মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা ৫ কোটি টাকার ৫০ লাখ শলাকা ‘মন্ড’ ব্র্যান্ডের সিগারেট ভর্তি কন্টেইনার আটক হয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে। গত ২৭ জুন (বৃহস্পতিবার) রাতে চালানটি আটকের পর থেকে এর পেছনে কারা রয়েছে, তার সন্ধান চালাচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
এই চালানের আমদানি দলিলের তথ্য অনুযায়ী, চালানটির রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থাইল্যান্ডের এশিয়ান গ্লোবাল কোং লিমিটেড। চলানটি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ঢাকার হ্যামকো কর্পোরেশন লিমিটেডের নামে। আর চালানের বিপরীতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ঢাকার গুলশান অ্যাভিনিউর সিটি ব্যাংকের শাখা থেকে।
তবে হ্যামকো লিখিতভাবে বলেছে, তারা চালানটি আমদানি করেনি। আর ব্যাংকটিও বলছে, এ ধরণের ঋণপত্র খোলার তথ্য তাদের কাছে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকও বলেছে, বিষয়টি ভুয়া।
তাহলে পানির ফিল্টার আনার মিথ্যা ঘোষণায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের রয়েল গাল্ফ ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল ট্রেডিং এলএলসির ‘মন্ড’ ব্র্যান্ডের সিগারেটের চালানটি আনল কারা?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চট্টগ্রাম কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে সকাল সন্ধ্যা।
তারা বলছেন, সিগারেটের আমদানি শুল্ক প্রায় ৬০০ শতাংশ। এই বিপুল শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন পণ্য আমদানির আড়ালে সিগারেট এনে ধরা পড়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এর আগে এই ধরনের চালান ধরা পড়েছে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ধরা পড়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে। এরপরও এই ধরনের অবৈধ সিগারেট আমদানি থেমে নেই।
হ্যামকো গ্রুপ মূলত ব্যাটারির বাণিজ্যিক আমদানিকারক। পাশাপাশি সোলার পণ্য আমদানি, কুকওয়্যার, ইলেকট্রনিক্স, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রতিষ্ঠানটি হ্যাভেলস ব্রান্ডের ওয়াটার পিউরিফায়ার আমদানি করে দেশে বিপণন করে। এই হ্যাভেলস ব্রান্ডের পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন আমদানির ঘোষণা দিয়েই এই বিপুল সিগারেট আনা হয়েছে।
‘এমভি কোটা অঙ্গন’ জাহাজে করে আনা চালানটি থাইল্যান্ডের লামচেবাং সমুদ্রবন্দর থেকে সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে বৃহষ্পতিবার। বৃহস্পতিবার বিকালে জেটিতে জাহাজ ভেড়ানোর পর অন্য কনটেইনারের সঙ্গে নামানো হয় ওয়াটার পিউরিফায়ার ঘোষণায় আনা সেই কনটেইনারটি। রাত সাড়ে ১১টায় সন্দেহজনক কনটেইনারটি জাহাজ থেকে নামিয়ে রাখা হয় জেটি চত্বরে। সেখান থেকে দ্রুত স্থানান্তর করা হয় বন্দর ইয়ার্ডে।
সাধারণত কোনও কন্টেইনারে সন্দেহজনক, অবৈধ বা মিথ্যা ঘোষণার পণ্য আনার তথ্য থাকলে সেটি বন্দরে নামার আগেই চালানের বিপরীতে অনলাইনে লক করে দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা দল।
এই কন্টেইনার আটকের ক্ষেত্রে অনলাইনে লক না করে জাহাজ থেকে নামানোর পর পরই সেটি শনাক্ত না করে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয় কাস্টমস গোয়েন্দারা। এজন্য আগে থেকেই তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল চালানটির ওপর। আর তাৎক্ষণিক কন্টেইনার খুলে যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এতে করে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে সক্ষম হয় কাস্টমস গোয়েন্দা দলটি।
কাস্টমস, বন্দর ও সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে কনটেইনারটি খুলে কাস্টমস গোয়েন্দা দল। কনটেইনার খুলে পাওয়া যায় বিদেশি মন্ড ব্রান্ডের সিগারেট। একটানা ভোর চারটা পর্যন্ত চলে কার্টনে থাকা সিগারেট গণনা।
শেষমেশ কনটেইনারটিতে ৫০ লাখ শলাকা ‘মন্ড’ ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়, যা আটক করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তবে ঘোষণা অনুযায়ী কোনও ওয়াটার পিউরিফায়ার মেলেনি কন্টেইনারটিতে। কর্তৃপক্ষের হিসাবে চালানটিতে এসেছে ৫ কোটি টাকার সিগারেট।
কাস্টমস গোয়েন্দা দল বলছে, দুই কারণে দ্রুত কন্টেইনার খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একটি হচ্ছে, আমদানিকারককে অপকৌশলের সুযোগ না দেওয়া। দ্বিতীয়টি, অনলাইনে লক করলে সময়ক্ষেপণ হয় এবং কন্টেইনারটি হাতছাড়া হওয়ার সুযোগ এড়ানো।
কোনও চালানে অবৈধ, নিষিদ্ধ পণ্য ধরা পড়লে আমদানিকারক এবং তাদের নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সরাসরি দায় নিতে অস্বীকার করে। আর গতবাঁধা বলে দেয় বিদেশি সরবরাহকারীর ভুলে এই চালানটি দেশে চলে এসেছে।
ভুল পণ্য পাঠানোর জন্য জরিমানা আবেদন করে সেটি পুনরায় রপ্তানির জন্য কাস্টমসের হস্তক্ষেপ চায় আমদানিকারক। এতে করে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শাস্তি এড়ানোর সুযোগ পায়। এবার সেই অপকৌশলের সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
আমদানি পণ্যের চালান জাহাজ থেকে নামার পর সেটি খালাসের জন্য আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সেটির বিল অব এন্ট্রি জমা দেয়। এবার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিল অব এন্ট্রি জমা দেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
মূলত সিঅ্যান্ডএফকে সেই সুযোগ দিলে তারা নানা তালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করে। এতে গোয়েন্দার নজর অন্যদিকে সরে গেলে হয় কন্টেইনারটি গায়েব হয়ে যায়, অথবা চালানটি খালাসের জন্য কাঙ্ক্ষিত অফিসার এবং ঈদ ছুটির মতো বিশেষ দিনের খোঁজে থাকে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং আমদানিকারক। আর কাস্টমস অফিসারকে ম্যানেজ করে ভুয়া তথ্য দিয়েই চালানটি বন্দর থেকে খালাস করে নেয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। এবার সেই কৌশলের সুযোগ রাখেনি কাস্টমস গোয়েন্দা দল।
তাহলে চালানটি আনল কারা
হ্যামকো কর্পোরেশন লিমিটেড এতদিন হ্যাভেলস ব্রান্ডের পিউরিফায়ার চীন থেকে আমদানি করতো। এখন হঠাৎ চালানটি আনা হচ্ছে থাইল্যান্ড থেকে।
এই তথ্য রহস্যের জন্ম দেয়।
হ্যামকো কর্পোরেশনও লিখিতভাবে জানিয়েছে, তারা চালানটি আনেনি ও আমদানিও করেনি।
এই চালানের প্রাথমিক আমদানি দলিলের তথ্য অনুযায়ী, চালানটির রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান থাইল্যান্ডের এশিয়ান গ্লোবাল কোং লিমিটেড। চালানটি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ঢাকার হ্যামকো কর্পোরেশন লিমিটেডের নামে। আর চালানের বিপরীতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ঢাকার গুলশান অ্যাভিনিউর সিটি ব্যাংকের শাখা থেকে।
আমদানিকারকের ঘোষণা তদন্ত করতে গিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা দেখতে পান, চালানটির বিপরীতে ঋণপত্র খোলার তথ্য ভুয়া। সিটি ব্যাংকের গুলশান শাখায় এই ধরনের ঋণপত্র খোলার তথ্য নেই। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি ভুয়া বলে নিশ্চিত করে।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মিনহাজ উদ্দিন তপনের সঙ্গে সকাল সন্ধ্যার কথা হয়।
তিনি বলেন, “চালানটি আটকের পর তদন্ত করতে আমরা আমদানিকারককে (হ্যামকো প্রতিনিধি) ডাকি। তারা ঋণপত্র না খোলার বিষয়টি নিশ্চিত করলে আমরা প্রথমে সেটি বিশ্বাস করিনি। পরে যাচাই করতে গিয়েই জানতে পারি ঋণপত্র খোলার বিষয়টি ভুয়া। সিটি ব্যাংক সেটি নিশ্চিত করে, একইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি পুনরায় নিশ্চিত করে। তাহলে অন্য কেউ কাজটি করেছে।
“পরে জানা গেল হ্যামকোর নামে তৃতীয় একটি পক্ষ এই কাজটি করেছে। তারা কারা এখন সেটি উদঘাটনের চেষ্টা চলছে।”
কোনও পণ্য চালান অনলাইনে জমা দিতে হলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তার নিবন্ধিত আইডি থেকে করতে হবে। আর অনলাইনে লগইন করার সময় নিবন্ধিত গ্রাহকের মোবাইল ফোনে একটি ওটিপি যাবে; যাতে জালিয়াতি ঠেকানো যায়।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি। কাস্টম হাউসের উপ কমিশনার মোহাম্মদ জাকারিয়ার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে লগইন দিয়ে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারে প্রবেশ করে সিগারেটের চালানটির এন্ট্রি দেওয়া হয়েছে। আর গোয়েন্দা দল যদি না ধরত তাহলে সেই চালানটি পানির ফিল্টারের নামে অবাধেই খালাস হয়ে যেত।
এ বিষয়ে জানতে উপ কমিশনার মোহাম্মদ জাকারিয়াকে তার মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
কিন্তু মোহাম্মদ জাকারিয়া মৌখিকভাবে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে বলেছেন, তার মোবাইলে ওটিপি আসেনি এবং তিনি এই চালানটির লগইন করেননি।
তার সপক্ষে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান দাবি করেছেন, প্রাথমিক তদন্তে একজন উপ কমিশনারের আইডি হ্যাক করেই এই চালানের লগইন করা হয়েছিল। এখন বিস্তারিত তদন্ত চলছে, কীভাবে সেই কাজটি করা হলো। রাজস্ব বোর্ড আমাদের কাছে বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, লগ ইন করতে উপ কমিশনারকে দেওয়া রাজস্ব বোর্ডের আইডি-পাসওয়ার্ড অন্যরা পেল কীভাবে? আর লগইন করলে ওটিপি আসবেই। ফলে সেই ওটিপি জাকারিয়ার মোবাইল থেকে অন্যরাই পেল কীভাবে? এই বিষয়গুলো এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। জাকারিয়ার জড়িত থাকার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মুখপাত্র এবং যুগ্ম কমিশনার নাজিউর রহমান মিঞা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এত ডিটেইলস জানতে আমরা বিস্তারিত তদন্ত করব। তবে সেই তদন্ত কমিটি এখনও গঠিত হয়নি। এতটুকু বলতে পারি প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন রবিবার রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হয়েছে। সেখানে একজনের আইডি হ্যাক করেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা মত দিয়েছি।”
তবে এর আগে কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তার আইডি হ্যাক করেই মদসহ অনেকগুলো চালান বন্দর থেকে খালাস নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এরপর কাস্টমসের অনলাইন সিস্টেম অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের সুরক্ষা দিতে ওটিপি দেওয়ার নিয়ম চালু করেছিল রাজস্ব বোর্ড।
কেন এই কৌশল নেয়
আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪-এর অনুচ্ছেদ ২৫ (১০) অনুযায়ী, আমদানিযোগ্য সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে বাংলায় সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ স্পষ্টভাবে মুদ্রিত থাকতে হবে। তবে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সিগারেট আমদানি করলে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে এ ধরনের সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় মুদ্রণ করা যাবে। কিন্তু জব্দ করা সিগারেটের গায়ে এমন কোনও লেখা নেই।
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কেন সিগারেট আনা হলো—এর কারণ হিসেবে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, সব শর্ত মেনে বৈধপথে সিগারেট আমদানিতে ৫৯৬ দশমিক ২০ শতাংশ শুল্ককর দিতে হয়। অর্থাৎ সিগারেটের দাম যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে শুল্ককর দিতে হবে ৫৯৬ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিতেই মূলত মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সিগারেট আনে চক্রটি। আর পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র আমদানিতে করহার ২৫ শতাংশ, ফলে অনায়াসেই সেই সুযোগ নিয়েছে চক্রটি।