জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং আন্দোলন ও কমিউনিটি সেবায় শিক্ষার্থী-তরুণীসহ নানা স্তরের নারীদের অনুপ্রেরণাদায়ী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে ‘‘নারী শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের যে নতুন ছবি আঁকলেন’’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছিলাম এ মাসেই (সকাল সন্ধ্যা, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)। কিন্তু ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের যে আশা জেগে উঠেছিল অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী জনপরিসরে নারীদের ওপর একের পর এক হামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন-হেনস্তার ঘটনায় আশার বদলে উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, অভ্যুত্থানের পর নারী হেনস্তার পর পর কয়েকটি ঘটনার ধরণ দেখে মনে হয়েছে, সমাজে নারীদের স্বাভাবিক চলাফেরায় ভীতি সঞ্চার করতেই ঘটনোগুলো ঘটানো হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হয় কক্সবাজার সৈকতে কয়েকজন নারী পর্যটককে হেনস্তার ঘটনা। ফেইসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ফারুকুল নামে এক ব্যক্তির নেতৃত্বে একদল উৎসাহী মানুষ এক নারীকে কান ধরিয়ে ওঠ-বস করাচ্ছে। কাঠের তক্তা হাতে ওই নারীকে হুমকি দিচ্ছেন ফারুকুল। আরেকটি ভিডিওতেও কাঠের তক্তা হাতে ফারুকুলকে দেখা যায় দলবল নিয়ে সৈকতে রাতে বিচ চেয়ারে বসা এক নারীকে হেনস্তা করতে। আরেকটি ভিডিওতে এক নারীকে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হাতজোড় করে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের কাছে তার মোবাইল ফোন চাইতে দেখা যায়। ওই নারীকে ঘিরে রাখা দলেও ফারুকুল ছিলেন। ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, নারী হেনস্তাকারী ফারুকুল নিজের ফেইসবুকে এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়ে এমন অভিযান চালাতেন। এক পোস্টে ফারুকুল লেখেন— ‘‘আজ অফিস টাইম শেষ করে আবার শুরু করবো, বেহায়াপনার বিরুদ্ধে, ইনশাআল্লাহ।”
গত ১১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সৈকতে নারী হেনস্তার ঘটনাগুলি বেশি আলোচিত হলেও সেখানেই শেষ নয়। এর দশ দিন পর রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিতে ফুটওভারব্রিজ পার হওয়ার সময় হামলার শিকার হয়েছেন পর্বতারোহী শায়লা বিথী। ২১ সেপ্টেম্বর দিনে-দুপুরে ঢাকার ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে ফুটওভার ব্রিজে হামলার ওই ঘটনা ঘটে। খেয়াল করা দরকার, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসা এমন ঘটনাগুলো বেশি আলোচিত হলেও এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও অনেক নারীই পথে-ঘাটে হেনস্তার শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং ভীতির কথাও লিখেছেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এই ধরনের নারী নিপীড়নের ঘটনাগুলোর পাশাপাশি দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্করতম নারী নির্যাতন-সহিংসতার ঘটনাও নিয়মিতই ঘটছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে— গত ২৪ সেপ্টেম্বর পথ হারানো এক কিশোরী দু’দফায় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চট্টগ্রামে (সমকাল, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। গত ১৪ সেপ্টেম্বর তারিখ পাবনার সাঁথিয়ায় সাত বছরের এক শিশু ধর্ষিত হয়েছে (যুগান্তর সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪)। গত ৬ সেপ্টেম্বর রাত ৯ টার দিকে চলন্ত বাসে এক নারী চালক ও সহকারীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চট্টগ্রামে (প্রথম আলো সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪)। ভয়াবহতম বন্যার মধ্যে কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে (প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০২৪)।
এভাবে একটার পর একটা ঘটনার উল্লেখ করা যাবে। শেষ হবে না। শেষ হবে শুধু যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনি, আর তার পরিবার।
বৈষম্যবিরোধী সমাজ নির্মাণের পথে বাধা নারী নির্যাতন
বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষ সম্পর্ক বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায় সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নারী-পুরুষ সম্পর্ক বিশেষ করে নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, এবং নির্দিষ্ট করে যৌন নির্যাতন প্রচণ্ডতম একটি বাধা, যা একই সাথে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের ‘বৈষম্যবিরোধী সমাজ’ নির্মাণের পথে প্রতিবন্ধকতা।
মাত্রা, ধারা, স্থান, ধর্ষকের পরিচয়, ইত্যাদি সকল বৈশিষ্ট্যের বিবেচনার যৌন নির্যাতন আজ সত্যিকার অর্থেই মহামারীতে পরিণত হয়েছে। জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত মহামারী, এমনকি অতিমারীও একসময় হ্রাস পায়; কিন্তু যৌন সহিংসতা বাংলাদেশে কেবল বাড়ছে; নিয়ন্ত্রণহীন, মানবতাবর্জিত, ঘৃণ্য এবং জঘন্যহারে। এর গতি এবং পরিণতি এমন যে, এই মহামারী বাংলাদেশকে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে দিবে না। মনে রাখতে হবে প্রায় ১৭.৩৫ কোটি মানুষের দেশে ৮.৫ কোটিরও বেশি (নারী ১০০: পুরুষ ৯৬.৭৫) নারী।
এই মহামারী নিয়ে আগে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমি নিজেও কয়েকবার লিখেছি। সরকারের প্রধান হিসেবে দুই নারী যুগের পর যুগ দেশ শাসন করলেও যৌন নির্যাতন থেকে নারীদের আশানুরূপ মুক্তি আসেনি; যৌন নির্যাতন বন্ধে তেমন কড়া পদক্ষেপও দৃশ্যমান ছিল না। সরকারিভাবে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এবং সামাজিক প্রতিরোধ না আসলে এই মহামারীতে কেবল নারীই নিপীড়নের শিকার হয় না, দেশের সমূহ সম্ভাবনাকেও তা নস্যাৎ করে দেয়। নারীরা দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে ঘরের মধ্যে আটকে থাকা নারীও নিজ ঘরে নিরাপদ নয়।
আগের সরকারগুলো দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে; আমরা আশা করতে চাই— বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সফলতা দেখাবে। এটাও মনে রাখতে হবে বর্তমান যে সরকার, যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল এই অন্তর্বর্তী সরকার, সে আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীদের ব্যাপক ও সক্রিয় অবস্থান ছিল, ছিল সর্বস্তরের নারীদের অংশগ্রহণ ও সমর্থন। তাই এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা একান্তভাবে প্রত্যাশিত।
নারী নির্যাতনের অপ্রতিরোধ্য মহামারীতে বসবাস
দেশে বিরাজমান নারী নির্যাতন মহামারীর প্রতাপ এতটাই প্রকট যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতেও যৌন নির্যাতনের হার কমেনি; বরং সবাইকে অবাক করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তোয়াক্কা না করে, সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধকে অবজ্ঞা করে ক্রমবর্ধমান ছিল। তাই ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ১,৬২৭ জন নারী; ২০১৯ সালে যা ছিল ১,৪১৩ জন। পরিসংখ্যান বলে, এটা তার আগের চার বছর অপেক্ষা প্রায় ১০ গুণ (ইত্তেফাক, জানুয়ারি ১, ২০২২)। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে ৮১৮ শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, এবং ৯৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল, যদিও তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল এবং জনসাধারণের জায়গায় শিশুদের উপস্থিতি ছিল কম (নিউ এইজ, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। এই মহামারীর প্রকৃতি ও বিচার প্রক্রিয়া বলে দেয় যেভাবে এর প্রাদুর্ভাব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে তা সমাজকে পুরোপুরি পঙ্গু না করা অব্ধি চলতেই থাকবে, যদি না অনতিবিলম্বে শক্তভাবে এর লাগাম টেনে ধরা হয়। তবে এ জাতীয় কোনও প্রতিরোধমূলক কার্যকম বা লক্ষ্মণ অদ্যাবধি পরিদৃষ্ট নয়।
যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টি কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কিত নয়; এর সাথে মনোজাগতিক চিন্তাভাবনা, পুরুষতান্ত্রিক মনোবৃত্তি, পুঁজিবাদী দৃষ্টিকোণ, শোষণমূলক সমাজ, এবং সমাজে প্রচলিত ভোগবাদী ধ্যান-ধারণার সম্পর্ক বিদ্যমান। কেন নারী তার ভাই, বাবা, কিংবা সন্তানের মতো অন্য পুরুষের যৌন লালসার শিকার হবে? সমস্যাটি কেবল লালসার বিষয় নয়। কেন একজন পুরুষ তার ঘরে মা, বোন, স্ত্রী ও কন্যা থাকা সত্ত্বেও, একইরকম অন্য ঘরের মানুষদের ওপর হিংস্র হয়ে উঠেবে, নির্যাতন করবে; কেন মনে মানবিক বোধ বা পাপবোধ কাজ করে না, কেন তারা পরিণতি ভাবে না; কিংবা কিভাবে তারা নিশ্চিত থাকে যে তাদের কিছু হবে না— এ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেন নির্যাতনকারীরা ভাবে না, তারা যা করছে সে রকম পরিস্থিতি বিরাজ করলে তার নিজের মা, বোন বা কন্যাও শঙ্কা মুক্ত নয়। নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য হলেও তো অন্যের পরিবারের মানুষের নিরাপত্তা, তথা পুরো সমাজের নিরাপদ পরিবেশের আবশ্যকতা রয়েছে। নিজের ঘরের মানুষদের নিরাপত্তার জন্য ঘরের বাহিরকেও নিরাপদ রাখতে হবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মতো, যতক্ষণ না বাহির নিরাপদ, ততক্ষণ নিজের ঘরের আপনজনও নিরাপদ নয়।
নোয়াখালী, ফেনী বা সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার কথা যদি লজ্জায় স্মরণ করতে নাও চাই; কয়েকটি ঘটনা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কক্সবাজারে স্বামী-সন্তান নিয়ে বেড়াতে গিয়ে অপহরণের পর ধর্ষণের শিকার হয়েছেন একজন নারী (বিবিসি, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১)। খুলনায় ডাক্তার দেখতে এসে সিরিয়াল না পেয়ে রাতে হোটেলের একটি কক্ষে এক মা ও মেয়ে অবস্থান করছিল। গভীর রাতে গোয়েন্দা শাখার এক পুলিশ (এসআই) উক্ত কক্ষে প্রবেশ করে মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ করে; মেয়েকেও ধর্ষণের হুমকি দেয় (মানব জামিন, ৮ ডিসেম্বর ২০২১)। মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সৎপিতা দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক স্কুল ছাত্রী (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ জানুয়ারী ২০২২)। নারায়ণগঞ্জ বন্দরে চলন্ত বাসে দলবদ্ধ গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক তরুণী (সমকাল, ২০ ডিসেম্বর ২০২১); উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে চলন্ত বাসে তাকে ধর্ষণ করা হয় (সময়টিভি, ২০ ডিসেম্বর ২০২২)। বান্দরবানের লামায় দুই শিশুসন্তানকে ঘরে আটকে রেখে প্রবাসীর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রাতভর ধর্ষণ করা হয়েছে গত ২২ ডিসেম্বর ২০২১ (কালের কণ্ঠ, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১)। রাজধানীতে দিনের বেলায় চলন্ত বাসে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক নারী (ইত্তেফাক, জানুয়ারি ৭, ২০২২)। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চার দিন আটকে রেখে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এক কলেজ ছাত্রীকে পাওয়া গেছে (প্রথম আলো, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ )। গত ২৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগ হেলিপ্যাডের সামনে থেকে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে দুর্বৃত্তরা একটি অটোরিকশায় তুলে নেয়। পরে ছাত্রটিকে বেঁধে রেখে গোপালগঞ্জ জেলা স্কুলের নির্মাণাধীন একটি ভবনে কয়েকজন মিলে ছাত্রীটিকে ধর্ষণ করে (প্রথম আলো, ২৪ নভেম্বর ২০২২ )। প্রতিবন্ধী (সমকাল, ২৪ জানুয়ারি ২০২২), ৭৫/১০০ বছরের বৃদ্ধা বৃদ্ধা নারী (যুগান্তর, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১), পিতা কর্তৃক কন্যা (কালের কণ্ঠ, ৮ জুন, ২০১৯ ), এমনকি মৃত লাশও (যুগান্তর, ২১ নভেম্বর ২০২০) ধর্ষণের শিকার হয়! এগুলো লেখা বা পড়া দুই-ই সুস্থ মানুষের জন্য শাস্তিসম।
স্কুল, কলেজ, পরিবহন (বাস, ট্রেন), কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি স্থানে এ-জাতীয় ঘটনা অহরহ ঘটছে। কয়টাইবা পত্র-পত্রিকায় স্থান পায়। মামলা হয় তার চেয়ে ঢের কম। মামলা যা হয়; বিচার সম্পন্ন হয় তারচেয়েও আরও অনেক কম। মাঝে মাঝে আসামীও গ্রেফতার হয়; তবে কিছুদিন পর তারা বেরিয়েও আসে; বেরিয়ে এসে আবার যৌন নির্যাতন করে। গ্রেফতার হলেও শক্তি বা ক্ষমতার বলে কখনও কখনও অপরাধীরা নির্যাতনের শিকার বা তাদের পরিবারের সদস্য (যেমন, ভাই, বাবা) বা সংবাদকর্মীর উপর চড়াও হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে (২০২২ এর মধ্য জানুয়ারিতে) যেমন হুঙ্কার লক্ষ করা গেছে বরিশালে: ‘‘শোন, সারা জীবন জেলে থাকমু না। কী হইছে? তাতে এত নিউজ করার কী আছে? আমি জেল থেইকা বাইর হইয়্যা লই। ব্যাপারটা দেখমু আনে’’ (প্রথম আলো, জানুয়ারি ১৫, ২০২২)।
সমাজের সব শ্রেণির পুরুষই নারী নির্যাতনের ঘৃণ্য অপরাধে জড়িত
সমাজের সকল স্থানে, সকল খাতে; স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, থানা, নিজের ঘর, বাহির, সড়ক, কর্মক্ষেত্র সকল স্থানে নারীরা বিকৃত মানসিকতার পুরুষের যৌন লালসার শিকার হয়। নির্যাতনকারীদের পরিচয় যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখতে পাই, সমাজের সকল স্তর ও শ্রেণির পুরুষই এই ঘৃণ্য অপরাধের সাথে জড়িত। এমতাবস্থায় কেউ কাউকে ভয় পায় না, তোয়াক্কা করে না; সুযোগ পেলেই তারা নারী নির্যাতনের চেষ্টা করে, এবং ধর্ষণের সুযোগ খোঁজে, ফাঁদ পাতে এবং সুযোগ সৃষ্টি করে।
অথচ এ দেশে নারীর সার্বিক বিকাশের মাত্রা এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। নব্বই দশক থেকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ তথা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীদের অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়। বাংলাদেশে যখন কিনা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থান দীর্ঘদিনের, প্রতিদিন এমনকি করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ও সেখানে নারী নির্যাতনের, নির্দিষ্ট করে যৌন নির্যাতনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া ক্ষমতা ও প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক। এমন অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য নারী-পুরুষ সকলকে মতাদর্শ বদলের মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি, স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সম্প্রদায়, জনপ্রতিনিধি, ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে; খবরের কাগজগুলো এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নিয়মিত অপরাধীদের উপর সচিত্র সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন যেভাবে যৌন সহিংসতা সংঘটিত হচ্ছে; যারা এমন ঘৃণ্য ঘটনার সাথে যুক্ত তাদের ছবিসহ তথ্যাদি যদি কোনও সাময়িকীতে যেমন, ‘যৌন অপরাধ/নির্যাতন’ (মাসিক বা ত্রৈমাসিক) প্রকাশ করা যায়, তাহলে সারাদেশের মানুষ এসমস্ত ঘটনা ও অপরাধীদের সম্পর্কে জানতে পারবে; এবং সামাজিকভাবে তাদের বয়কট (চাকরি, বিয়ে, রাজনীতি) করার সুযোগ তৈরি হবে। পরিবারের কোনও সদস্য এ ধরনের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের সাথে যেন যুক্ত না হয় সে ব্যাপারে তখন পুরো পরিবার পরোক্ষভাবে বাধ্য হয়ে সজাগ ও সচেতন থাকবে।
সাময়িকীটি প্রকাশের ভার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নির্বাহ করতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, সচেতন ব্যক্তি, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সাবস্ক্রিপশন এর মাধ্যমেও এর ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে, তারা ক্ষমতা বা শক্তির কারণে হয়ত সরাসরি অবস্থান নিতে পারে না। যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ এই যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে, তাই তারা নিশ্চয়ই ৫০/১০০ টাকা দিয়ে সাময়িকীর গ্রাহক হয়ে এই মহামারীর বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন।
নারীদের নিষ্পেষিত-ভীতসন্ত্রস্ত রেখে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়
নারী বা যৌন নির্যাতন কেবল নারীর জন্য ক্ষতিকর তা নয়, নারীদের নিগৃহীত অবস্থায় রেখে, যৌন নির্যাতনের আতঙ্কের মধ্যে রেখে পুরুষরা তাদের মেধা ও প্রজ্ঞার যথাযথ ব্যবহার প্রয়োগ করতে পারবে না, অর্থাৎ সমাজে তাদের যথাবিহিত ভূমিকা পালন করতে তারা সক্ষম হবেন না। একজন নারীকে যদি সর্বক্ষণ তার শরীর নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকতে হয়, তার আশেপাশের পুরুষদের (কু)ভাবনা কী তাই নিয়ে ক্লাসরুমে, স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসার পথে, গার্মেন্টসে, অফিসে, রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে, নিকট আত্মীয়ের বাসায়, এমনকি আন্দোলনে; তবে সমাজে তাদের সক্ষমতার সাক্ষ্য রাখার সুযোগ কোথায়? এহেন পরিস্থিতিতে, নারী-পুরুষ সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে অবশ্যই এই যৌন নির্যাতন মহামারী থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিষ্পেষিত এবং সদা ভীতসন্ত্রস্ত রেখে কোনও সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের শঙ্কার মধ্যে রেখে বাকি অর্ধেকের পক্ষেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। তাই তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’’ নারী বৈষম্য ও যৌন নির্যাতন কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে তার একটি উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়কার একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে একজন নারীর ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে অতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কিছুদিন পর দেখা গেল কক্সবাজারে পর্যটকদের ভীড় অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কমে গেছে (দৈনিক আজাদী, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১)। করোনাভাইরাস মহামারী যেখানে পর্যটকদের ভিড় হ্রাস করতে পারেনি; সেখানে পর্যটক নারীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় আশঙ্কাজনকভাবে ভিড় কমেছে; ফলে হোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এভাবে সকল খাতে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর উন্নয়নমূলক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নারীর অবদান ও অংশগ্রহণ থেকে দেশ বঞ্চিত হবে; অথচ সবার জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলে দেশের উন্নয়ন কয়েকগুণ বেগবান হবে। এই সত্যটি উপলব্ধি করত সংশ্লিষ্ট সবার সজাগ ও সোচ্চার থাকা একান্ত প্রয়োজন।
পরিমাপযোগ্য কয়েকটি উন্নয়নসূচক দ্বারা নারীর এই অধঃস্তন অবস্থার অবসান সম্ভব নয়। ভাবাদর্শগত পরিবর্তন ও প্রয়োজন অনুযায়ী বাস্তবিক (কঠোর আইনগত অবস্থানসহ) পদক্ষেপ এক্ষেত্রে অপরিহার্য। এখনই সময় যথাযথ প্রতিকারের— কেবল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নয়, প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল অঙ্গের সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এ ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নারী নির্যাতন রোধ করতে পারেন, জাতি আজীবন তাদের স্মরণ রাখবে।
লেখক: অধ্যাপক ও প্রাক্তন সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: alactg@gmail.com