বিগত দেড় দশকে সব বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে অবিহিত করে দলটিকে এড়িয়ে চলছিল জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
জাতীয় পার্টি দাবি করেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা’র ব্যানারে মশাল মিছিল নিয়ে এসে জামায়াত-শিবিরের লোকজন ও কিছু দুষ্কৃতিকারী তাদের কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে।
তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার ব্যানারে যাওয়া ব্যক্তিদের দাবি, তাদের ওপর আগে হামলা করেন জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা।
আসলে কী ঘটেছিল—প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে তা জানার চেষ্টা করেছে সকাল সন্ধ্যা।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মশাল মিছিল নিয়ে ঢাকার পাইওনিয়ার রোড ধরে সেগুনবাগিচার দিক থেকে বিজয়নগরের দিকে মিছিল নিয়ে আসছিলেন ৭০-৮০ জন। এ সময় তারা জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। একই সময় জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন দলটির কয়েকজন নেতাকর্মী। মিছিলটি জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মিছিলের পেছনে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে স্লোগান নিয়ে জাতীয় পার্টির নেতাদের বাগবিতণ্ডা হয়। এসময় জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেন। ধাওয়া খেয়ে মিছিলে অংশ নেওয়া লোকেরা বিজয়নগরের দিকে চলে যায়। এর মিনিট পাঁচেক পর তারা একযোগে এসে ধাওয়া দিলে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা কার্যালয় ছেড়ে পিছু হটেন। পরে মিছিলকারীরা কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়, আগুন লাগিয়ে দেয়।
শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে উৎসুক মানুষের ভিড়। কার্যালয়ের মালামাল লুটপাট হয়েছে। পাঁচ তলা ভবনের নিচতলা পুড়ে গেছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিকৃতি। ভবনের ওপরের তলাগুলোতে আগুন দেওয়া না হলেও ভাঙচুর করা হয়েছে। ভাঙা জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভবনের মেঝেতে।
ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হয় রিকশাচালক রফিকের সঙ্গে। ময়মনসিংহের নান্দাইলের এই বাসিন্দা থাকেন বিজয়নগরের একটি মেসে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যখন আগুন দেওয়া হয়, তখন সামনের ফুটপাতের একটি দোকানে বসে ভাত খাচ্ছিলেন তিনি।
রফিক বলেন, “সব কিছুতো চোখের সামনেই হইলো। সেগুন বাগিচার দিক থাইক্যা পাইওনিয়ার রোড দিয়া কয়েকজন একটি মশাল মিছিল নিয়া আসতেছিল। হেই সময় জাতীয় পার্টি অফিসের সামনে ২০-২৫ জন বসা আছিল। হেরা মিছিলের পিছে থাকা মানুষজনের সঙ্গে গণ্ডগোল বাধায়। পরে দুই দলের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি, ঢিলাঢিলি শুরু হয়।
“হের পর মিছিলের লোকজন একসাথে হইয়া জাতীয় পার্টির নেতাদের দৌড়ানি দিলে হেরা অফিসের সামনে থাইক্যা চইলা যায়। হেই সময় অফিসের নিচে আগুন দেয় মিছিলের লোকজন।”
কার্যালয়ের পাশে থাকা এক দোকানি নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “আগুন লাগার কিছুক্ষণ পরই ফায়ার সার্ভিসের ২টা গাড়ি আসছিল। কিন্তু তারা অনেক অনুরোধ করার পরও মিছিলকারীরা তাদের আগুন নেভানোর কাজ করতে দেয়নি।”
ঘটনার শুরু কীভাবে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মশাল মিছিল থেকে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল। এ নিয়ে মিছিলের শেষ ভাগে থাকা ৪-৫ জনের সঙ্গে জাতীয় পার্টির অফিসের সামনে থাকা নেতাকর্মীর কথা কাটাকাটি হয়। এসময় তাদের ধাওয়া দেন পার্টির লোকজন। পরে মিছিলকারীরা একজোট হলে নেতারা পালিয়ে যান। এরপর অফিসে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়।”
তবে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের কেয়াটেকার আসলাম মোল্লা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সাড়ে ৭টার (বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা) দিকে মশাল মিছিল নিয়ে এসে অফিসে হামলা চালানো হয়। মিছিলে ছাত্র ও জামায়াতের লোকজন ছিল।
“আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস আসলেও তাদের আগুন নেভাতে দেওয়া হয়নি। হামলার কিছুক্ষণের মধ্যে ৬ গাড়ি সেনাবহিনীও এসেছিল। কিন্তু তারা এসে শুধু দেখেছে, কিছু করেনি। হামলার অনেকক্ষণ পর তারা অফিসের সামনে এসে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়ায়।”
জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা আগে উষ্কানি দিয়েছে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে আসলাম বলেন, “অফিসে সবসময়ই কিছু না কিছু নেতাকর্মী থাকেন। ঘটনার সময়ও কয়েকজন ছিলেন। তবে তাদের কেউ মিছিলকারীদের কিছু বলেনি।”
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার খবর পেয়ে শুক্রবার দেখতে আসেন জাতীয় পার্টির অনেক নেতাকর্মী। তাদেরই একজন রামপুরা থানা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির অনেক নেতাকর্মী রাস্তায় নেমেছেন। আমি নিজেও রাস্তায় আন্দোলন করেছি, দুই সন্তানকেও পাঠিয়েছি।
“গত ১৫ বছর আমরা জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের অনেক নির্যাতনের শিকার। দলটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। অথচ এখন আমাদের আওয়ামী লীগের দালাল বলা হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক।”
দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “জাতীয় পার্টির প্রতি সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষোভ নেই। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ক্ষোভ ও তাদের উষ্কানির কারণে গতকাল এই ঘটনা ঘটেছে।”
সেই নির্দিষ্ট গোষ্ঠী কারা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কারা জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, উষ্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে, এটা সবাই জানে। শুধু এতটুকু বলতে পারি তারা কোনও নিবন্ধিত দল নয়। কিন্তু জাতীয় পার্টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। সারাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে দলটির কমিটি আছে, নেতাকর্মী আছেন।”
কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না—এ প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির এই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, “দেশে এখনও প্রচলিত সংবিধান আছে, আইন-কানুন আছে। সেই অনুযায়ী এই দেশে রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সেই অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। দেশের একটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের।”
জাতীয় পার্টির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ইমরান হোসেন মিয়া বলেন, “একটি কুচক্রী মহলের উষ্কানিতে কিছু দুষ্কৃতিকারী এই হামলা চালাইছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি নামমাত্র কোনও দল নয় যে, এভাবে হামলা চালিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে।”
শুক্রবার দুপুর ১২টার সকাল সন্ধ্যার এই প্রতিবেদক যখন বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান, তিনি দেখতে পান, কেউ হাতে করে নিয়ে যাচ্ছেন টিউব লাইট, বৈদ্যুতিক তার। কেউবা খুলে যাচ্ছেন জানালার গ্রিল।
পরে ঘটনাস্থলে পাওয়া রমনা মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুরের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই ঘটনায় এখনও কোনও মামলা হয়েছে কি না, জানি না। কিছুক্ষণ আগে কার্যালয়ে লুটপাটের খবর পেয়ে আমরা এসেছি। তবে আসার পর কাউকে পাইনি।”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিজয়নগরে যে মিছিলটি যায়, তা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার ব্যানারে ‘পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অপতৎপরতা ও দেশবিরোধী চক্রান্তের প্রতিবাদে’ ওই মশাল মিছিল কর্মসূচি ছিল। এই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন গণঅধিকার পরিষদের ছাত্রসংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা।
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদের নেতা হাসান আল মামুন বৃহস্পতিবার রাতে ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, “শাহবাগে সমাবেশ শেষ করে আমরা বিজয়নগরে আসি। জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা আমাদের ওপর অস্ত্র নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে ফেইসবুকে একটি পোস্টে লেখেন, “জাতীয় বেইমান এই জাতীয় পার্টি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিজয়নগরে আমাদের ভাইদের পিটিয়েছে, অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। এবার এই জাতীয় বেইমানদের উৎখাত নিশ্চিত।”
এর কিছুক্ষণ পর হাসনাত আবদুল্লাহ আরেকটি পোস্টে লেখেন, “রাজু ভাস্কর্য থেকে ৮.৩০ এ মিছিল নিয়ে আমরা বিজয়নগরে মুভ করবো। জাতীয় বেইমানদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমও গতকাল সাড়ে ৭টার দিকে ফেইসবুকে এক পোস্টে লেখেন, “রাজু ভাস্কর্য থেকে মিছিল নিয়ে আমরা বিজয়নগরে যাচ্ছি।”
এরপর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি মিছিল বিজয়নগরের উদ্দেশ্যে বের হয়।
এর আগে রাত সোয়া ৮টার পর বিজয়নগরে গেলে দেখা যায়, জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের নিচতলায় আগুন দেওয়া হয়েছিল। তা নিভিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তখনও ভাঙচুর চলছিল।
পরে রাত ৯টার দিকে অনেক পুলিশ ও সেনা সদস্য জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে হামলাকারীদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েও জাতীয় পার্টি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলে দাবি করে আসছে দলটির নেতাকর্মীরা। গত ১৯ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদের তৃতীয় দফার সংলাপে ডাক না পাওয়ার পর থেকে দলটি এমন বক্তব্য আরও জোরাল হয়েছে। তবে তারা এ বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিতেই মনোযোগ দিচ্ছে।
তবে দলটির নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিকে ‘ব্র্যান্ডিং’ করার অপচেষ্টা চলছে। আন্দোলনে অংশ নিয়েও জাতীয় পার্টি বৈষম্যের শিকার। মিথ্যা মামলা দিয়ে দলটির সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার প্রেক্ষাপটে শুক্রবার দুপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বনানীর কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেখানেও দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, “আমরা আওয়ামী লীগের কোনও অপরাধের সঙ্গী ছিলাম না। আমাদের বিরুদ্ধে বড়-ছোট লেভেলে ষড়যন্ত্র চলছে।”