যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো জানুয়ারির ২০ তারিখ শপথ নিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ক্ষমতায় আসলে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হবে, এমন আশায় আছেন অনেকে। পাশাপাশি আরও অনেকে শঙ্কিত যে, ট্রাম্পের আমলে আবারও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে পারে। এরই মধ্যে চীন নিয়ে ট্রাম্প যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে যুদ্ধের বার্তাই পাওয়া যাচ্ছে। ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সব সমস্যার মূলে রয়েছে চীন। এমনটি আমেরিকান শিল্পক্ষেত্রের ধ্বংসের জন্যও তিনি চীনকে দায়ী করেন। কোভিড-১৯ মহামারি ও যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিলের মতো মাদকের বিস্তারের জন্য চীনকেই দোষী ভাবেন তিনি। এসব কারণে প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে কেমন হবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। প্রথম মেয়াদের অভিজ্ঞতা থেকে চীন কি ট্রাম্পের ব্যাপারে ভীত নাকি কৌশলী, এমন প্রশ্নগুলো সামনে আসছে। এসব প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর নিয়েই সাময়িকী ফরেন অ্যাফেয়ার্সে তুসিংহুয়া ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও সভাপতি ইয়ান শুয়েটাং একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
চীনকে ভয়ঙ্কর শত্রু হিসেবে দেখেন ট্রাম্প। তিনি তার বক্তব্যে এমনভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেন, যা মুনলে মনে হবে ট্রাম্প ছাড়া আর কেউ চীনকে পরাজিত করতে পারবেন না।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতির বিপরীতে গিয়েছিলেন। এখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তার ভাষণ এবং মন্ত্রিসভার নির্বাচিত সদস্যরা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, চীনের প্রতি তিনি তার কঠোর নীতি অব্যাহত রাখবেন। দুই দেশের সম্পর্ক আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এতে।
চীনের নেতারা ট্রাম্পকে ভয় পান না। কারণ তারা তার প্রথম মেয়াদ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। ট্রাম্পের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নীতি আরও বিরোধ ও উত্তেজনা তৈরি করবে। তবে বেইজিং বিশ্বাস করে, তারা এই ধরনের পরিস্থিতি সামলে নেবেন।
ট্রাম্পের অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এতে অন্য দেশগুলোকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে প্রণোদিত করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা কম। ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতির আদর্শিক ভিত্তি অতটা গভীর নয়। তাই দুই দেশের মধ্যকার প্রতিযোগিতা শীতল যুদ্ধের মতো ধ্বংসাত্মক হবে না। ট্রাম্প যুদ্ধ এড়িয়ে দেশীয় সংস্কারের দিকে মনোযোগ দিতে চান।
আর এসব কারণে চীনের নেতারা ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে আগমনে ভীত নন।
কৌশলী চীন
বেইজিং বিশ্বাস করে, ২০২৫ সালে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে বড় কোনও পরিবর্তন আসবে না। হোয়াইট হাউসে যিনিই আসুন না কেন, তিনি চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে দেশটিকে আটকানোর চেষ্টা করবেন।
অবশ্য প্রতিটি প্রশাসনের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে চীনবিষয়ক নীতি শুধু বাইডেনের নীতির চেয়ে আলাদা হবে না, বরং তার নিজের প্রথম মেয়াদের নীতির থেকেও ভিন্ন হবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ট্রাম্প পররাষ্ট্র নীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ডানপন্থী চরমপন্থীদের নিয়োগ দিয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের বয়স ৫০ বছরের কম। এটি ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর তার নির্বাচিত সিনিয়র কর্মকর্তাদের থেকে একেবারে ভিন্ন।
ট্রাম্পের আগের কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। তারা শীতল যুদ্ধের শেষদিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারত্বের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ ছিলেন। তবে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা চীনের দ্রুত উত্থানের সময়ে বড় হয়েছেন। তারা চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান হুমকি হিসেবে দেখেন এবং চীনের অগ্রগতি থামাতে আরও কঠোর নীতি গ্রহণে প্রস্তুত।
পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন কঠোর নীতি কাজে নাও লাগতে পারে। ২০১৭ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর অনেক দেশ মনে করেছিল, তিনি একজন সাধারণ নেতার মতো কাজ করবেন। অর্থাৎ আদর্শগতভাবে নিরপেক্ষ ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোও আশা করেছিল, ট্রাম্প তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেবেন। বেইজিং প্রথম বছরে ট্রাম্পকে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানায়। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিগ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও, ক্রেমলিন ২০১৭ সালে ট্রাম্পকে মস্কোতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের বার্ষিকী উপলক্ষে আমন্ত্রণ জানায়।
এবার বিশ্বনেতারা তাদের দেশকে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করতে চান। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ ডিসেম্বরের শুরুতে ট্রাম্পকে প্যারিসে আমন্ত্রণ জানিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, ইউরোপীয়রা তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে মূল সিদ্ধান্ত নেবে।
জার্মানি ও জাপানও চিন্তিত। কারণ ট্রাম্প ওই দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আরও অর্থ দাবি করতে পারেন। দক্ষিণ কোরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার ভয় পাচ্ছে। ট্রাম্প দেশটির সীমিত ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করতে পারেন।
ট্রাম্পকে এখন এই বাস্তবতা মোকাবেলা করতে হবে যে, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধে একে অপরের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছে। গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস অভিযানকে সমর্থন করায় যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সমর্থনের মধ্যে দ্বৈততা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্প ৮ বছর আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা পরিচালনায় আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে। এই প্রতিযোগিতার শুরু মূলত ২০১০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ‘এশিয়ার দিকে মনোযোগ’ নীতি গ্রহণ করেন।
পরবর্তী বছরগুলোতে বেইজিং ওবামা, ট্রাম্প ও বাইডেন প্রশাসনের বিভিন্ন কৌশল সামাল দিয়েছে। ওবামা ও বাইডেন চীনের ওপর বৈশ্বিকভাবে চাপ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প এককভাবে কাজ করেছেন। এই অভিজ্ঞতার ফলে চীনের নেতারা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ নিয়ে চিন্তিত নন। উল্টো তারা গত নভেম্বরে ট্রাম্পের সম্ভাব্য নীতির জন্য কৌশলগত নির্দেশনা প্রকাশও করেছেন।
নভেম্বরের ১৭ তারিখে লস অ্যাঞ্জেলেসে চীনের কনস্যুলেট জেনারেল প্রকাশিত নথি অনুযায়ী, বেইজিং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পরিচালনায় ‘পারস্পরিক সম্মান, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতা’র নীতি অনুসরণ করবে।
এক্ষেত্রে ‘পারস্পরিক সম্মান’ মানে হলো, চীন ট্রাম্পের যেকোনো প্ররোচনামূলক পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া জানাবে। ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ মানে, চীন ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পার্থক্য ও বিরোধ সমাধানের চেষ্টা করবে, যাতে দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল থাকে। আর ‘পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতা’ মানে হলো, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একত্রে কিছু বৈশ্বিক ইস্যুতে কাজ করবে। যেমন ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য নীতিমালা তৈরি করা এবং অবৈধ মাদকের প্রবাহ রোধ করা।
অস্থিরতা
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থনৈতিক সুরক্ষা নীতি অনুসরণ করতে চান, বিশেষত চীন নিয়ে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, চীনা পণ্যগুলোর ওপর আরও শুল্ক আরোপ করা হতে পারে। এছাড়া চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগে এবং দেশটির শেয়ারবাজারে চীনকে আরও কোণঠাসা করতে পারেন। প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ওপর নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা চীনা ছাত্রদের সংখ্যা কমাতে পারেন।
এসব সিদ্ধান্ত বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে আরও সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে। বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক বজায় রেখেছে। তবে চীনকে প্রযুক্তিগত সরবরাহ চেইন থেকে বাদ দিতে চাইলেও, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুরোপুরি আলাদা করার চেষ্টা করেনি।
বাইডেনের আমলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অন্যান্য খাতে বাণিজ্য চালু ছিল। আধুনিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অবশ্য সহযোগিতা থেমে যায়। তবে এবার ট্রাম্প আরও শক্তিশালীভাবে দুই দেশের অর্থনীতি আলাদা করার চেষ্টা করবেন এবং চীনা পণ্যের মার্কেট শেয়ার যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে কমাতে চাইবেন। এর মধ্যে এমন পণ্যও থাকবে যা চীন ছাড়া অন্য কোথাও তৈরি হলেও তা চীনা বিনিয়োগ ও উপকরণের ওপর নির্ভরশীল।
বেইজিং সম্ভবত প্রতিক্রিয়া জানাবে। এই পাল্টাপাল্টি পরিস্থিতি দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। এতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। কারণ অনেক দেশ নিজেদের সুরক্ষামূলক নীতি গ্রহণের চেষ্টা করবে।
ট্রাম্প প্রশাসন বেইজিংয়ের ওপর সামরিক চাপ বাড়াতে পারে। বিরোধীদের মোকাবেলা করার সময় ট্রাম্প সাধারণত ভীতি দেখানো ও ভান করা কৌশল ব্যবহার করেন। যেমনটা তিনি ২০১৭ সালে পিয়ংইয়ং মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পর উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণের হুমকি দিয়েছিলেন।
ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রার্থী মার্কো রুবিও, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রার্থী পিট হেগসেথ উভয়েই চীনের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব পোষণ করেন। দুইজনেই মূলত কমিউনিজম বিরোধী বিশ্বাসে বিশ্বাসী। সেনেট তাদের মনোনয়ন অনুমোদন করলে তারা ট্রাম্পকে চীনের সঙ্গে সামরিক উত্তেজনা বাড়াতে উস্কে দিতে পারেন। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ান ইস্যুতে।
বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সরকারি সংলাপের উপর প্রভাব পড়বে। ওবামা প্রশাসনের অধীনে, দুই সরকারের মধ্যে ৯০টিরও বেশি সরকারি সংলাপ চ্যানেল ছিল। তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শেষে, কোনও চ্যানেলই ছিল না। ট্রাম্প সম্ভবত বাইডেন প্রশাসনের অধীনে চীন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ২০টির কাছাকাছি চ্যানেল বন্ধ করে দেবেন এবং সেগুলোর পরিবর্তে নতুন চ্যানেল চালু করবেন। আর এগুলো তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে থাকবে, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নয়।
তবে চীন ট্রাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় খুব সতর্ক থাকবে। কারণ তারা এখনও মনে রেখেছে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ট্রাম্পের বেইজিং সফরটি পরবর্তী মাসে কীভাবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটিয়েছিল। তখন ওয়াশিংটন চীনের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অস্বীকার করেছিল বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায়।
উভয় দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায় ছাড়াও, সামাজিক স্তরেও বৈরিতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ উভয় দেশেই পপুলিজম শক্তি বাড়াচ্ছে। এতে বাড়ছে জাতীয়তাবাদী মনোভাব। ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি বাস্তবায়ন করলে তা দুই দেশের জনগণের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করবে। আমেরিকান ও চীনা পপুলিস্টরা তাদের দেশীয় সমস্যা বিদেশি শত্রুতার কারণ হিসেবে মনে করে।
উভয় দেশের মধ্যকার দূরত্ব
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ চীনের জন্য কিছু সুবিধা এনে দিতে পারে। প্রথমত, ট্রাম্পের রাজনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি কম আগ্রহ চীনের সঙ্গে বিরোধের কিছু কঠিন দিক মসৃণ করতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাম্প কখনও মানবাধিকার নিয়ে বেশি চিন্তা করেননি। তিনি চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পশ্চিমা ব্যবস্থার সঙ্গে মেলানোর বিষয়ে আগ্রহী নন। তাই চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ইচ্ছা নেই।
বেইজিংও আন্তর্জাতিকভাবে তার আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা করছে না। বরং চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ঘরোয়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মনোযোগী। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সংঘর্ষ বাড়তে পারে, তবে তা আদর্শগত সংঘর্ষে রূপ নেবে না, যা দুই দেশের সরাসরি সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাবে।
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক সুরক্ষাবাদী মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রকে তার ঐতিহ্যগত মিত্রদের সুরক্ষা প্রদানে বিনিয়োগ কমাতে প্ররোচিত করতে পারে। ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সমালোচনা করেছেন যারা যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও দানে ভর করে এসেছে। এই অভিযোগগুলো ইউরোপীয় এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার গুরুত্ব বোঝাতে সহায়তা করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুরের বিষয়টি বলা যেতে পারে। ২০১০ সালে যখন ইউএস-চীনের প্রতিযোগিতা বাড়ছিল, সিঙ্গাপুর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কৌশল গ্রহণ করে। এটি চীনের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করে। তবে নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকে। অনেক অন্যান্য দেশও এই পথ অনুসরণ করেছে, যেমন জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলো।
২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের যুদ্ধ অনেক পশ্চিমা দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। তবে ট্রাম্প ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা কমিয়ে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা কমে যেতে পারে। ইউক্রেনের যুদ্ধে সহায়তার জন্য নিজেদের অর্থনীতি শক্তিশালী করার চেষ্টা করতে গিয়ে, ইউরোপীয় দেশগুলো চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াতে পারে।
ট্রাম্প নিজেকে একজন শান্তির রূপকার হিসেবে দেখেন এবং তিনি বলতে চান যে, তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করেছেন। চীন এই লক্ষ্য অর্জনে ট্রাম্পকে সাহায্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেহেতু যুদ্ধ চীনের অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক, তাই বেইজিং এর শেষ দেখতে চায়। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করে কার্যকর শান্তি চুক্তি খুঁজে বের করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ট্রাম্প চীনের সাথে স্পষ্ট সংঘর্ষ এড়াতে চাইবেন, তার কঠোর ভাষণ সত্ত্বেও। তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিষয়টি চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের কারণ হয়ে থাকবে, তবে এ কারণে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। পরবর্তী চার বছরে, বেইজিং তাইওয়ানকে পুনঃএকত্রীকরণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করবে না। কারণ তাদের মূল লক্ষ্য এখন নিজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।
ট্রাম্প নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে মহান প্রেসিডেন্টদের একজন হিসেবে ইতিহাসে রাখতে চান। এজন্য তিনি অভ্যন্তরীণ সংস্কার ও শক্তিশালী অর্থনীতি গঠনে মনোনিবেশ করবেন। তিনি তাইওয়ানের বিষয় নিয়ে কোনও সংঘর্ষে জড়াতে চান না এবং বড় শক্তির মধ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চান না। কারণ তিনি তার প্রথম মেয়াদে কোনও যুদ্ধ শুরু না করার জন্য গর্বিত।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা আদর্শের উপর নয়, প্রযুক্তির উপর। ডিজিটাল যুগে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি প্রযুক্তিগত উন্নতির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। চীন-যুক্তরাষ্ট্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বাজার এবং উচ্চ প্রযুক্তির সরবরাহ শৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে। তারা অন্যদের নিজেদের শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য করবে না, বিশেষত ট্রাম্পের সময় এটি সম্ভব নয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে কমিউনিজম ও পুঁজিবাদের বিস্তার হয়েছিল। বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ এখনও এসব যুদ্ধের কারণে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের প্রভাব অনুভব করছে। তবে আজকের দিনে বড় শক্তির মধ্যে পরোক্ষ যুদ্ধের কোনও উদ্দেশ্য নেই।
বেইজিং অন্য কোনও দেশের আদর্শ পরিবর্তন করতে আগ্রহী নয়। তেমনি ট্রাম্পও আমেরিকান মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী নন। তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি পরোক্ষ যুদ্ধ দেখেন এবং সেটিকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তাই তাইওয়ান প্রণালী বা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে পরোক্ষ যুদ্ধ উসকে দেওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি।
মহাশক্তির প্রতিযোগিতায় পররাষ্ট্রনীতি অনেক সময় অভ্যন্তরীণ নীতির তুলনায় গুরুত্ব হারায়। ট্রাম্পের একত্রীকরণবাদী নীতি যদি বেইজিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার সুযোগ তৈরি করে, তবে অভ্যন্তরীণ সংস্কারগুলোই দুই শক্তির প্রতিযোগিতার দিক নির্ধারণ করবে।
বর্তমানে চীনা নেতারা এবং ট্রাম্পের টিম বিদেশী বিষয়গুলোর চেয়ে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বেশি মনোযোগী। চীনা নেতারা আগামী চার বছরে ট্রাম্পের চেয়ে ভালো সংস্কার করতে পারলে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তির ব্যবধান কমিয়ে ফেলবে। কিন্তু ট্রাম্প চীনের চেয়ে এই ক্ষেত্রে ভালো করলে দুই দেশের মধ্যে শক্তির ব্যবধান আরও বাড়বে।