কাপড় আমদানির মিথ্যা ঘোষণায় জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারভর্তি মদ আনল কারা—সেই রহস্য যেন ভেদ হচ্ছেই না।
আমদানিকারক বলছে, তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অনেক আগেই বন্ধ। আমদানিকারকের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলছে, এ ধরনের চালানের বিষয়ে তারা কিছুই জানে না।
দু’পক্ষের দাবি, তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে একটি চক্র এই অনিয়ম-জালিয়াতির কাজটি করেছে। ফলে চালানটি খালাসের সঙ্গে কারা জড়িত ছিল—এ প্রশ্ন উঠেছে।
একইসঙ্গে কাপড়ের বদলে বিদেশি মদ চালানের ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কাপড় আমদানির ঘোষণা দিয়ে কন্টেইনারটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। ১৮ ডিসেম্বর চালানটির বিল অব এন্ট্রি চট্টগ্রাম কাস্টমসে জমা পড়ে।
গত ২২ ডিসেম্বর চালানটির বিপরীতে ভুয়া নথিপত্র দিয়ে শিপিং এজেন্টের কাছ থেকে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) নিতে গিয়ে অনিয়মের বিষয়টি জানাজানি হয়। পরদিন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করে চালানটি ছাড় না দেওয়ার জন্য কাস্টমসকে জানায়।
কিন্তু কাস্টমস গোয়েন্দা দল (এআইআর) গত ৫ সেপ্টেম্বর সেটি আটক করে। অর্থাৎ প্রায় ১০ মাস বন্দর ইয়ার্ডে চালানটি পড়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, চালানটি তখনই কায়িক পরীক্ষা না করে এতদিন পড়েছিল কেন?
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চট্টগ্রাম কাস্টমস গোয়েন্দা দল এআইআর শাখার প্রধান ডেপুটি কমিশনার একেএম খায়রুল বাশার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তদন্ত চলমান আছে। মামলা হয়েছে। ফলে এ বিষয়ে আমি কথা বলতে পারব না।”
গত ৫ সেপ্টেম্বর কাস্টমস গোয়েন্দা দল কন্টেইনার খুলে গণনার পর সেখানে ১১ হাজার ৬৭৬ লিটার মদ পায়। ব্ল্যাক লেবেল, বেলেনটাইন, স্মিরনফ, পাসপোর্ট স্কচ, শিভাস রিগ্যাল, হানড্রেড পাইপারসসহ প্রায় ১১টি ব্র্যান্ডের এসব মদের চালানের বাজারমূল্য শুল্কসহ ১৪ কোটি টাকা।
চালানটির বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের আদমজি ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান সুপ্রিম স্মার্ট ওয়ার লিমিটেডের নামে কাপড়ের ঘোষণায় মদের চালানটি এসেছে চীন থেকে।
এ প্রতিষ্ঠান দেশের একসময়ের শীর্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ওপেক্স গ্রুপের, যার মালিক আনিসুর রহমান সিনহা। বলা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অনেক আগে থেকে বন্ধ।
পণ্য খালাসে আমদানিকারকের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের বেপারি পাড়ার হাফিজ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড।
সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার খালিদ হোসেন মামুন ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কাস্টমসে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, সেই চালান তাদের নয়। তাদের আইডি হ্যাক করে চালানটি আনা হয়েছিল, কিন্তু কাস্টমস তখন চালানটি আটক করেনি।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খালেদ হোসেন মামুন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আমি দুটি চালান খালাসের কাজ করেছি। এরপর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি এই লাইসেন্সের অধীনে কোনও কাজ করিনি। ফলে এই চালান আমার নয়। তদন্ত করলে জালিয়াতির বিষয়টি বের হয়ে আসবে।
“২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আমার আইডি হ্যাক হওয়ার বিষয়টি জানানোর পর কাস্টমস তাতে সাড়া দেয়নি। উল্টো আমার নামে মামলা দিয়েছে। ফলে এতদিন কেন কাস্টমস কন্টেইনার খুলে যাচাই করেনি, সেটি এখন বড় প্রশ্ন। তাদের কেউ জড়িত ছিল কি না, আমি সে প্রশ্ন তুলতেই পারি।”
কাস্টমসের প্রাথমিক তদন্ত, মামলার এফআইআর কপি, কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে মদের চালান আমদানির বিষয়ে কথা বলে বেশ কিছু তথ্য মিলেছে।
মূলত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হাফিজ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের সাবেক কর্মী, তার কয়েকজন বন্ধু মিলে এই কাজ করেছেন। তাদের নেপথ্যে সহযোগিতা করেছে কাস্টমস এবং চোরাচালানে জড়িত একটি প্রভাবশালী চক্র।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট যখন ডিসেম্বরে কাস্টমসকে জানাল, তখন চালানটি খুলে কায়িক পরীক্ষা না করে ১০ মাস ইয়ার্ডে রেখে দেওয়া সন্দেহজনক।
তাদের অভিযোগ, কাস্টমসেরই একটি চক্র ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সাবেক কর্মী মিলে কৌশলে সেই চালান বন্দর থেকে বের করার ফন্দি করছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়, আর চালানটিও ধরা পড়ে।
এ ঘটনায় কাস্টমস বাদী হয়ে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে ১৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর থানায় মামলা করে। সেই আট জনের মধ্যে এক নম্বরে আছে আমদানিকারক সুপ্রিম স্মার্ট ওয়ার লিমিটেড।
মামলায় ২ থেকে ৫ নম্বর আসামি হচ্ছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হাফিজ ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান খালেদ হোসেন মামুন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাফেজ মো. বাকির হোসেন, পরিচালক মো. আবদুল গফুর ভূঁইয়া এবং পরিচালক ইউসুফ আফজাল।
মামলার ৬-৮ নম্বরে থাকা তিন আসামি হচ্ছেন রাজিব ওরফে আশরাফ হোসেন রাজু, রিপন, মিজানুর রহমান। তারা কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত, সে তথ্য এজাহারে নেই।
শেষের তিন আসামি জালিয়াতির মাধ্যমে চালানটি খালাসের চেষ্টা করেছে বলে কাস্টমসের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
এর মধ্যে মিজানুর রহমান হাফিজ ট্রেডিং লিমিটেডের সাবেক কর্মী। রিপন হাফিজ ট্রেডিং লিমিটেডের মালিক খালিদ হোসেন মামুনের এলাকার বন্ধু। আর রাজিবের পরিচয় মেলেনি।
একই প্রতিষ্ঠানে আগে কাজ করায় মিজানুর রহমানের কাছে হাফিজ ট্রেডিংয়ের সব নথিপত্র ছিল। ফলে খুব সহজে নতুন জাল কাগজপত্র বানিয়ে তারা চালানটি খালাসের চেষ্টা করে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
সেখানে বলা হয়, রিপন একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দুটি চালান খালাসের কাজ করেছিল। তারা মিলে জালিয়াতির কাজটি করে। উদ্দেশ্য, একসঙ্গে বিপুল টাকার মালিক হওয়া।
খালেদ হোসেন মামুন বলেন, “আগে আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কারণে রিপন ও মিজান এই সুযোগ নিতে পেরেছে। কিন্তু ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আমার আইডি-পাসওয়ার্ড আমার হাতে নেই, ইন্যাক্টিভ।
“আর কেউ যদি আমার আইডি দিয়ে চালানের বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করে, তাহলে আমার নিবন্ধিত মোবাইল নম্বরে ওটিপি আসবে। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এটি কাস্টমস বাধ্যতামূলক করেছে। এখন আমার ওটিপি ছাড়াই কীভাবে বিল সাবমিট হলো, তা রহস্যজনক। কাস্টমসের কারও যোগসাজশ ছাড়া এটি কখনই সম্ভব নয়।”
মামলার বাদী চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুদ হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা মামলা করেছি ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, সেই দুষ্টচক্রকে বের করতে। সেই তদন্ত এখন পুলিশ করবে। আর কাস্টমস কমিশনার স্যারের তথ্যের ভিত্তিতে আমরা চালান আটক করেছি। তার কাছে হয়তো তথ্যটা দেরিতে এসেছে।”
কাপড়ের ঘোষণা দিয়ে আনা মদের চালানটি তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে কাস্টমস।
কমিটির প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়, রাজিব ওরফে আশরাফ হোসেন রাজু, রিপন, মিজানুর রহমান সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি সেজে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল বানিয়ে শিপিং কোম্পানি আটলান্টিক ইন্টারন্যাশনালে গিয়ে ডেলিভারি অর্ডার নিতে যায়। তারা চালানটি খালাসের অপচেষ্টার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আটলান্টিক শিপিং কোম্পানি থেকে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মূল মালিক খালেদ হোসেন মামুনকে ফোন দিয়ে জানালে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এ বিষয়ে খালেদ হোসেন মামুন বলেন, “শিপিং এজেন্ট থেকে আমাকে না জানালে বিষয়টি ধরা পড়ত না। আমি জানতাম না আমার প্রতিষ্ঠানের নামে একটি চালান এসেছে। তখন আমি রিপন, মিজানকে ফোন দিই। এ ধরনের কোনও চালান আনার কথা তারা আমার কাছে অস্বীকার করে।”
তিন আসামি রাজিব ওরফে আশরাফ হোসেন রাজু, রিপন, মিজানুর রহমানের তৎপরতা সম্পর্কে খালেদ হোসেন বলেন, “আমি যখন চালানটি সম্পর্কে থানায় জিডি করতে যাই, তখন তাদের নম্বর থেকে একাধিকবার ফোন করে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়, যাতে আমি আর না এগোই। পরে যাচাই করে দেখা গেল, দুটি ফোন নম্বরের ভয়েস রিপন আর রাজিবের। কিন্তু রাজিবকে আমি চিনি না।”
কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের নাম-বিআইএন ব্যবহার করে এই জালিয়াতি এবং ফৌজদারি অপরাধ করা হয়েছে। ফলে এত বড় ঘটনায় তাদের দায় এড়ানোর কোনও সুযোগ নেই।