Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

নভেম্বরেও কেন কমল না ডেঙ্গুর প্রকোপ

চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

ডেঙ্গু এখন আর কেবল শহরের না, সারাদেশের সব মৌসুমের রোগ। প্রথম ডেঙ্গু শনাক্তের পর গত ২৩ বছরে মধ্যে গত বছর বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ভয়াবহতা দেখেছে। এরপরও তেমন পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভুগছে মানুষ, হচ্ছে মৃত্যু।  

অব্যবস্থাপনার কারণে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তবে নভেম্বরে বছরের কোনও একক মাসে সর্বাধিক মৃত্যু দেখেছে দেশ। 

নভেম্বরের শেষদিন (৩০ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে নভেম্বরে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৭৩ জনের, যা একক মাস হিসাবে বছরে সর্বাধিক। আর চলতি বছরে মোট মৃত্যু হলো ৪৮৮ জনের। অক্টোবরে মৃত্যু হয়েছিল ১৩৫ জনের।  

শুক্রবার সকাল ৮টার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরও ৬৭৫ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হলো ৯১ হাজার ৪৬৯ জন। আর নভেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি হয় ২৯ হাজার ৬৫২ জন। গত অক্টোবরে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩০ হাজার ৮৭৯ জন।

দেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়, হিসাব রাখা শুরু করে সরকার। যদিও এর আগেও ছিল মশাবাহিত এই অসুখ, তবে নাম ছিল ভিন্ন। দেশ ডেঙ্গুর সবচেয়ে ভয়াবহতা দেখে ২০২৩ সালে।

২০২৩ সালে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে মে মাসের মাঝামাঝিতে এসে; জুন থেকে বিস্তার শুরু করে আগের ২২ বছরের হিসাব ছাড়িয়ে যায়। বিলম্বিত বর্ষায় প্রাদুর্ভাব বাড়ে, ছড়ায় সব জেলায়। গত বছর শেষে দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক রোগী ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন শনাক্ত হয়, মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।

সরকারি তথ্য বলছে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৮৪৯ জনের, আর শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো।

এসব হিসাবে সব রোগী নেই, কারণ হাসপাতালে যারা আসেন না, তারা এই হিসাবে নেই।

চলতি বছরের শুরুতে দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল, কম ছিল মৃত্যুও। তবে বছরের মাঝামাঝিতে অর্থাৎ জুলাই মাসে রোগী বাড়তে থাকে; মাস শেষে ছাড়িয়ে যায় ২ হাজারের ঘর। জুলাইয়ে হাসপাতলে ভর্তি হয় ২ হাজার ৬৬৯ জন, মারা যায় ১২ জন।

এরপর আগস্টে রোগী কয়েকগুণ বাড়ে। ভর্তি হয় ৬ হাজার ৫২১ জন, মারা যায় ২৭ জন। কিন্তু সেপ্টেম্বরে এসে এ সংখ্যা বাড়তে থাকে; এ মাসে রোগী ভর্তি হয় ১৮ হাজার ৯৭ জন, মৃত্যু হয় ৮৭ জনের। অক্টোবরে রোগী ভর্তি হয় ৩০ হাজার ৮৭৯ জন ও মৃত্যু হয় ১৩৫ জনের। আর নভেম্বর শেষে রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৬৫২ জন ও মৃত্যু ১৭৩ জনের।

চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৪৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ নভেম্বর নাগাদ ডেঙ্গু মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।

মশা নিধনে এমন ফগিং দেখা যাচ্ছে কম, অভিযোগ ঢাকাবাসীর।

কেন নভেম্বরেও প্রকোপ বেশি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয় বর্ষা মৌসুমে। সে হিসাবে মে মাস থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর, খুব বেশি হলে অক্টোবর- এই সময়কাল এইডিস মশার বংশ বৃদ্ধি ও প্রজনন কাল। তাই ডেঙ্গুর পিক টাইমও এটিই। কিন্তু চলতি বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলেছে নভেম্বর পর্যন্ত এবং এ মাসেই সর্বাধিক মৃত্যু দেখেছে দেশ। আর এর কারণ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ সমন্বিত কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাসার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা পিছিয়ে ছিলাম। পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি; প্রশাসনে যথেষ্ঠ ঘাটতি ছিল; সদিচ্ছ্বার অভাব ছিল। তাতে করে মশা নিয়ন্ত্রণে যাদের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল…তাদের আমরা পাইনি। আর এ কারণে সঠিক পদক্ষেপ ছিল না, মশা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে, বেড়েছে রোগী।

“আর রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যু। তবে এর সঙ্গে আরও যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। তবে হয়তো ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে প্রকোপটা এমন থাকবে না, কমে আসবে বলেই আশা করছি।”

কবিরুল বাসারের কথার সত্যতা মেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রমের দিকে তাকালেই।

অধিদপ্তর প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রকোপ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে দুইবার জরিপ করে থাকে। কিন্তু এবার অধিদপ্তরের অচলাবস্থার কারণে ডেঙ্গু মৌসুম জরিপ করা হয়নি; ফলে পরিস্থিতিও অজানা।

এইডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মশার বিস্তার বোঝার জন্য এই সূচকে জরিপ চালিয়ে থাকে। জরিপে প্রতি ১০০ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে মশার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক কবিরুল বাসার বলেন, “এবার ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি ছিল।”

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সূত্র সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ব্রুটো ইনডেক্স কোথাও কোথাও ৯০ এরও বেশি ছিল।

কিন্তু এর বিপরীতে কোনও ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। যার ফলে ভয়ংকর অক্টোবর পার হয়ে নভেম্বরেও সর্বাধিক মৃত্যু হলো। অথচ সাধারণত নভেম্বরে প্রকোপ কমে আসার কথা।

গত মে মাসে ব্রুটো ইনডেক্সের ফলের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল ২০২৩ সালে। গত বছরের নভেম্বরে রোগী ছিল ৪০ হাজার ৭১৬ জন ও মৃত্যু হয় ২৭৪ জনের। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের নভেম্বরে রোগী ছিল ১৯ হাজার ৩৩৪ জন ও মৃত্যু হয় ১১৩ জনের।

আর চলতি বছরের নভেম্বরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৯ হাজার ৬৫২ জন ও মৃত্যু হয়েছে ১৭৩ জনের। এই সংখ্যা উদ্বেগ বাড়িয়েছে।

ডেনভি-২ এ আক্রান্ত বেশি

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছে, ডেঙ্গুর ধরন চারটি। ডেনভি-১, ডেনভি-২, ডেনভি-৩ ও ডেনভি-৪। কেউ ডেঙ্গুর একটি ধরনের মাধ্যমে যদি সংক্রমিত হয়, তাহলে তিনি আর সেই একই ধরনে আক্রান্ত হবে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অন্য ধরনে আক্রান্ত হবেন। আর তখনই সেটা গুরুতর হয়ে ওঠে।

রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একজন মানুষ মোট চারবারের ডেঙ্গু ঝুঁকিতে থাকেন। কিন্তু সে যখন একেকবার একেক ধরনের মাধ্যমে সংক্রমিত হন, তখনই তার জটিলতা বাড়ে, অবস্থা হয় গুরুতর আর বাড়ে মৃত্যুঝুঁকি। আর সেই মানুষটি যখন গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ হন, তখন তার ঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েকগুণ বেশি।”

একই ধরনে কেন কেউ একাধিকবার সংক্রমিত হন না—এ প্রশ্নের জবাবে মহামারী বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলেন, “একবার এক ধরনের মাধ্যমে আক্রান্ত হলে তখন সেই ধরনের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে অ্যান্ডিবডি (প্রতিরোধ ব্যবস্থা) গড়ে ওঠে; যার কারণে তখন তিনি অন্য ধরনে আক্রান্ত হন।”

চলতি বছর মানুষ কোন ধরনে বেশি আক্রান্ত হয়েছে—জানতে চাইলে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এবারে আমরা ডেনভি-২ এর প্রকোপ বেশি দেখতে পাচ্ছি।

“প্রায় ৭০ শতাংশই ডেনভি-২। বাকিদের মধ্যে ৩ ও ৪ ধরনে আক্রান্ত হচ্ছেন যথাক্রমে ২০ আর ৯ শতাংশ মানুষ। আর বাকি ১ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে ডেনভি-১ দিয়ে।”

তবে অধ্যাপক কবিরুল বাসারের মতো আইইডিসিআর পরিচালক তাহমিনা শিরীনও মনে করেন, ডিসেম্বর নাগাদ ডেঙ্গু কমে আসবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত