অর্ধযুগ আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিচিতি লাভ করেন এখনকার গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নুর। ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে সেই আন্দোলনে সফলতার হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি হন তিনি। তারপর জাতীয় রাজনীতিতে আসা নুর একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেন। গণ অধিকার পরিষদ নামের সেই দলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সব ছাত্রনেতাই ছিলেন।
২০২৩ সালে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পাওয়ার দৌড়ে প্রাথমিকভাবে যে ১২টি দলে টিকেছিল তার একটিও ছিল গণ অধিকার পরিষদ। তবে শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন পায়নি দলটি, ভাঙনও ধরেছে দলটিতে।
দলটির নুর নেতৃত্বাধীন অংশে সদস্য সচিব হিসাবে রাশেদ খান থাকলেও তাদের আরেক সঙ্গী ফারুক হাসান এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন গণঅধিকার পরিষদের আরেক অংশ।
এরই মধ্যে কোটা বাতিলের দাবিতে নতুন করে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তাতে নেই তারা। আর ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে নয়, এবার আন্দোলনে প্ল্যাটফর্মের নামও বদলে গেছে। ব্যানারে নাম দেখা যাচ্ছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ‘ছাত্র শক্তি’ নামের একটি সংগঠনের নেতারাই এবারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর এই সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন ছাত্র অধিকার পরিষদের এক সময়ের নেতা, নুর নেতৃত্বাধীন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন।
তিনি গত বছরের অক্টোবরে ‘ছাত্র শক্তি’ নামে এই ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন ‘লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার’ লক্ষ্যে ঘোষণা দিয়ে। যার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত নুর নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্রব ছাড়েন তিনি।
‘ছাত্র শক্তি’র ২১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিতে আখতার নিজেই আহ্বায়ক হন। সচিব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলামকে। এই নাহিদ ইসলামই বর্তমানে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর সমন্বয়কের ভূমিকায় আছেন।
এবারের আন্দোলনের সূচনায় গত ৯ জুন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে প্রথম সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ব্যানার বদলে হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
‘ছাত্র শক্তি’ এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে কি না- প্রশ্ন করা হলে সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আসিফ মাহমুদ কৌশলী উত্তর দেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা, ছাত্রশক্তি সংগঠন হিসেবে না। ব্যক্তিগতভাবে এই আন্দোলনে ছিলাম।”
ব্যানারের নাম কেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ এর পরিবর্তে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ করা হলো এমন প্রশ্নে এই ছাত্রনেতা বলেন, “আমরা আমাদের কৌশলের অংশ হিসেবে এটা করেছি। ঈদের আগে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ ব্যানারে কর্মসূচি পালন করেছি।
“যখন ছুটিতে ছিলাম, তখন ব্যানারটি সর্বজনীন করার আবেদন অনুভব করলাম। আমাদের অনলাইনে একটি গ্রুপ খোলা হয়েছিল। সেখানে একটি পোলে এই নতুন ব্যানার সর্বোচ্চে ভোট পায়। যার ফলে আন্দোলনটাকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন এই ব্যানার।”
নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে, নাকি ব্যানারের নামই কেবল বদলেছে- এই প্রশ্নে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর সমন্বয়ক, ছাত্রশক্তির সদস্য সচিব নাহিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নেতৃত্বের পরিবর্তন হয় নাই। ব্যানারে পরিবর্তন হয়েছে। কারণ এটা শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন না। সেই জায়গা থেকে ওপেন একটা প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে।”
এই অন্দোলনে ছাত্র অধিকার পরিষদ আছে কি না- জানতে চাইলে নাহিদ বলেন, “তারা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব পর্যায়ে নেই। এটা একটা ওপেন আন্দোলন। এখানে ছাত্রলীগের অনেক নেতা আছে। আমাদের এখানে অনেক সংগঠনের নেতা-কর্মী আছে। তাই কোনও সংগঠনের ব্যানারে গড়ে ওঠেনি।”
ছাত্রশক্তিই কি বর্তমান কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে- এমন প্রশ্নে সংগঠনটির শীর্ষনেতা আখতার হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা ঠিক। এখন যে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছে, তার আদ্যোপান্ত কাজ করছেন ছাত্রশক্তির অনেকে।”
ছাত্র অধিকার পরিষদ এই আন্দোলনের সঙ্গে কেন নেই- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তখনকার ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আর হালের ছাত্র অধিকার পরিষদ এক নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্র অধিকার পরিষদ নেই, যারা ছিলেন তারা পদত্যাগ করেছেন।”
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংগঠনটির সাবেক নেতা আখতার।
ছাত্র অধিকার পরিষদকে এই আন্দোলনে চান কি না- জানতে চাইলে আখতার বলেন, “এখন যে আন্দোলন চলছে, সেই আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে আমি চাইব সবাই এসে আন্দোলনে অংশ নেবে। তবে এটা আসলে যারা আন্দোলন করছে, তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়।”
কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ তেমন ছিল না। নুরদের নিয়ে নানা প্রশ্নও ছিল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের।
তবে এখনকার আন্দোলনে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য সচিব উমামা ফাতেমাকে। এই বাম ছাত্র সংগঠনটি যে রাজনৈতিক দলকে অনুসরণ করে থাকে, জোনায়েদ সাকি নেতৃত্বাধীন সেই দল গণসংহতি আন্দোলন জাতীয় রাজনীতিতে নুরদের কাছাকাছি।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে ছাত্র ফেডারেশনের উমামা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আসলে কোটা পুনর্বহাল না করার জন্য যে গ্রুপ করা হয়েছিল, সেখানে একটা কমন নামের চিন্তা করা হয়েছিল। সেখানে একটি পোল খোলা হয়। যেখানে সর্বোচ্চ ভোটে এই নামটি ঠিক করা হয়।”
ছাত্র অধিকার পরিষদ এই আন্দোলনে আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ছাত্র অধিকার পরিষদের অনেকেই আছে। তরিকুল ভাই (কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারিকুল ইসলাম) আছে। আমরাও আছি। মূলত ছাত্রশক্তি, ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্র অধিকার পরিষদের তরিকুল ভাইকে দেখেছি।”
নূর-ফারুক কেন নেই
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে এবার নুরের কোনও কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। তবে তিনি দাবি করেছেন, কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন তারা।
নুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমারা আছি। যেসব শিক্ষার্থী আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসছে তাদের বলছি এটা একটি অরাজনৈতিক দাবি। একটা জেনারেল ব্যানারে করতে, যা সাধারণ ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রাণের দাবি।”
আন্দোলনে সক্রিয় না থাকার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আমরা এখন ছাত্র নাই। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আন্দোলন করতে পারি না। আমাদের কাছ যারা এসেছিল, তাদেরকে বলেছি, এককভাবে যাতে কেউ নেতৃত্ব না দেয়। তাহলে গোয়েন্দা সংস্থা এসে তার এবং পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে। অথবা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে।”
বর্তমান আন্দোলনে ছাত্র অধিকার পরিষদের তরিকুল আছেন বলে জানান নুর।
তিনি বলেন, “যেহেতু আমরা এখন জাতীয় রাজনীতিতে আছি। সরকারবিরোধী একটা স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করছি। তাই আমরা ওখানে গেলে আন্দোলনকে ফেব্রিকেটেড করার চেষ্টা করা হবে। আমরা আসলে জাতীয় নেতৃত্ব নিয়ে সবাই মিলে কথা বলব।”
কোটা পুনর্বহালের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ মেধাশূন্য রাষ্ট্র তৈরি করতে চাচ্ছে। অযোগ্য আমলাতন্ত্র তৈরি হচ্ছে, যা বাংলাদেশকে একটি পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত করবে।”
কোটাবিরোধী আন্দোলনে নুরের এক সময়ের সঙ্গী, বর্তমানে গণঅধিকার পরিষদের আরেক অংশের সদস্য সচিব ফারুক হাসানেরও এবারের আন্দোলন নিয়ে কোনও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন আমাদের ছাত্রত্ব নাই। আমরা জাতীয় রাজনীতি করি। আমরা আসলে বিষয়টা অন্যরকম হবে।”
তবে তার দলের অনুসারী ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে আছে বলে দাবি করেন ফারুক।
তিনি বলেন, “এই আন্দোলনে অরাজনৈতিক যারা আছে, তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে। তাদেরকে সামনে থাকতে হবে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।”
আদালতের দিকে তাকিয়ে
নুরদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন গড়ে ওঠার এক পর্যায়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব কোটা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয় কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিতে। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন দেয়।
তার আগে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত ছিল; এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ।
২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করার বিষয়ে পরিপত্রে বলা হয়, নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে।
আর নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং দশম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো।
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা নবম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণী) ও দশম গ্রেড থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) বাতিল করে (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) ১৪ থেকে ২০তম গ্রেডে রাখা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সেই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে ২০২০ সালে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন শিক্ষার্থী।
সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০২১ সালে রুল জারি করে হাই কোর্ট। এর তিন বছর পর গত ৫ জুন রুলটি যথাযথ ঘোষণা করে রায় হয়। তাতে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা আগের মতো পুনর্বহাল করা হয়।
এরপর কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন পুনরায় শুরু হয়। ৯ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে। সেই কর্মসূচি থেকে ৩০ জুনের মধ্যে পরিপত্র পুনর্বহালের দাবি তোলা হয়।
সেই সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পর গত তিন দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে। বুধবার শাহবাগে সড়ক অবরোধও হয়। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ব্যানারে সমাবেশ হয়েছে।
এদিকে হাই কোর্টের সেই রায় স্থগিত চেয়ে ৯ জুনই আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বৃহস্পতিবার শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী বুধবার শাহবাগে সড়ক অবরোধের সময় বলেছেন, আপিল বিভাগ কী সিদ্ধান্ত দেবে, তার অপেক্ষায় আছে তারা। তবে সেদিন ১১টায়ও সমাবেশ করবেন তারা।
এদিকে রায় স্থগিতের রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের প্রতিক্রিয়ায় কোটার পক্ষে রিট আবেদনকারীদের অন্যতম অহিদুল ইসলাম তুষার বলেছেন, তারা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন।