প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রধান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস (৮৯) তার উত্তরসুরি মনোনীত করেছেন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়ায় তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বুধবার এক ডিক্রি জারি করে ফিলিস্তিনের জাতীয় পরিষদের (পিএনসি) রুহি ফাত্তুহকে তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হিসাবে মনোনীত করেন।
রুহি ফাত্তুহ দীর্ঘদিন ধরেই মাহমুদ আব্বাসের রাজনৈতিক দল ফাতাহর সঙ্গে যুক্ত। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তী নেতা ইয়াসির আরাফাত।
ডিক্রি অনুযায়ী পিএনসি চেয়ারম্যান রুহি ফাত্তুহ অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। অন্তত ৯০ দিন পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে থাকবেন, যতক্ষণ না নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ইসরায়েলের গাজায় চলমান যুদ্ধে ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং অসংখ্য মানুষ আহত ও অনাহারে রয়েছে। এসব ঘটনায় মাহমুদ আব্বাসের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়ছিল।
২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর মাহমুদ আব্বাস ২০০৫ সালে পিএর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) কী
পিএ ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির অধীনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইৎঝাক রবিন এবং ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও পিএলওর মধ্যে এই অস্থায়ী শান্তি চুক্তি হয়। অসলো চুক্তির পর পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত এবং নির্বাসনে থাকা অন্যান্য ফিলিস্তিনিরা দেশে ফেরার অনুমতি পান।
অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার কিছু অংশের উপর সীমিত কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনের পুরো অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়েও নিয়ন্ত্রণ পায় ইসরায়েল।
চুক্তিতে আরও বলা হয়, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিরাপত্তা ইস্যুতে ইসরায়েলকে সহায়তা করতে হবে। ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যেকোনোও সশস্ত্র হামলা প্রতিরোধেও ইসরায়েলি নিরাপত্তাবাহিনীর পাশে দাঁড়াতে হবে।
পিএর মূল উদ্দেশ্য ছিল গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ, বিশেষ করে পূর্ব জেরুজালেমের মতো এলাকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের জন্য শিক্ষা, নিরাপত্তা, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো মৌলিক সেবা পরিচালনা করা।
অসলো চুক্তি অনুযায়ী, পশ্চিম তীরকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়— এলাকা এ, বি ও সি। পিএকে এলাকা এ-তে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং এলাকা বি-তে কেবল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়।
তবে, ইসরায়েল নিয়মিতভাবে পশ্চিম তীরের বিভিন্ন স্থানে সহিংস অভিযান চালায়। সমালোচকদের মতে, পিএ কার্যত ইসরায়েলি দখলদারিত্বের পক্ষে একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতো কাজ করে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ (পিএ) এখনো কেন সক্রিয়
অসলো চুক্তির লক্ষ্য ছিল ১৯৯৯ সালের মধ্যে গাজা এবং পশ্চিম তীরে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
তবে, চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরের মধ্যেই ইসরায়েল পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণ শুরু করে।
এরপর উগ্র-ডানপন্থী ইসরায়েলি জাতীয়তাবাদীর হাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইৎঝাক রবিনের হত্যাকাণ্ড পিএর নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমি ইসরায়েল ফেরত দেবে— এই প্রত্যাশাকে আরও অনিশ্চিত করে তোলে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও পিএ মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে কার্যক্রম চালিয়ে যায়। আব্বাসের মেয়াদ ২০০৯ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তিনি পদত্যাগ করেননি।
আব্বাস কেন এখনো পিএ প্রেসিডেন্ট
২০০৫ সালের আগস্টে ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ড থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এর আগে ১৯৬৭ সালে মিশরের কাছ থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর প্রায় ৩৮ বছর ইসরায়েল গাজা দখল করে রেখেছিল।
ইসরায়েল সেনা প্রত্যাহার করার পর সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ২০০৫ সালে হামাস গাজার স্থানীয় নির্বাচনে এবং পরের বছর জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয় পায়।
নির্বাচনে জয়ের পর হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন ইসরায়েল স্বীকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ফাতাহ নেতা মাহমুদ আব্বাস। কিন্তু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলো তাকে মেনে নেয়নি। কারণ হামাস ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না।
এদিকে পশ্চিমা দাতারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে হামাসকে বাধ্য করার জন্য ফিলিস্তিনে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়। তবে ইসরায়েল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানায়।
ইয়াসির আরাফাতের দল ফাতাহ’র সদস্যরাও হামাসকে শাসক দল হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। হামাস ও ফাতাহ নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের জুন মাসে গাজায় হামাস ও ফাতাহর মধ্যে সশস্ত্র লড়াই বাধে। এতে ফাতাহকে পরাজিত করে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস।
তখন থেকেই হামাস গাজা আর ফাতাহ অধিকৃত পশ্চিম তীরে সরকার চালাচ্ছে। তবে ফাতাহ ইসরায়েলের দখলদারিত্ব প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় জনপ্রিয়তা হারায়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ভয়েই মাহমুদ আব্বাস সংসদীয় ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এড়িয়ে চলেন। কারণ, তার আশঙ্কা নির্বাচন দিলে ফাতাহ হামাসের কাছে পরাজিত হতে পারে এবং তিনি নিজের পদ হারাতে পারেন।
ফিলিস্তিনি জনগণ ২০২১ সালের মে মাসে নির্বাচনের প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আব্বাস নির্বাচন স্থগিত করেন। এর জন্য তিনি কৌশলে ইসরায়েলের ওপর দায় চাপান। ইসরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে ভোটগ্রহণের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
এর আগে কি তার কোনও উত্তরসূরি ছিল
মাহমুদ আব্বাস এতদিন কোনো উত্তরসূরি নির্ধারণ করেননি। এবারই প্রথম তিনি রুহি ফাত্তুহকে এই দায়িত্বের জন্য মনোনীত করেছেন।
রুহি ফাত্তুহ ফিলিস্তিনের আইন পরিষদের স্পিকার ছিলেন এবং বর্তমানে প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল কাউন্সিলের (পিএলওর আইনসভা) স্পিকার ও ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
আব্বাস অসুস্থ হয়ে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে রুহি ফাত্তুহ অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে পিএর নেতৃত্ব দেবেন। তিনি ৯০ দিনের জন্য এই দায়িত্বে থাকবেন, যতক্ষণ না নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পরও তিনি একই ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) ফিলিস্তিনি রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা বলেন, রুহি ফাত্তুহ ক্ষমতালোভী নন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি সহজেই দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।
মুস্তাফা আরও বলেন, “রুহি ফাত্তুহর কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। তিনি কেবল নেতৃত্বের দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।”
মাহমুদ আব্বাস এখন কেন উত্তরসূরি মনোনীত করেছেন
বিভিন্ন খবর অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর চাপের কারণেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব কয়েকটি আরব ও ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত সমাধানে একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রচেষ্টা চালায়।
পরবর্তীতে সৌদি আরব অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে (পিএ) সহায়তার জন্য ৬০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
তাহানি মুস্তাফা জানান, সৌদি আরব সেই অর্থের সর্বশেষ ১০ মিলিয়ন ডলারের কিস্তি দেওয়ার শর্ত হিসাবে আব্বাসকে উত্তরসূরি মনোনীত করার কথা বলে।
ইসরায়েল অসলো চুক্তি অনুযায়ী পিএর জন্য আদায়কৃত ১৮৮ মিলিয়ন ডলার করের রাজস্ব আটকে রাখায় পিএর আর্থিক সংকট চরমে উঠেছে। তাই মাহমুদ আব্বাস সৌদির শর্তে রাজি হন।
মাহমুদ আব্বাস কতটা প্রভাবশালী
তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ মহল এখনো ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে ক্ষমতাধর। আব্বাস এখনো ফাতাহ দলের প্রধান। ফাতাহ হলো সবচেয়ে বড় এবং পুরোনো ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক দল।
আব্বাস ইতোমধ্যেই দলের নেতৃত্বের জন্য তার উত্তরসূরি হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-চেয়ারম্যান মাহমুদ আল-আলুলকে মনোনীত করেছেন।
এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, আব্বাস ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার (পিএলও) নেতৃত্বে রয়েছেন, যা ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) তুলনায় অনেক বেশি ক্ষমতাশালী।
ফাতাহ দ্বারা প্রভাবিত বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত পিএলও বিশ্ব মঞ্চে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সমর্থন আদায় করে এবং তাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়।
মুস্তাফার মতে, আব্বাস নিশ্চিত করেছেন যাতে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হুসেইন আল-শেখ, যিনি পিএলওর সেক্রেটারি জেনারেল, তার দায়িত্ব ছাড়ার পর পিএলওর প্রধান হন।
এটা করতে, আব্বাস পিএলওর নির্বাহী পরিষদে তার অনুগতদের নিয়োগ করেছেন, যাতে নির্বাচন হলে তার ঘনিষ্ঠ মহল থেকেই কেউ ক্ষমতায় আসতে পারেন।
মুস্তাফা বলেন, “পিএ ততটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা নয়। কারণ এটি শুধু একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ফিলিস্তিনের আসল গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হলো পিএলও ও ফাতাহ।”
রুহি ফাত্তুহ কে
১৯৪৯ সালে গাজার রাফাহ শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন রুহি ফাত্তুহ। তার পরিবার ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় আসদদের কাছের একটি গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, যেটি বর্তমানে ইসরায়েলি শহর আশদোদ।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা দখল করার পর ফাত্তুহ পরের বছর জর্ডানে চলে যান এবং ফাতাহর সশস্ত্র শাখা আল-আসিফা বাহিনীতে যোগ দেন।
ফাত্তুহ ১৯৭০ এবং ৮০-র দশকে প্রধানত সিরিয়ায় কাটিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে অংশ নেন এবং সেখানে ফাতাহর বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৩ সাল থেকে তিনি ফিলিস্তিন জাতীয় পরিষদের (পিএনসি) সদস্য। ১৯৯৬ সালে গাজায় ফিরে আসার দুই বছর পর তিনি ফাতাহ দলের পক্ষে রাফাহ জেলা থেকে ফিলিস্তিন আইন পরিষদের (পিএলসি) সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ফাত্তুহ ফিলিস্তিন আইন পরিষদের স্পিকার হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে, ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর ২০০৪ সালে তিনি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসাবেও কিছু সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মাহমুদ আব্বাস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
২০০৩ সালে তিনি কৃষিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আর ২০০৬ সালে আব্বাসের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ পান।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা