Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

জটিল-কঠিন বাস্তবতার কিয়ার স্টারমার

যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির প্রধান কিয়ার স্টারমার।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির প্রধান কিয়ার স্টারমার।
[publishpress_authors_box]

ব্রিটিশ রাজের প্রতিনিধি হিসেবে সন্ত্রাসবাদীদের বিচার করেছেন তিনি। তার আগে পশু ও পৃথিবীকে রক্ষায় নৈরাজ‍্যবাদে নাম লেখানো তরুণ-তরুণীদের আইনজীবী হিসেবে লড়তেন বামঘেঁষা এই আইনজীবী। আবার যৌবনে তিনি ছিলেন ট্রটস্কিপন্থী এক সাময়িকীর সম্পাদক।

অথচ সেই তিনিই এ বছর ‘সম্পদ সৃষ্টি’কে দলের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে পুঁজিবাদীদের মন জয় করে নেন। তিনি সেই রাজতন্ত্র-বিরোধী, যিনি পরে পেয়েছেন ‘স‍্যার’ উপাধি; আর এখন সপ্তাহে একবার দেখা করবেন রাজার সঙ্গে।

সবই কেমন যেন এক জটিল-কঠিন বাস্তব জীবন। আর এসব মিলিয়েই ‘প্রধানমন্ত্রী স্টারমার’ কেমন হবেন তা অনুমান করা মুশকিল।

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। এর মধ্য দিয়ে ১৪ বছর পরে দলটি আবারও দেশটির ক্ষমতায় ফিরে আসছে।

হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনের মধ্যে ৪১০ আসনে জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। যেখানে সরকার গঠনের জন্য দরকার ৩২৬ আসন। বিশাল এই জয়ের ফলে দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন লেবার নেতা ৬১ বছর বয়সী কিয়ার স্টারমার।

গত নির্বাচনে লেবার পার্টি ৮৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছিল। এর পরপরই ২০২০ সালের শুরুতে কট্টর বামপন্থী রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের পরিবর্তে দলটির নেতৃত্ব পান কিয়ার স্টারমার।

দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই তিনি লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় ফেরানোকে নিজের লক্ষ্যে হিসেবে নির্ধারণ করেন। তার নেতৃত্বে মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যেই দলটি ঘুরে দাঁড়াল।

তবে প্রথমদিকে কোনও চমক না দেখাতে পারার অভিযোগ ‍উঠেছিল কিয়ার স্টারমারের বিরুদ্ধে। এজন্য তাকে বছরের পর বছর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

তবে লেবার পার্টিকে ব্রিটিশ রাজনীতির কেন্দ্রে ফেরানো এবং ভোটারদের কাছে টানার জন্য তার পদ্ধতিগত মিশন অবশেষে কাজ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। যার প্রমাণ মিলেছে কনজারভেটিভ পার্টির অধীনে বছরের পর বছর অর্থনৈতিক যন্ত্রণা এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় অতিষ্ঠ জনগণের লেবার পার্টির প্রতি ঝোঁকায়।

তার জীবনীকারদের একজন স্টারমারকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন বলে মন্তব্য করেছেন। স্টারমারও তার সম্পর্কে এই অস্পষ্টতার সদ্ব্যবহার করেন। ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের মানুষদেরও নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রয়েছে তার।

কিয়ার স্টারমার দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গুজব থেকেও উপকৃত হয়েছেন। তাকে নিয়ে হতো বিভিন্ন ধরনের ট্রল। এর মধ্যে আছে ‘ব্রিজেট জোনস’ নামের উপন্যাস ও মুভির নায়ক মানবাধিকার আইনজীবী চরিত্র মার্ক ডার্সি/কলিন ফার্থের সঙ্গে তার তুলনা।

স্টারমার লন্ডনের ঠিক বাইরে সারের একটি ছোট শহরে বড় হয়েছেন। তার মা ব্রিটেনের বিনামূল্যের জনস্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থা জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগে (এনএইচএস) নার্স ছিলেন। তার স্ত্রীও এনএইচএস-এ পেশাগত স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করেন।

স্টারমারের বাবা ছিলেন কারখানার টুলমেকার। স্টারমার তার রাজনৈতিক প্রচারে বাবা-মায়ের কথা এতো বেশিবার বলেছেন যে, তা নিয়ে মিমও তৈরি হয়।

তার পরিবারও কট্টর লেবার পার্টির সমর্থক ছিল, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার নামে। স্কটিশ খনি শ্রমিক কিয়ার হার্ডির নাম অনুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল। লেবার পার্টির প্রথম নেতা ছিলেন কিয়ার হার্ডি।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির স্থানীয় যুব শাখায় যোগ দেন স্টারমার। সেসময় কিছু সময়ের জন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক বিকল্প নামের একটি কট্টর বামপন্থী ম্যাগাজিনও সম্পাদনা করেন।

স্টারমার ছিলেন তার পরিবারের প্রথম সদস্য, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। লিডস ও অক্সফোর্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। পড়াশোনা শেষে আইন পেশায় যোগ দেন।

তিনি ২০০৮ সালে সরকারের প্রধান কৌঁসুলি হন এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস পরিচালনা করেন। রাজনীতিতে ফেরার এক বছর আগে ২০১৪ সালে তাকে ‘নাইট’ উপাধি দেওয়া হয়।

স্টারমার প্রথম সংসদে যান ২০১৫ সালে। লন্ডনের হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের এমপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কট্টর বাম রাজনীতিবিদ জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি তখন বিরোধী দলের ভূমিকায়।

অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকলাপ নজরে রাখার জন্য কিয়ার স্টারমারকে ‘শ্যাডো হোম সেক্রেটারি’ (ছায়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন জেরেমি করবিন। যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেওয়ার পরে তাকে ‘শ্যাডো ব্রেক্সিট মন্ত্রী’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর লেবার পার্টির নেতা হওয়ার সুযোগ পান স্টারমার। লেবার পার্টির জন্য সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল সেটা। তখন নির্বাচনে ১৯৩৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপভাবে হেরেছিল দলটি। এতে জেরেমি করবিন দলীয় প্রধানের পদ ছাড়তে বাধ্য হন।

‘সমাজতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’

লেবার পার্টি থেকে অতি সমাজতন্ত্রপন্থীদের সরিয়ে দিয়ে স্টারমার দলটিকে নির্বাচনযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে তিনি তার পূর্ববর্তী নেতা জেরেমি করবিনের অনুসারীদের কব্জা থেকে দলকে বের করে আনেন।

জেরেমি করবিন লেবার পার্টিকে বামপন্থী ও মধ্যপন্থীদের মধ্যে ভাগ করেছিলেন। তবে কিয়ার স্টারমার দলকে একত্রিত করতে চান। তার সময়ে দলটি মধ্যপন্থার দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ে।

করবিন পার্টিতে ইহুদি-বিদ্বেষের তদন্তের ফলাফলকে নাটকীয়ভাবে বাড়াবাড়ি বলে অভিহিত করলে স্টারমার তাকেও সংসদীয় দল থেকে বরখাস্ত করেন। এ বিষয়ে স্টারমার বলেছিলেন, “কখনও কখনও আপনাকে একজন ভালো নেতা হতে হলে নির্মমও হতে হবে।”

বামপন্থীদের অভিযোগ, সংসদীয় প্রার্থী হিসেবে যাতে শুধু মধ্যপন্থীরাই দাঁড়াতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে কিয়ার স্টারমার দলের অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদী অভিযান চালান।

তার প্রধান মন্ত্র হলো ‘দলের চেয়ে দেশ বড়’। মধ্যপন্থার প্রতি বেশি ঝোঁক থাকায় দলের বামপন্থীদের সমালোচনার শিকার হন তিনি।

ধনীদের আয়কর বাড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি বাতিল এবং অধিকাংশ সরকারি সেবার জাতীয়করণ করাসহ লেবারদের বেশ কয়েকটি মূল প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি সরে আসেন।

বছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের গ্রিন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি থেকেও সরে আসেন কিয়ার স্টারমার। তিনি গাজায় ইসরায়েলের অভিযান সমর্থন করেন। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্য আইনজীবী হিসেবে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। পরে অবশ্য ‘যুদ্ধবিরতি’ হওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।

তবে সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় স্টারমার বলেন, ব্রিটেনের জন্য তার এক দীর্ঘমেয়াদী ‘বড়, সাহসী পরিকল্পনা’ রয়েছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে রয়েছে কর আদায়ে কঠোরতা, এনএইচএসের সেবা নেওয়ার জন্য রোগীর অপেক্ষার সময় কমানো এবং আরও বেশি শিক্ষক ও স্থানীয় পুলিশ অফিসার নিয়োগ করা।

দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বের করার জন্য তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়াতে চান। যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ার জন্য ২০২০ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসাকেও দায়ী করা হয়।

স্টারমারের একটি বড় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, তরুণ পরিবারকে বাড়ি-গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্টে তথা প্রথম কিস্তি পরিশোধে অর্থ সহায়তা দেওয়া।

লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টিম বেল বলেন, “বামপন্থীদের অনেকে তাকে সমাজতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের হতাশ করার জন্য অভিযুক্ত করবে। আর ডানপন্থীরা তাকে নীতিগত ডিগবাজি বা স্ববিরোধিতার জন্য অভিযুক্ত করবে।

“কিন্তু জিততে যদি সেটাই লাগে, তাহলে আমি মনে করি তা স্টারমারের চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলবে। সরকারে যাওয়ার জন্য যা যা লাগে তিনি তা-ই করবেন এবং এখন পর্যন্ত তিনি তাই করেছেন।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত