Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

চীনের ব্যবসায়ীরা কেন বিশ্বজুড়ে নতুন ক্রেতার খোঁজে

China Fabrics
[publishpress_authors_box]

চীনের একটি টেক্সটাইল কোম্পানির মালিক ওয়াং চেংপেই। তার কোম্পানির নাম সুজু ফেইমোসি টেক্সটাইল টেকনোলজি। কোম্পানিটি পলিয়েস্টার ও নাইলনের কাপড় তৈরি করে। খেলাধুলার পোশাক বানায় এমন পোশাক প্রস্তুতকারকদের কাছে এসব কাপড় বিক্রি করা হয়।

চেংপেইয়ের কোম্পানির প্রায় ৩০ শতাংশ আয় আসত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তৈরি অর্ডার থেকে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের চীনা পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের কারণে তার ক্রেতাদের অর্ডারের এক-তৃতীয়াংশ স্থগিত হয়েছে। তাই তিনি নতুন বাজার খুঁজছেন।

তিনি এই কারণেই ইন্দোনেশিয়ায় এসেছেন। তিনি আশা করছেন, এখানে স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।

ওয়াং বলেন, “আমরা এখানে এসেছি দেখতে, নতুন বাজার খুলতে পারি কি না এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ক্ষতিপূরণ করতে পারি কি না।”

এই মাসে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় একটি টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট মেলায় তিনি অংশ নেন। সেখানে তিনি রঙিন নকশার কিছু কাপড়ের নমুনা দেখান। এসব কাপড় আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রতিরোধ করতে পারে।

ওয়াং আশা করছেন, ইন্দোনেশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার উপযোগী পোশাক তৈরির জন্য স্থানীয় নির্মাতাদের কাছে এসব কাপড় আকর্ষণীয় হবে।

এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে চীনা প্রস্তুতকারকরা বিশ্বজুড়ে নতুন বাজার খুঁজছেন, যেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তৈরি পণ্য বিক্রি করতে পারবেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের বিকল্প খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। চীনের কাস্টমস এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ছিল চীনের পণ্যের সবচেয়ে বড় একক ক্রেতা দেশ। চীন তার মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেছিল।

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা খুব বেশি।

গোল্ডম্যান স্যাক্সসের হিসাবে, এই পরিস্থিতিতে চীনের ১ কোটি থেকে ২ কোটি চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব চাকরি মূলত আমেরিকার ভোক্তাদের জন্য পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত।

এছাড়া বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যও এই অবস্থার ওপর নির্ভর করছে।

চীনের অনেক প্রস্তুতকারকের জন্য এখন নতুন বিদেশি বাজার খোঁজা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। কারণ দেশীয় বাজারে তারা তীব্র প্রতিযোগিতা ও মন্দা অর্থনীতির মুখোমুখি।

চীনের নেতারা বলছেন, তারা অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি ও শুল্কের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোকে সহায়তা করার পরিকল্পনা করেছেন। কিছু ই-কমার্স কোম্পানি, যেমন জেডি.কম রপ্তানিকারকদের স্থানীয় বাজারের দিকে স্থানান্তর করতে সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে।

কিন্তু চীনে পরিবারের ও ব্যবসার পক্ষ থেকে চাহিদা দুর্বল। বিশাল আকারের সম্পত্তি বাজার ধস এবং ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পর চীনারা এখন বেশি সঞ্চয় করছে, খরচ করছে কম।

ভোক্তামূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ফ্যাক্টরি-গেট মূল্য কমছে। আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। এসবই দেখায়, চীনে দেশীয় ভোক্তা ব্যয় কতটা দুর্বল।

উজিয়াং সিটি হংইউয়ান টেক্সটাইলের প্রতিনিধি কিয়ান শিচাও বলেন, তিনি প্রথমবার ইন্দোনেশিয়ায় এই মেলায় এসেছেন। কারণ চীনের দেশীয় বাজার এখন খুব কঠিন অবস্থায় রয়েছে। সেখানে কারখানাগুলো অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদন করছে। ফলে দাম কমানোর জন্য প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এবং লাভ অনেক কমে গেছে।

কিয়ান বলেন, “খোলামেলা বললে, ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, আমাদের যা করার তা হলো বাইরে গিয়ে নতুন সুযোগ খোঁজা।”

মিউনিখভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা কোম্পানি আলিয়েঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়া—এই দেশগুলোই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য আগে তৈরি হওয়া চীনা রপ্তানি পণ্য গ্রহণ করবে।

আলিয়েঞ্জ ধারণা করছে, আগামী তিন বছরে এই দেশগুলোর বাজারে চীনের রপ্তানি প্রতিবছর প্রায় ৬ শতাংশ বাড়তে পারে।

জাকার্তায় অনুষ্ঠিত টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্পের মেলাটি ইন্দোনেশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মেলা। সেখানে প্রদর্শনীর ডিরেক্টরিতে চীনা প্রদর্শকদের সংখ্যা স্থানীয় নির্মাতাদের তুলনায় দুই গুণেরও বেশি ছিল। প্রায় ৪০০টি চীনা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেখানে প্রদর্শক হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিল। তাদের অনেকেই বলেছে, এটি তাদের ইন্দোনেশিয়ায় প্রথম অংশগ্রহণ।

যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর চাপ পড়ায় চীনের যেসব প্রস্তুতকারক কাপড়, সুতা, রেশমি সুতা এবং অন্যান্য টেক্সটাইল সামগ্রী তৈরি করে, তারাও সমস্যায় পড়েছে। জাকার্তা মেলায় অংশ নেওয়া কিছু চীনা কারখানা মালিক বলেছেন, তারা ইতোমধ্যেই কিছু উৎপাদন স্থগিত করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরও কম অর্ডারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।

এখন তারা নতুন ক্রেতা খুঁজছেন। ইন্দোনেশিয়ার রয়েছে শক্তিশালী উৎপাদন খাত এবং প্রায় ২৮ কোটি জনসংখ্যার বিশাল ভোক্তা বাজার রয়েছে। চীনা ব্যবসায়ীদের কাছে দেশটি সম্ভাবনাময় বাজার বলে মনে হচ্ছে।

চীনা প্রদর্শকরা ইন্দোনেশিয়ার টেক্সটাইল প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে ব্যবসা বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির সুযোগও নিতে পারে। কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত নীতিতে ইন্দোনেশিয়ার পণ্যের ওপর ৩২ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়েছে, যা চীনের পণ্যের তুলনায় কম।

ইন্দোনেশিয়ার পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফ্যাব্রিকুর সেলস ও মার্কেটিং প্রধান মার্টিন সুতান্তো জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের এজেন্টদের কাছ থেকে আগ্রহের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া লক্ষ্য করেছেন।

তবে কিছু প্রস্তুতকারক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর করা খুব সহজ হবে না।

মেলায় দেখা গেছে, চীনা প্রস্তুতকারকদের অনেক বুথে ভিড় ছিল কম। তুলনামূলকভাবে ইন্দোনেশিয়ার প্রদর্শকদের বুথে ভিড় ছিল বেশি। চীনা অনেক বিক্রয়কর্মী তাদের ফোনে ব্যস্ত ছিলেন। কারণ খুব কম সংখ্যক দর্শক তাদের পণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

চীনা প্রদর্শক বাওজি চাংশিন ক্লথ মেলায় তুলা ও পলিয়েস্টারের কাপড়ের নমুনা দেখিয়েছিল। তবে ইন্দোনেশিয়ার আবহাওয়ার জন্য এসব কাপড় বিক্রি করা কঠিন হতে পারে।

কোম্পানির ব্যবস্থাপক শি ইয়্যা বলেন, এটি তার প্রথমবার ইন্দোনেশিয়ায় আসা। তিনি লক্ষ্য করেছেন, স্থানীয় ক্রেতারা মসৃণ ধরনের কাপড় বেশি পছন্দ করেন।

তিনি বলেন, “আমাদের পণ্য হয়তো এই বাজারের সঙ্গে ভালোভাবে মানানসই নয়।”

অনেক প্রস্তুতকারক বলেছেন, তারা এখন বড় ধরনের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।

কিছু প্রস্তুতকারক ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের বাজার নিয়েও ভাবছেন।

শাওশিং ডাবল-কালার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপক মাইকেল ওয়াং বলেন, “শুল্ক নিয়ে আমরা কিছুই করতে পারি না। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না শুল্কের অবস্থা স্থিতিশীল হয়। না হলে ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করা যাবে না।”

ইন্দোনেশিয়ার পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফ্যাব্রিকুর নির্বাহী প্রধান সুতান্তো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেন, চীনা প্রস্তুতকারকরা ইন্দোনেশিয়া বাজারে সস্তায় পণ্য দিলে স্থানীয় প্রস্তুতকারকদের জন্য প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, “চীনের পণ্য ইন্দোনেশিয়ার বাজার প্লাবিত করলে সেটা আমাদের জন্য কঠিন হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত