Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫

যুক্তরাজ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার নেপথ্যে কী

অভিবাসন বিরোধীদের দাঙ্গায় বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্য।
অভিবাসন বিরোধীদের দাঙ্গায় বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্য।
[publishpress_authors_box]

ইংল্যান্ডের উত্তরে সাউথপোর্টের সমুদ্রতীরবর্তী একটি শহরে এক নাচের ক্লাসে তিন কিশোরীকে ছুরিকাঘাতের পর যুক্তরাজ্যে শুরু হয়েছে ভয়াবহ দাঙ্গা। এই দাঙ্গা গত এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে দেশটিতে সবচেয়ে বড় অস্থিরতা তৈরি করেছে।

গোটা ইংল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিভিন্ন শহর ও নগরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এর পেছনে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে অনলাইনে ভুল তথ্য প্রচার, অতি-ডান এবং অভিবাসন-বিরোধীদের উস্কানি।

গত ২৯ জুলাই সাউথপোর্টে মার্কিন গায়িকা টেইলর সুইফটের থিমযুক্ত একটি নাচ ও যোগ ব্যায়ামের অনুষ্ঠানে ছুরি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে বেবে কিং (৬), এলসি ডট স্ট্যানকম্ব (৭) এবং অ্যালিস দা সিলভা আগুয়ার (৯) নামের তিন কিশোরী নিহত হয়। আহত হয় আরও আট শিশু এবং দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী।

ওই ঘটনার পর সেদিনই পুলিশ কাছাকাছি একটি গ্রাম থেকে ১৭ বছর বয়সী একজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানায়, তারা ঘটনাটিকে কোনও সন্ত্রাসী হামলা হিসাবে বিবেচনা করছে না।

কিন্তু হামলার পরপরই সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হতে থাকে যে সন্দেহভাজন হামলাকারী একজন মুসলমান ও অভিবাসনপ্রত্যাশী।

বলা হচ্ছে, ওই হামলকারী ২০২৩ সালে একটি নৌকায় চড়ে সাগরপাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন।

তার একটি মিথ্যা নামও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হতে থাকে। তাকে একজন মুসলিম উগ্রবাদী হিসেবে চিত্রায়িত করা হতে থাকে।

এমনকি বিবিসিসহ যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যগুলোতেও বলা হয়, সন্দেহভাজন হামলাকারীর বাবা-মা রুয়ান্ডা থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছেন। তারা যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে বসবাস করেন এবং সেখানেই তার জন্ম। অর্থাৎ, হামলাকারী জন্মসূত্রে যুক্তরাজ্যের নাগরিক হলেও তারা বাবা-মা এসেছেন রুয়ান্ডা থেকে। তারা মানে তিনি অভিবাসীদের সন্তান।

পুলিশ জনগণকে ‘অনিশ্চিত এবং মিথ্যা তথ্য’ না ছড়ানোর আহ্বান জানালেও তা থামেনি।

পরদিন সন্ধ্যায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ সাউথপোর্টে নিহতদের স্মরণে সমাবেশ করে। সেখান থেকেই স্থানীয় একটি মসজিদের কাছে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

দাঙ্গাবাজরা মসজিদ ও পুলিশের দিকে ইট, বোতল এবং বিভিন্ন জিনিস ছুড়ে মারে। একটি পুলিশ ভ্যান পুড়িয়ে দেয়। এতে ২৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।

এই বিশৃ্ঙ্খলার বিরুদ্ধে ব্যাপক নিন্দার ঝড় উঠে। স্থানীয় এমপি প্যাট্রিক হার্লি বলেন, ‘ঠগরা’ তিন শিশুর মৃত্যুকে ‘নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ ব্যবহার করতে শহরে প্রবেশ করে।

অন্যদিকে এক মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসা কিয়ার স্টারমার সাউথপোর্টের রাস্তায় লুটপাটকারী জনতার নিন্দা জানিয়েছেন।

সহিংসতা ছড়াতে সোশাল মিডিয়ার ভূমিকা

প্রথমে টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে আঞ্চলিক অভিবাসনবিরোধী কিছু চ্যানেলে সমাবেশ নিয়ে আলোচনা হয়। সেখান থেকেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ বলেছে, সহিংসতায় অতি-ডানপন্থী দল ইংলিশ ডিফেন্স লিগ (ইডিএল) এর সমর্থকরা জড়িত ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাউথপোর্ট দাঙ্গার পরদিন লন্ডন, হার্টলপুল ও ম্যানচেস্টারে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। সারা সপ্তাহজুড়ে অনেক মসজিদ এবং হোটেলে আশ্রয়প্রার্থীদের আবাসন লক্ষ্য করে হামলা হয়।

তবে রাস্তায় কোনও একক সাংগঠনিক শক্তি ছিল না।

বিবিসি মূলধারার সোশাল মিডিয়া এবং ছোট ছোট গ্রুপের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে দেখতে পায় যে, মূলত ইনফ্লুয়েন্সাররা এতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন। তারা বিক্ষোভের জন্য জনগণকে জড়ো করতে বার্তা দেন।

বিভিন্ন সার্কেলে একাধিক ইনফ্লুয়েন্সার শিশুদের ওপর আক্রমণকারীর পরিচয় সম্পর্কে মিথ্যা দাবিগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। ফলে তা ব্যাপক সংখ্যক শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যায়। এই শ্রোতাদের মধ্যে এমন সাধারণ মানুষও রয়েছেন, যাদের সঙ্গে অতি-ডানপন্থী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই।

ইডিএল প্রতিষ্ঠাতা অতি-ডান কর্মী এবং দোষী সাব্যস্ত অপরাধী টমি রবিনসন, যার আসল নাম স্টিফেন ইয়াক্সলে-লেনন, তিনিও এক্সে (সাবেক টুইটার) পোস্ট দিয়ে দাঙ্গায় উস্কানি দেন। সাইপ্রাসে ছুটিতে থাকাকালীন এক্সে তার প্রায় ১০ লাখ অনুসারীর উদ্দেশে তিনি উত্তেজক বার্তা পোস্ট করেন।

এই ইয়াক্সলে-লেননের সঙ্গে যুক্ত এক্স-এর একজন ইনফ্লুয়েন্সার, যিনি ‘লর্ড সাইমন’ নামে পোস্ট করেন, তিনি সর্বপ্রথম দেশব্যাপী প্রতিবাদের আহ্বান জানান। আর তাতেই আগুন জ্বলে উঠে।

কোথায় দাঙ্গা হয়েছে এবং কী ঘটেছে

এরপর দক্ষিণ উপকূলের প্লিমাউথ থেকে উত্তর পূর্বের সান্ডারল্যান্ড পর্যন্ত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টেও দাঙ্গা হয়েছে।

দাঙ্গাবাজরা মসজিদ এবং আশ্রয়প্রার্থীদের আবাসনেও আক্রমণ করে। একটি গ্রন্থাগারসহ গাড়ি এবং ভবনেও আগুন লাগিয়ে দেয়। দোকানপাট লুট করে।

একজন বিচারক বলেন, দক্ষিণ বেলফাস্টের সিটি হলের বাইরে অভিবাসনবিরোধী এবং বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভকারীরা মুখোমুখি হলে উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। সেখানে বর্ণবাদী ঘৃণাজনিত অপরাধ ঘটে। এক ব্যক্তির মাথা পা দিয়ে চেপে দেয় বর্ণবাদীরা। পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করছে।

রবিবার অভিবাসনপ্রত্যাশীদের আবাসস্থল রদারহ্যামের হলিডে ইনের আতঙ্কিত কর্মীরা নিজেদের আত্মরক্ষার ভয়ানক বিবরণ দেন। তারা জানান, ফ্রিজ এবং অন্যান্য আসবাবপত্র দিয়ে ঠেস দিয়ে তারা দরজা বন্ধ করে রেখে কোনোমতে দাঙ্গাকারীদের হামলা থেকে বাঁচেন। দাঙ্গাবাজরা তাদের বাগানে ঢুকে পড়ার সময় আশেপাশের বাসিন্দারাও তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান।

এই হামলায় কয়েক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছে, কেউ কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।

মার্সিসাইড পুলিশের চিফ কনস্টেবল বলেছেন, আহত কয়েকজন অফিসার ভয় পেয়েছিলেন যে, তারা হয়ত আর তাদের পরিবারের কাছে বেঁচে ফিরতে পারবে না।

এই সহিংসতা যুক্তরাজ্যের বাইরেও উদ্বেগ তৈরি করেছে। মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত সকলেই ভ্রমণ পরামর্শ জারি করেছে। যুক্তরাজ্যে ভ্রমণকারীদের সতর্ক থাকতে এবং প্রতিবাদ বিক্ষোভ এড়িয়ে চলতে অনুরোধ করেছে।

দাঙ্গায় প্রধানত কারা জড়িত

এটা শুধু দাঙ্গাবাজদের স্থানীয় সমন্বয়ের ছোট একটি চিত্র। তবে একটি পুলিশ সূত্র পিএ বার্তা সংস্থাকে জানিয়েছে, বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের অনেকে শুধু সোশাল মিডিয়ায় ছড়ানো বিভিন্ন ঘটনার ছবি ও ভিডিও দেখে বিক্ষোভে যোগ দেয়। আর অনেকে শুধু রাস্তার বিক্ষোভ দেখেই দাঙ্গায় যোগ দেয়।

বিবিসি হোম অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক মার্ক ইস্টন শুক্রবার রাতে সান্ডারল্যান্ডে ছিলেন। তিনি বলেন, অতি-ডানপন্থী দাঙ্গাবাজরা পুলিশকে আক্রমণ করেছে। একটি থানার পাশের একটি পরামর্শ কেন্দ্রে আগুন দিয়েছে। একটি মসজিদে পাথর নিক্ষেপ করেছে এবং দোকানপাট লুট করেছে।

মুখোশধারী ঠগদের পাশাপাশি তিনি স্থানীয় পরিবারগুলোকেও উল্লাস করতে দেখেছেন। তবে বিক্ষোভকারীদের সকলেই সহিংসতা করেননি বা সহিংসতার উদ্দেশ্য নিয়েও আসেননি। অভিবাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রচুর মানুষ শান্তিপূর্ণভাবেই প্রতিবাদ করতে এসেছিলেন।

রবিবার রদারহ্যামে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভে যোগদানকারী এমনই একজন বিবিসিকে বলেন, তিনি শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ করতে এসেছেন। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সাময়িক আবাসস্থল একটি হোটেলে হিংসাত্মক হামলার দৃশ্যগুলোকে তিনি পুরোপুরি বর্বর বলেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “আমরা এমন সহিংসতা করার জন্য এখানে আসিনি।”

লিভারপুলের আবদুল্লাহ কুইলিয়াম মসজিদের একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, অনেকে হতাশা থেকেও বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন।

বেশ কয়েকটি শহরে হিংসাত্মক বিভিন্ন গোষ্ঠী পাল্টা প্রতিবাদকারীদের সঙ্গেও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ব্রিস্টলে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভকারীরা বলেছে, অভিবাসনপ্রত্যাসীদের আবাসনের একটি ভবনে হামলা ঠেকাতে তারা হাতে হাত ধরে প্রতিরোধের দেয়াল তৈরি করেছিল।

বার্মিংহামে এশিয়ান যুবকদের নিয়ে গঠিত একটি দল ডানপন্থীদের সম্ভাব্য বিক্ষোভ ঠেকাতে জড়ো হলে অস্থিরতা তৈরি হয়। অথচ সেখানে ডানপন্থীদের বিক্ষোভের খবরটা ছিল গুজব।

পুলিশ ও সরকারের কী প্রতিক্রিয়া

পুলিশ বলছে, মঙ্গলবার ৬ আগস্ট পর্যন্ত ৪০০ জনেরও বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ বছরের কম বয়সী শিশুও রয়েছে।

কিয়ার স্টারমার এই দাঙ্গাকে ‘অতি-ডান গুণ্ডামি’ বলে আখ্যায়িত করে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এই দাঙ্গার ‘আপাত কারণ বা অনুপ্রেরণা যাই হোক না কেন’ অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তিনি বলেন, যারা এই সহিংসতায় অংশ নিয়েছে এবং যারা অনলাইনে তাদের উস্কানি দিয়েছে, তাদের সকলকেই বিচারের আওতায় আনা হবে।

সরকার আরও বলেছে, বিশেষজ্ঞ অফিসারদের একটি স্থায়ী বাহিনী বিশৃঙ্খলা মোকাবেলা করবে এবং পুলিশ বাহিনী সহিংসতাকারী গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার করবে।

ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তি অপসারণ নিশ্চিত করতে সামাজিক মিডিয়া কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও কাজ করছে সরকার।

সহিংসতায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের সাজা নিশ্চিত করার জন্য ৫০০টিরও বেশি নতুন কারাগার তৈরির ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক বিবিসিকে বলেছেন, বিদেশ থেকে বিশৃঙ্খলায় ভূমিকা রাখা ইনফ্লুয়েন্সারদেরও ধরে আনা হবে। কিছু সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটররা সন্ত্রাসবাদী অপরাধের অভিযোগও আনবেন।

দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তরা কী করছে

অনেক এলাকায় স্থানীয়রা সহিংসতার মুখে সমাবেশ করেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছে। সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে।

মেয়ে শিশুদের হত্যার ঘটনায় হতবাক সাউথপোর্টের কয়েক ডজন স্থানীয় বাসিন্দা সহিংসতার পরে সাহায্য করার জন্য ব্রাশ এবং বেলচা নিয়ে হাজির হয়েছিল।

ব্যবসায়ীরা দেয়াল পুনর্নির্মাণ এবং বিনামূল্যে জানালা প্রতিস্থাপনের প্রস্তাবও দিয়েছেন। অনেকে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহে নেমেছে।

হার্টলপুলের একটি মসজিদের জন্যও টাকা তোলা হচ্ছে। মসজিদটির জন্য মাত্র ১৫ মিনিটেই ২০০ পাউন্ড উঠে।

মার্সিসাইডের ধর্মীয় নেতারা সাউথপোর্ট ছুরি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণকে শান্ত ও সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভাজনের চেয়ে ঐক্যই বড়।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত