড়া খেয়ে এখন মিজোরামে শরণার্থী।

ত্রিপুরায় বাঙালি মুসলিমদের সংস্পর্শে এসে কিছু কুকি ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করে। গড়ে উঠে কুকি মুসলিম সম্প্রদায়। তারা মূলত সেই কুকি পুরুষদের বংশধর, যারা বাঙালি মুসলমান নারীদের বিয়ে করেছিল।

এদের বেশিরভাগই উদয়পুরের ত্রিপুরী শহরের উত্তর চন্দ্রপুর গ্রাম এলকায় বসবাস করে। তবে কুকি মুসলিম সম্প্রদায়কে অন্যান্য কুকিরা অবজ্ঞা করে থাকে।

কুকি-চিনরা অস্ত্র ধরল কেন

বার্মিজ, হিন্দিভাষী এবং বাংলাভাষী সংখ্যগরিষ্ঠদের ত্রিমুখী চাপে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারানোর ঝুঁকি থেকেই কুকি-চিনরা স্বায়ত্তশাসনের লড়াই শুরু করে।

মিয়ানমারে স্বাধীনতার পর থেকেই বামারদের (বার্মিজ) একচেটিয়া আধিপত্যে অতিষ্ঠ হয়ে দেশটির একের পর এক জাতিগোষ্ঠী বিদ্রোহ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে দেশটির চিন প্রদেশের কুকিরাও স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই শুরু করে। সে বছরই গঠিত হয় চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ)।

একই বছরে ভারতের মিজোরাম ও মণিপুরের কুকিরাও স্বায়ত্তশাসনের লড়াই শুরু করে। ১৯৮৮ সালেই গঠিত হয় মিজোরামের এমএনএফ ও মণিপুরের কেএনও। এর মধ্যে মিজোরামের কুকিরা সশস্ত্র বিদ্রোহ ত্যাগ করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে চলে এসেছে।

মিজোরামের কুকি-চিনদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

২০২১ সালে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থীরা লড়াই শুরু করলে চিন প্রদেশের কুকিদের স্বায়ত্তশাসনের লড়াই নতুন করে গতি পায়। গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে কুকি-চিনদের বড় একটি অংশ দেশটির জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। চিন প্রদেশের অনেকখানি মুক্তও করে েফলেছে তারা।

চিন রাজ্যের ভারত সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলো সব এখন সশস্ত্র কুকি-চিনদের নিয়ন্ত্রণে। নিজস্ব সংবিধান, প্রশাসন, বিচার ও শিক্ষাব্যবস্থাও গড়ে তুলেছে তারা। চিন প্রদেশ দ্রুত ‘চিনল্যান্ড’ হয়ে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে ‘চিনল্যান্ডে’র প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন হয় ঐতিহাসিক শহর ক্যাম্প ভিক্টোরিয়ায়।

মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ (এনইউজি) এর নেতারাও বেশিরভাগ এখন চিনল্যান্ডে থাকেন। চিনল্যান্ড ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ) এবং এনইউজি রীতিমতো চুক্তি করে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলেছে।

সংখ্যাগুরু জাতির সঙ্গে সংখ্যালঘু জাতির এ রকম চুক্তি এ অঞ্চলে এটাই প্রথম। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থীদের সংগ্রাম বিজয়ী হলে চিন-বামার ওই চুক্তির চূড়ান্ত সুফল দেখা যাবে। কুকি-চিনরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পাবে। চিনের রাজনীতিক এল এইচ সেখং এনইউজির হয়ে পুরো মিয়ানমারের জন্যও নতুন সংবিধান লিখছেন।

মিয়ানমারের চিন প্রদেশের কুকি-চিনরা এখন এমনকি ভারতের মিজোরাম ও বাংলাদেশের বান্দরবানের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে চাইছে। এর মধ্য দিয়ে তারা তিন দেশের কুকি-চিনদের মধ্যে একটি ঐক্য গড়ে তুলতে চায়। এতে ভারত ও বাংলাদেশে কুকি-চিনদের নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

এদিকে গত বছর ভারতের মণিপুর রাজ্যের বড় জাতিগোষ্ঠী মেইতেইদের ‘শিডিউল ট্রাইব’ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয় দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার। তার প্রতিবাদ জানাতে গেলেই মেইতেইদের সঙ্গে কুকি-চিনদের সংঘাতের শুরু হয়।

গত বছর মণিপুর রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই ও রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ইম্ফল উপত্যকার চারদিকে পাহাড়ি এলাকায় বাস করা নাগা ও কুকিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের সৃষ্টি হয়।

নাগা ও কুকিদের দাবি, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের মাধ্যমে মূলত তাদের ভূমি থেকে সরানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে অন্তত ২৩০ জন প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫০ হাজার মানুষ। মণিপুরের পূর্বদিকে মিয়ানমারের চিন প্রদেশ।

মণিপুরের কেন্দ্রে অবস্থিত ইম্ফল উপত্যকা রাজ্যটির প্রায় ১০ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত। মূলত মেইতেইরা এই ১০ শতাংশ ভূমিতে বাস করে। তাদের বড় অংশই হিন্দু। তবে মুসলমান ও বৌদ্ধও আছে। মেইতেইরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। রাজ্যের বিধানসভায় মেইতেইদের ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি।

অন্যদিকে ইম্ফল উপত্যকার আশপাশের পাহাড়ে বাস করে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণে বাস করে কুকি ও উত্তর-পূর্বে বাস করে নাগারা।

খ্রিস্টধর্মের অনুসারী কুকি-চিন ও নাগারা মণিপুরের ৩৫ লাখ মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশ। তারা পাহাড়ে সংরক্ষিত এলাকায় বাস করে। এই পাহাড়ি অঞ্চল মণিপুর ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ।

কুকি-চিনদের তরুণ বিদ্রোহী যোদ্ধারা।

মণিপুরের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, স্থানীয় জেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের অনুমতি মেইতেইদের নেই। অন্যদিকে কুকি ও নাগা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উপত্যকা এলাকায় বসবাসের ক্ষেত্রে কোনও বিধি-নিষেধ নেই।

তবে মণিপুরের রাজনীতিতে মেইতেইদের একেচেটিয়া আধিপত্য। বিশেষ করে রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলে। রাজ্যের বিধানসভার কুকি এমএলএরাও সেখানে যান না বা যেতে পারেন না। ৬০ সদস্যবিশিষ্ট বিধানসভায় কুকি প্রতিনিধিদের মধ্যে যারা বিজেপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারাও ইম্ফলে নিরাপত্তাসংকটে ভোগেন।

মণিপুরে ভারতের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট লোকসভার মাত্র দুটি আসন আছে। ‘আউটার মণিপুরের’ আসনটিতে সচরাচর কুকিরা দাঁড়ান এবং জেতেন। এটা ‘শিডিউল ট্রাইবদের’ জন্য সংরক্ষিত। কুকিরা নির্বাচনে না থাকায় হয়তো কোনও নাগা এই আসনে জিতে আসবেন।

রাজধানীতে প্রভাব না থাকায় কুকিরা বিচারব্যবস্থার সুবিধা থেকেও বঞ্চিতও হন। এ অবস্থায় রাজ্যের ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার কেটে তাদের জন্য আলাদা রাজ্য চাইছেন কুকিরা। এই দাবিতে যুক্ত হয়েছেন রাজ্য মন্ত্রিসভার দুই কুকি সদস্যও।

অস্থিরতার ঢেউ বাংলাদেশে

মিয়ানমার ও ভারতে কুকিদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াইয়ের ঢেউ বাংলাদেশে এসে লাগে কয়েক বছর আগে। বাংলাদেশের কুকি-চিনদের সংগঠন কেএনএফের জন্ম ২০০৮ সালে হলেও ২০১৬ সালে সংগঠনটি সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে। শুরুতে এর নাম ছিল কুকি চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স কেএনভি। পরে সশস্ত্র শাখাটির নাম হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।

তারা ভারতের মণিপুর ও মিয়ানমারের চিন রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই দলের সদস্যদের ভারতের মণিপুর ও মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে পাঠানো হয় গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। ২০১৯ সালে প্রশিক্ষণ শেষে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসে। শুরুতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে ব্যস্ত থাকলেও ধীরে ধীরে তারা অস্ত্র হাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

কুকি-চিনের নামটি বাংলাদেশে প্রথম আলোচনায় আসে ২০২২ সালে ইসলামী জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে তাদের ‘যোগসাজশের’ কারণে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘরছাড়া একদল তরুণের সন্ধানে নেমে র‌্যাব জানতে পারে, তারা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে নতুন একটি জঙ্গি দলে ভিড়েছে। আর পাহাড়ে তাদের আশ্রয় এবং সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ।

বান্দরবানে স্বায়ত্বশাসন চায় কুকি-চিনরা।

জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমায় অভিযান চালায় র‌্যাব ও সেনাবাহিনী। সেই অভিযানে সেনাসদস্যের প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটে। গত বছরের মে মাসেও দুই সেনাসদস্য কুকি-চিনের হামলায় প্রাণ হারান।

এই সংঘাতের মধ্যে ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে এই বছরের শুরু অবধি রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদমে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও দেয় স্থানীয় প্রশাসন। গত বছরের মে মাসে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কুকি-চিনদের একটি সমঝোতাও হয় এবং তারা আর অশান্তি না চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।

কিন্তু এ বছরের এপ্রিলে বান্দরবানের রুমায় ব্যাংক ডাকাতি করে ফের কুকি-চিনরা আলোচনায় আসে। পার্বত্যাঞ্চলের বম জনগোষ্ঠীর নাথান বমের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে স্থানীয়রা বম পার্টি নামেই চেনে। কেএনএফ বান্দরবান ও রাঙামাটির অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে বলে দাবি করে।

নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন। রুমা উপজেলার এডেন পাড়ায় তার বাড়ি। সেখানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামের একটি এনজিও গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

নাথান বম।

ছাত্রজীবনে জনসংহতি সমিতি সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যুক্ত ছিলেন নাথান। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সইয়ের পর খাগড়াছড়ি শহরের মহাজনপাড়া এলাকার লারমা স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণে যুক্ত ছিলেন নাথান।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতা লারমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন ২০০০ সালে। তখন শিল্পী হিসাবে নাখানের খ্যাতি বাড়ে। ওই সময় কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বইও প্রকাশ করেন তিনি।

ওই সময় থেকে নাথান কুকি-চিন জাতীয়তাবাদী চিন্তার একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন বলে ধারণা করা হয়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন।

বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যায়, নাথানের নেতৃত্বে সংগঠনের শতাধিক সদস্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।

তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে স্বশাসিত একটি পৃথক রাজ্য চায়। রাজ্যটি হবে বাংলাদেশের অধীনে, তবে স্বায়ত্তশাসিত।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুকি-বিশ্ব যেন ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। ভারতের মণিপুরের সহিংসতাকে কেন্দ্র করে সেখানকার কুকি-চিন জনগোষ্ঠী পুনরায় যে লড়াই শুরু করেছে সেই লড়াইয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কুকিরাও অংশগ্রহণ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাতে শেষ পর্যন্ত এ পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় বলা যায় না।

তথ্যসূত্র : দ্য ইরাবতী, বিবিসি, আল জাজিরা, দ্য স্টেটসম্যান, দ্য ডিপ্লোমেট এশিয়া, ইস্ট-এশিয়া ফোরাম, দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ফার্স্ট পোস্ট

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত