২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ উদ্ধারে সোমালি জলদস্যুদের সঙ্গে মালিকপক্ষের আলোচনা চলছে।
তাদের মুক্তিপণ নিয়ে গত ২০ মার্চ তৃতীয় একটি পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সোমালি জলদস্যুরা। এরপরই শুরু হয় মালিকপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি। যদিও কত টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে বা আলোচনা এখন কোন পর্যায়ে আছে- সে বিষয়ে কিছু জানায়নি এমভি আবদুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপ।
অবশ্য এর আগে ২০১০ সালে একই ধরনের ঘটনায়ও কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি মালিকপক্ষ। সেসময়ও জানা যায়নি, কত টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনা হয় এমভি জাহান মণি ও নাবিকদের।
দেশের জলসীমার বাইরে জিম্মির ঘটনা ঘটায় সরাসরি মালিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জলদস্যুদের কাছে অর্থ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মুক্তিপণের অর্থ পরিশোধ করে নির্ধারিত ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
নাবিকদের ছেড়ে দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নথি-প্রমাণ-ঘটনার সত্যতা যাচাই করে প্রিমিয়াম কাভারেজের হিসাব-নিকাশ করে।
এরপর যদি দেখা যায়, দস্যুদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়ামের চেয়ে বেশি, তাহলে বাকি টাকা জাহাজ মালিককে পরিশোধ করতে হয়। তবে যদি প্রিমিয়ামের চেয়ে কম হয় সেক্ষেত্রে মালিকপক্ষকে বাড়তি অর্থ গুনতে হয় না।
এক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতি না হলেও মালিকদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় জাহাজটি জিম্মি থাকা অবস্থায় ট্রিপ বাবদ কোনও ভাড়া না পাওয়ায়।
জাহাজের দুর্ঘটনা, ঝুঁকি সংক্রান্ত যেকোনও ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ নিয়ে কাজ করে প্রটেকশন অ্যান্ড ইনডেমনিটি ইনস্যুরেন্স (পিএন্ডআই) ক্লাব।
পিএন্ডআই ক্লাবে কর্মরতদের সংগঠন বাংলাদেশ মেরিটাইম ল’ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন আবদুল কাদের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জাহাজ মালিকদের হয়ত খুব বেশি লস হবে না। কারণ ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ যদি ঠিক থাকে তাহলে দেখা যাবে পুরো মুক্তিপণ ওই কোম্পানিই দিচ্ছে। জাহাজ মালিককে বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে না।
“এখন জাহাজ মালিকের সঙ্গে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চুক্তি কেমন আছে সেটি জানা গেলে বিষয়টি বোঝা যাবে। কিন্তু জাহাজ মালিক তো সেই বিষয়টি প্রকাশ করে না।”
ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জানান, এমভি আবদুল্লাহর ইন্স্যুরেন্স করা আছে, আবার জাহাজ যে প্রতিষ্ঠান ভাড়া নিয়েছে তাদেরও ইন্স্যুরেন্স করার নিয়ম আছে।
তিনি বলেন, “এখন কার ইন্স্যুরেন্স কত শতাংশ সেটি তো আমরা জানি না। তবে জাহাজ মালিকের আর্থিক লস হচ্ছে দস্যুদের হাতে জিম্মির পর থেকে জাহাজটি পণ্য পরিবহন বাবদ ভাড়া পাচ্ছে না।”
সোমালি দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর এমভি আবদুল্লাহর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নিয়মিত পণ্যবাহী জাহাজে চলাচল করেন এমন কয়েকজন নাবিক সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, এমভি আবদুল্লাহ আর্ন্তজাতিক বিধি বিএমপি-৫ অনুযায়ী দস্যুতা এড়াতে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি। সেটি চলছিলও প্রচলিত রুটের বাইরে গিয়ে।
তারা বলছেন, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি যখন হিসাব করতে বসবে তখন এসব ত্রুটি ধরা পড়বে। নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার পরেও দস্যুপ্রবণ এলাকা দিয়ে যাওয়া, সিটাডেলে (জাহাজে থাকা গোপন ও নিরাপদ কক্ষ) লুকানোর সুযোগ থাকলেও তা গ্রহণ না করার বিষয়টি উঠে আসবে। ফলে ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ বাবদ প্রাপ্য টাকার অঙ্ক থেকে অর্থ বাদ পড়বে। এক্ষেত্রে মালিক প্রতিষ্ঠানই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এক বিদেশি জাহাজের ক্যাপ্টেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস বা বিএমপি-৫ থাকলে এতটা বিপদে পড়তে হতো না আবদুল্লাহ জাহাজকে। তারা কেন যে রুলস মানেনি সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও খুঁজছি।
“উদাহরণ দিয়ে বলি, গত ২০ মার্চ একই সমুদ্রপথ দিয়ে যাওয়ার সময় সোমালি দস্যুদের কবলে পড়ে লাইবেরিয়ান একটি কার্গো জাহাজ। ছোট বোট নিয়ে দস্যুরা জাহাজে ওঠার চেষ্টা করলে জাহাজে থাকা আর্মড গার্ডস তাদের গুলি করে। এতে দস্যুরা পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন অপারেশন আটলান্টার একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। অথচ আবদুল্লাহ জাহাজে আমরা সেই দৃশ্যে দেখতে পাইনি।”
দস্যুদের কবলে পড়ার সময় এমভি আবদুল্লাহ কবির গ্রুপের নিজস্ব পণ্য পরিবহন করছিল না। আরব আমিরাতভিত্তিক একটি কোম্পানির কয়লা পরিবহন করছিল। কবির গ্রুপের কাছ থেকে জাহাজটি ভাড়া নিয়েছিল কোম্পানিটি।
ফলে ইন্স্যুরেন্সের সব নিয়ম জাহাজটির জন্য কার্যকর থাকার কথা।
মাস্টার মেরিনার ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “একটি সমুদ্রগামী জাহাজকে অবশ্যই ইন্স্যুরেন্স কাভারেজের মধ্যে থাকতে হবে। সেটি না করলে নাবিক জাহাজে উঠবে না, সমুদ্রে চলতে পারবে না, কোনও এজেন্ট জাহাজ ভাড়া করবে না। কিন্তু ইন্স্যুরেন্সের পরিমাণ কত, সেটি মালিক ও কোম্পানির বিষয়।
“আবার জাহাজে বডি, যন্ত্র, ইঞ্জিন, কার্গো, নাবিকদের জন্য আলাদা ইন্স্যুরেন্স থাকে। এখন জাহাজের বডি ইন্স্যুরেন্সের সঙ্গে দস্যুতার কিছু বিষয় যুক্ত আছে। ফলে এই কাভারেজের আওতায় জাহাজটি পড়তে পারে।”
তবে জাহাজের মাস্টার বা ক্যাপ্টেনের অবহেলার কারণে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে প্রিমিয়াম থেকে কিছু অর্থ বাদ পড়ে যাবে বলে জানান তিনি।
ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “দস্যুদের কাছ থেকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে বিদেশি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সহযোগিতা লাগেই। কারণ জাহাজ মালিকের পক্ষে এত টাকা পাঠানো অনেক জটিল, কঠিনও। ফলে আমরা দেখি প্রথমে অর্থ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিই পরিশোধ করে, যা তাদের জন্য খুবই সহজ। পরে জাহাজ মালিকের সঙ্গে বসে প্রিমিয়াম নিয়ে হিসাব-কিতাব করে।”