সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ করেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এক নতুন প্রবণতা— ঘিবলি ট্রেন্ড। চোখজুড়ানো আলো-ছায়ার খেলা, উষ্ণ রঙের মায়াবী আবহ, আর কল্পনার দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়ার এক অপার আহ্বান যেন এই ছবির ট্রেন্ড।
এতে অংশ নেওয়া মানুষজন নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের মুহূর্তগুলোকে জাপানের বিখ্যাত স্টুডিও ঘিবলির চলচ্চিত্রের মতো করে উপস্থাপন করছেন। কিন্তু কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই প্রবণতা? এর পেছনে রয়েছে এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন, যা আমাদের নস্টালজিয়া, সৌন্দর্যের আকর্ষণ আর বাস্তবতা থেকে পালানোর ইচ্ছার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ঘিবলি জনপ্রিয় হওয়ার কারণ
ইন্টারনেটে নতুন উন্মাদনা ঘিবলি-তে নিজেদের ছবি রূপান্তরিত করছেন অভিনেতা এবং ক্রীড়া তারকা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত। এই প্রবণতা সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে এমনকি ওপেনএআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যানও ব্যবহারকারীদের ধীরে চলার জন্য রসিকতার সাথে অনুরোধ করেছেন, কারণ তার দলেরও তো ঘুমের প্রয়োজন! রাতারাতি ঘিবলি’র ট্রেন্ড হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে কিছু মনস্তাত্বিক কারণ।
নস্টালজিয়ার আবেগ
শৈশবের স্মৃতি যেন সব সময়ই আমাদের কাছে এক সুখানুভূতির উৎস। জাপানি স্টুডিও ঘিবলির জনপ্রিয় চলচ্চিত্র— মাই নেবার টোটোরো, স্পিরিটেড অ্যাওয়ে, কি-কির ডেলিভারি সার্ভিস— বহু মানুষের শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই চলচ্চিত্রগুলো কেবল বিনোদন নয়, বরং এক রকম আবেগঘন অনুভূতি, যা মানুষকে ফিরিয়ে নেয় নির্ভার শৈশবে। তাই যখন কেউ নিজের জীবনের মুহূর্তগুলোকে ঘিবলি-শৈলীতে উপস্থাপন করেন, তখন তা যেন এক মিষ্টি স্মৃতির জানালা খুলে দেয়।
বাস্তবতা থেকে পালানোর আকর্ষণ
এস্কেপিজম বা বাস্তবতা থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ব্যস্ত নগরজীবন, দায়িত্বের ভার আর প্রযুক্তিনির্ভর যান্ত্রিক জীবন থেকে সামান্য অবসর চায় সবাই। স্টুডিও ঘিবলির চলচ্চিত্রগুলোতে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা, জাদুকরী কল্পনা আর সহজ-সরল জীবনের যে রূপায়ণ দেখা যায়, তা আমাদের মনে প্রশান্তির অনুভূতি এনে দেয়। ঘিবলি ট্রেন্ড সেই স্বপ্নময় দুনিয়াকে বাস্তব জীবনে নিয়ে আসার এক প্রচেষ্টা।
রঙ ও আলো-ছায়ার মোহনীয়তা
চোখের আরামদায়ক রঙ, সূক্ষ্ম আলো-ছায়ার বিন্যাস, আর কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ— ঘিবলি-শৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য। মানুষের মন এমন নান্দনিক উপস্থাপনায় সহজেই আকৃষ্ট হয়। নরম রঙের আলো, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা, আর গল্পের মতো সাজানো দৃশ্য আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের প্রশান্তি সৃষ্টি করে। তাই সামাজিক মাধ্যমে যখন কেউ নিজের জীবনের সাধারণ মুহূর্তগুলোকেও এই শৈলীতে রূপান্তরিত করে, তখন তা দর্শকদের হৃদয়ে অনুরণন তোলে।
ভাইরাল হওয়ার মনস্তত্ত্ব
যেকোনো সামাজিক মাধ্যমের প্রবণতা তখনই জনপ্রিয় হয়, যখন মানুষ তা অনুকরণ করতে শুরু করে। ঘিবলি ট্রেন্ডের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। মানুষ যখন দেখে যে, সাধারণ কোনো দৃশ্যকেও ঘিবলি-শৈলীর মাধ্যমে মোহনীয় করে তোলা যায়, তখন তারাও একই কাজ করতে চায়। ফলে একের পর এক ভিডিও তৈরি হতে থাকে, যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।
কে প্রথম এই ট্রেন্ড চালু করলো?
কখনও ভেবেছেন এই প্রবণতাকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে কার বড় ভূমিকা ছিল? সিয়াটলের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার গ্রান্ট স্ল্যাটন, অজান্তেই এই ‘ঘিবলি-রূপান্তরিত’ ক্রেজকে জ্বালানি জুগিয়েছিলেন। টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করেছে।
গত সপ্তাহে, ওপেনএআই নতুন ইমেজ-জেনারেটিং টুল চালু করে এবং স্ল্যাটন এটি নিয়ে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এক্স (পূর্বে টুইটার) এ সমুদ্র সৈকতে তার পরিবার এবং কুকুরের স্টুডিও ঘিবলি-শৈলীর এআই দিয়ে তৈরি ছবি শেয়ার করেন। তার ক্যাপশন ছিল- “আপনার স্ত্রীর কাছে আপনাদের ছবি স্টুডিও ঘিবলি অ্যানিমের মতো বানিয়ে পাঠানোর বিষয়টা এখন খুব ‘আলফা’ (নতুন প্রজন্মের ট্রেন্ড বা জনপ্রিয়তা বোঝাতে)।”
ব্যবহারকারীদের মধ্যে সাড়া ফেলে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পোস্টটি ৪২ হাজার লাইক এবং প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ ভিউ পায়। আর এর ফলেই ঘিবলি-অনুপ্রাণিত ছবি সম্পাদনার ঢেউ তৈরি হয়।
যদিও স্ল্যাটন এই টুল ব্যবহারকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন না, তবে তার ভাইরাল পোস্টটি এই প্রবণতাকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেয়, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে।