Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

আসাদকে দেশছাড়া করা কে এই জুলানি

হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি।
হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি।
[publishpress_authors_box]

সামরিক অভিযান শুরুর মাত্র ১২ দিনের মধ্যে রাজধানী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সিরিয়ার দুই যুগের কর্তৃত্ববাদী শাসক বাশার আল-আসাদকে দেশছাড়া করেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।

তাদের নেতৃত্বে আছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস), যার জন্ম আল-কায়েদার সিরিয়া শাখা থেকে। এই এইচটিএসের প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির দিকে এ মুহূর্তে বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ।   

গত শুক্রবার সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৪২ বছর বয়সী জুলানি বলেন, “২৭ নভেম্বর শুরু হওয়া আমাদের অভিযানের লক্ষ্য একটাই- প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান ঘটানো।

“আমাদের বিপ্লবের লক্ষ্য আসাদ সরকারের পতন। এই লক্ষ্য অর্জনে যাবতীয় পথ কাজে লাগানো আমাদের অধিকার।”

দ্য গার্ডিয়ান বলছে, জুলানি বহু বছর আড়ালে থেকে তার সংগঠন চালিয়েছেন। এখন তিনি প্রকাশ্যে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বাশার আল-আসাদ সরকারের হাত থেকে সিরিয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর আলেপ্পো দখলের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় জুলানিকে প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে।

২০১৬ সালে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের পর নিজেকে উগ্র মতাদর্শ বাদ দেওয়া একজন মডারেট নেতা হিসেবে বিশ্বের সামনে হাজির করেন জুলানি। যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার এই রূপান্তরকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখেছেন।       

তাদের একজন রাজনৈতিক ইসলামবিষয়ক বিশেষজ্ঞ টমাস পিয়েরেট। জুলানি সম্পর্কে তার ভাষ্য, “তিনি একজন বাস্তববাদী উগ্রপন্থী।

“২০১৪ সালে তিনি উগ্রপন্থার শীর্ষে ছিলেন, যখন তার সংগঠন আইএসের সঙ্গে লড়াই করছিল। এরপর কথাবার্তায় তাকে সংযত হতে দেখা যায়।”

পোশাকে আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির রূপান্তর।

কেবল কথাবার্তায় নয়, পরিবর্তন আসে জুলানির পোশাক-আশাকেও। জিহাদিদের প্রচলিত পোশাক ছেড়ে পশ্চিমাদের পোশাক ব্লেজার-শার্ট পরা ধরেন।

এই রূপান্তর সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সিএনএনকে জুলানি বলেন, “আমি মনে করি, জীবনের পথে সবাই নানা পর্যায় ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ নতুন নতুন জিনিস শিখতে থাকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে শিখে যায়।”   

আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ায় সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠা এইচটিএসের প্রতিষ্ঠাতা জুলানি প্রায় এক দশক ধরে দেশটির অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছিলেন। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে সরে কেবল সিরিয়ায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র কায়েমে জোর দেন তিনি।

২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সিরিয়ান স্যালভেশন গভর্নমেন্টের মাধ্যমে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমের অঞ্চল ইদলিব পরিচালনা করে জুলানির সংগঠন এইচটিএস। তাদের কাজ ছিল সেখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচারব্যবস্থার পাশাপাশি আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।

জুলানির নেতৃত্বাধীন এইচটিএস কঠোর হাতে ইদলিব শাসনের পাশাপাশি ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিষয়ে অসহিষ্ণু আচরণ করে বলে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে।

আল-কায়েদা দিয়ে যাত্রা শুরু আবু মোহাম্মদ আল-জুলানির।

জুলানির শৈশব

১৯৮২ সালে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এক সিরীয় পরিবারে জন্ম হয় জুলানির। সেখানে তার বাবা পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন।

১৯৮৯ সালে জুলানির পরিবার সিরিয়ায় ফিরে আসে এবং দামেস্কের কাছে থাকা শুরু করে।

২০০৩ সালে ইরাকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জুলানি সম্পর্কিত তথ্য খুব একটা নেই। দামেস্ক শহরে তিনি কীভাবে বেড়ে উঠেছেন, কাদের সান্নিধ্যে ছিলেন, এ বিষয়ে আল জাজিরা খোঁজ করে তেমন কিছু জানতে পারেনি। 

জুলানির উত্থান

২০০৩ সালে ইরাকে গিয়ে আল-কায়েদায় যোগ দেন জুলানি। সেসময় দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছিল আল-কায়েদা।  

২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন জুলানি। পাঁচ বছর কারাবন্দি ছিলেন। সেখান থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাকে আল-কায়েদার সিরিয়া শাখা আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই আল-নুসরা ফ্রন্ট জুলানির নেতৃত্বে সিরিয়ায় বিরোধী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল বিশেষ করে ইদলিব শক্তিশালী হতে শুরু করে।    

সে সময় আল-কায়েদার ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাকের’ প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতেন জুলানি। এই ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক’-ই পরে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ায় (আইএসআইএস) রূপান্তরিত হয়।

২০১৩ সালের এপ্রিলে আল-বাগদাদি হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে বসেন, তার সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করছে এবং সিরিয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করা হবে।

আল-বাগদাদির এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে আল-কায়েদার প্রতি আনুগত্য ধরে রাখেন জুলানি। 

২০১৪ সালে জীবনের প্রথম সাক্ষাৎকার জুলানি আল জাজিরাকে বলেছিলেন, তার দল ইসলামি আইনকে যেভাবে ব্যাখ্যা করে, সেটার আদলেই সিরিয়া শাসিত হবে। খ্রিস্টান, আলাউইসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুরা দেশটিতে থাকতে পারবে না।        

আল-কায়েদার ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাকের’ প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি।

জুলানিকে পরের বছরগুলোতে আল-কায়েদার সব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ নিয়ে ‘বৈশ্বিক খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার প্রকল্প থেকে দূরে থাকতে দেখা যায়। বরং সিরিয়া সীমান্তের ভেতরেই সংগঠন গোছাতে বেশি তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি।       

এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে জাতীয়বাদী চরিত্রে হাজির করাতে চান বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

২০১৬ সালের জুলাইয়ে আলেপ্পো প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে ইদলিবের দিকে নিজেদের একত্রিত করতে থাকে সিরিয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। ওই অঞ্চল তখন পর্যন্ত বিরোধীদের দখলেই ছিল। সে সময়ই জুলানি ঘোষণা দেন, আল-নুসরা ফ্রন্ট থেকে জাবাত ফাতেহ আল-শামে পরিবর্তিত হয়েছে তার সশস্ত্র সংগঠন।

পরের বছর ২০১৭ সালের শুরুতে আলেপ্পো থেকে পালিয়ে হাজার হাজার যোদ্ধা ইদলিবে সমবেত হলে জুলানি আরেকটি ঘোষণা দেন। তিনি জানান, পালিয়ে আসা যোদ্ধা ও নিজের সংগঠনের যোদ্ধাদের নিয়ে তিনি এইচটিএস নামে নতুন সংগঠন গড়তে যাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মতে, এইচটিএসের লক্ষ্য আসাদের স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের হাত থেকে সিরিয়াকে মুক্ত করা। পাশাপাশি ইরানের মিলিশিয়াদের দেশ থেকে হটানো।

অবশ্য আল-কায়েদা থেকে বের হয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তোলা জুলানির কৌশল ছিল বলে মনে করেন সিএনএনের সাংবাদিক মোস্তফা সালেম।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার মতো পরাশক্তির আক্রমণ থেকে নিজের সংগঠনকে রক্ষার লক্ষ্যেই আল-কায়েদা থেকে বের হয়ে এইটিএস গঠন করেছিলেন জুলানি। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া উভয়ই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেছিল আল-কায়েদা ও আইএসকে নির্মূল করার লক্ষ্যে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত