ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পহেলগাম এলাকার বৈসারণে সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা, যে সংগঠনটিকে বছর দুই আগে নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার।
মঙ্গলবারের ওই হামলায় ২৬ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশই পর্যটক।
দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র পহেলগামে এই হামলা হয়। হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ভারতের জয়পুরে ছিলেন। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছিলেন সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয় সফরে। হামলার পর মোদী তার সফর সংক্ষিপ্ত করে বুধবার সকালে দিল্লিতে ফিরে আসেন।
হামলার পর টিআরএফ সোশাল মিডিয়ায় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, “ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে এখন পর্যন্ত ৮৫ হাজারের বেশি বহিরাগতকে স্থায়ী বসবাসের অধিকার দিয়ে ডোমিসাইল সনদ দেওয়া হয়েছে। এই বহিরাগতরা পর্যটকের ছদ্মবেশে আসে, তারপর ডোমিসাইল নেয় এবং এভাবে তারা এলাকাটিকে নিজেদের করে নেওয়ার চেষ্টা করে।”
এই বিবৃতির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মিন্ট।
তবে হামলার দায় স্বীকার করে টিআরএফ বলেছে, “এই অবৈধ বসতির চেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতেও সহিংসতা চালানো হবে।” এই বিবৃতির পর ভারতজুড়ে এবং দেশের বাইরেও এই হামলার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
পহেলগামের এই হামলাকে সাম্প্রতিক সময়ে জম্মু ও কাশ্মীরে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর একটি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর এমন হামলার ঘটনা আরও গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এর আগে গত ৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের দিন জম্মু অঞ্চলের রেয়াসি জেলায় অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীরা তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাসে গুলি চালায়। এতে অন্তত ১০ জন নিহত এবং ৩৩ জন আহত হন।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার সাইফুল্লাহ কাসুরি, যিনি ‘খালিদ’ নামে পরিচিত, তিনি মঙ্গলবারের হামলার পরিকল্পনায় জড়িত সন্দেহভাজনদের একজন। রাওয়ালকোটে অবস্থানকারী লস্করের আরও দুই কমান্ডারের ভূমিকাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এদের একজনের নাম আবু মুসা।
কে এই সাইফুল্লাহ খালিদ
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলনে খালিদ নিজেকে ‘মিল্লি মুসলিম লীগ’ (এমএমএল)-এর সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি ওই সম্মেলনে দলের গঠন, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
খালিদ বর্তমানে লস্কর-ই-তৈয়বার পেশোয়ার সদরদপ্তরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি জামাত-উদ-দাওয়া (জেইউডি)-এর মধ্য পাঞ্জাব প্রদেশের সমন্বয় কমিটিতে কাজ করেছেন। জেইউডিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে লস্কর-ই-তৈয়বার একটি ছদ্মনাম হিসেবে ঘোষণা করে। এছাড়া জাতিসংঘ ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ১২৬৭/১৯৮৮ নিষেধাজ্ঞা তালিকায় লস্কর-ই-তৈয়বার ছদ্মনাম হিসেবে জেইউডিকে অন্তর্ভুক্ত করে।
টিআরএফ কি, এর প্রধান কে
‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) হলো একটি নতুন সন্ত্রাসী সংগঠন। ২০১৯ সালের আগস্টে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর এটি গঠিত হয়।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিআরএফ আসলে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার (এলইটি) একটি প্রক্সি শাখা হিসেবে কাজ করে। কাশ্মীর অঞ্চলে স্থানীয় পরিচয়ে সন্ত্রাসবাদের রূপ দিতে এই সংগঠন গঠন করা হয়।
টিআরএফ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের অক্টোবরে। এই সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতার দায়িত্বে ছিলেন শেখ সাজ্জাদ গুল, যিনি ‘সুপ্রিম কমান্ডার’ হিসেবে পরিচিত। সংগঠনের ‘চিফ অপারেশনাল কমান্ডার’ হিসেবে কাজ করতেন বাসিত আহমেদ দার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিজবুল মুজাহিদিন ও লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্যদের নিয়ে এই সংগঠন শুরু করা হয়। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে টিআরএফ-কে এলইটির একটি প্রক্সি সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
শেখ সাজ্জাদ গুল ১৯৭৪ সালের ১০ অক্টোবর শ্রীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। ভারত সরকার তাকে ২০২২ সালে একজন সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করে। ২০২২ সালের এক তথ্য অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে ওই বছরে যেসব সন্ত্রাসী নিহত হন, তাদের ১৭২ জনের মধ্যে ১০৮ জনের সম্পর্ক টিআরএফের সঙ্গে ছিল।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (এমএইচএ) টিআরএফ এবং এর সব শাখা ও সামনের সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই নিষেধাজ্ঞা জারির সময় মন্ত্রণালয় জানায়, সংগঠনটিকে বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন, ১৯৬৭ (ইউএপিএ) অনুযায়ী একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, “টিআরএফের কর্মকাণ্ড ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।”
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রক্সি সংগঠন টিআরএফ “সোশাল মিডিয়ায় মানসিক চাপ তৈরির উদ্দেশ্যে অপপ্রচার চালায় এবং জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষদের ভারতবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দিতে উসকানি দেয়।”
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট গঠিত হয় ২০১৯ সালে। এটি লস্কর-ই-তৈয়বার একটি প্রক্সি সংগঠন। লস্কর-ই-তৈয়বা একটি নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন। এর নাম ইউএপিএর প্রথম তফসিলের ৫ নম্বর সিরিয়ালে তালিকাভুক্ত রয়েছে।”
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, টিআরএফ অনলাইন মাধ্যমে তরুণদের সন্ত্রাসী কাজে নিয়োগ দিচ্ছে। তারা সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত অপপ্রচার চালাচ্ছে, সন্ত্রাসী নিয়োগ করছে, সীমান্ত দিয়ে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে এবং পাকিস্তান থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে অস্ত্র ও মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
টিআরএফের যত হামলা
গত কয়েক বছর ধরে টিআরএফ কাশ্মীর অঞ্চলের সাধারণ মানুষ, কাশ্মীরি পণ্ডিত, অভিবাসী শ্রমিক এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর চালানো অধিকাংশ হামলার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার আগেই টিআরএফ জম্মু ও কাশ্মীরের গান্দারবল জেলায় একটি নির্মাণস্থলে চালানো হামলার দায় স্বীকার করে। সেই হামলায় এক চিকিৎসক এবং ছয়জন অভিবাসী শ্রমিক নিহত হন।
২০২৪ সালের গান্দারবল হামলার পর টিআরএফ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল টিআরএফ প্রধান শেখ সাজ্জাদ গুল। হামলাটি সংগঠনের স্থানীয় একটি দল চালায়। তারা এই হামলায় কাশ্মীরি ও অকাশ্মীরি – উভয় গোষ্ঠীকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।
টিআরএফ জড়িত আরেকটি বড় হামলা ছিল ২০২০ সালের ১ এপ্রিল। ওই দিন সংগঠনটি কুপওয়ারা জেলার কেরান সেক্টরে সীমান্তরেখা (লাইন অব কন্ট্রোল) সংলগ্ন এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে চারদিনব্যাপী বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে পাঁচজন ভারতীয় প্যারা কমান্ডো এবং কয়েকজন জঙ্গি নিহত হন।
টিআরএফের কয়েকজন পরিচিত সদস্যের মধ্যে রয়েছে সাজিদ জাট, সাজ্জাদ গুল ও সেলিম রেহমানি। এদের সবারই পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
তথ্যসূত্র : মিন্ট ও টাইমস অব ইন্ডিয়া।