গ্রেনেড মেরে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় বিচারিক আদালত তারেক রহমানসহ অন্য আসামিদের যে দণ্ড দিয়েছিল, তা অবৈধ ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট। উচ্চ আদালত বলেছে, সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এই রায় দেওয়া হয়নি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার এই মামলায় রবিবার মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন এবং আসামিদের আপিলের রায় দেয় হাই কোর্ট।
তাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে, বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ দণ্ডিত ৪৯ আসামির সবাই বেকসুর খালাস পান।
যে যুক্তিতে সবাইকে খালাস দিয়েছে হাই কোর্ট, তা রায়ের পর সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
তিনি বলেন, “রুল যথাযথ ঘোষণা করে সকলকেই খালাস দেওয়া হয়েছে। (রায়ে) বলা হয়েছে, নিম্ন আদালত যে ট্রায়ালটা করেছে, এই ট্রায়ালটা ছিল অবৈধ, কারণ আইনের ভিত্তিতে এই ট্রায়ালটা সংঘটিত হয় নাই।
“এবং এটাও বলেছেন, কোনও সাক্ষীর সঙ্গে কোনও সাক্ষীর কোলাবরেশন নাই। শোনা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সাজা দেওয়া হয়েছে। এজন্যই সকলের আপিল একসেপ্ট কর, েডেথ রেফারেন্স রিজেক্ট করে সকল আসামিকে খালাস দিয়েছেন। তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সকলকেই এই মামলায় বেকসুর খালাস দিয়েছেন।”
বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এই ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত পেরিয়ে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শুরু হয়েছিল এই মামলার বিচার।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে অধিকতর তদন্তে তারেকসহ ৩০ আসামি যুক্ত হওয়ার পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল দিয়েছিল রায়। তার ছয় বছর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এল হাই কোর্টের রায়।
বিচারিক আদালতের রায়টি দিয়েছিলেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন। তিনি পরে হাই কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ পান।
রায়ে তিনি বলেছিলেন, এই গ্রেনেড হামলা ছিল ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ একটি দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।
রায়ে তিনি ৪৯ আসামির সবাইকে সাজা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বাবর, পিন্টুসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড, তারেকসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বাকি ১১ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।
দণ্ডিতদের মধ্যে তারেকসহ ৭ জন রাজনীতিক, ৮ জন পুলিশ, ৫ জন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা এবং ২৯ জন জঙ্গি ছিলেন।
এই মামলার রায়ের ক্ষেত্রে প্রধান আসামি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি ছিল আলোচিত। তবে এই রায়ের আগেই অন্য মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল।
হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, “কোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেছে, এই মামলায় সাক্ষীদের পরস্পর কেউ দেখেছে, কেউ সচক্ষে দেখেছে, এ ধরনের কোনও এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তা টর্চার করে নেওয়া হয়েছে।
“এ মামলায় মুফতি হান্নান দুটি স্বীকারোক্তি জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা সাবমিশনে বলেছিলাম, ৪০০ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় সাবকন্টিনেন্টে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে সাজা দেওয়া হয়, তার কোনও নজির নেই। আজকে আদালত বলছেন, দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি যেটা করেছিলেন, এটাও পরবর্তীতে তিনি প্রত্যাহার করেছেন। এজন্য এই স্বীকারোক্তির আইনগত কোনও মূল্য নেই।”
এই বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপির আইনজীবী কায়সার কামাল সাংবাদিকদের বলেন, একই মামলায় দুটি অভিযোগপত্র এবং মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রায়ে আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই মামলায় তারেককে আসামি করা হয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আব্দুল কাহার আকন্দকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে তার চার্জশিটে তারেক রহমানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এ মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
“আদালত বলেছেন, মুফতি মান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে যে চার্জশিট দেওয়া হয়, সেই চার্জশিটটি আইন পরিপন্থি ছিল। ফৌজদারি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইনে এই চার্জশিটের আইনগত ভিত্তি নেই। এজন্য আসামিদের খালাস দিয়েছেন।”
২০০৮ সাল থেকে এ মামলায় আসামিদের পক্ষে লড়ে আসছেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান। দীর্ঘ লড়াইয়ে এখন ন্যায়বিচার পেয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।
অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, মামলাটি সাক্ষ্য এবং আইনের কোনও দিক থেকেই প্রমাণিত হয়নি।
আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, “কোনও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে অন্য আসামিকে সাজা দেওয়া যায় না। একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে দণ্ডবিধির ১২০(খ) (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের শাস্তি) প্রমাণ করা যায় না। আর সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ষড়যন্ত্রকারীর কথা বা কার্য স্বাধীন হতে হবে।”
মুফতি হান্নানের প্রথম ও দ্বিতীয় দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি দাবি তিনি বলেন, “দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে তারেক রহমানসহ অন্যান্য যাদের আসামি করা হলো, তাদের বেলায়ও দেখা গেছে মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ নাই। দুটি জবানবন্দিই মুফতি হান্নান প্রত্যাহার করে গেছেন। ফলে প্রত্যাহার করা স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়া যায় না। এমনকি যে আসামি স্বীকারোক্তি করেছে উনি যদি বেঁচে থাকতেন, তারপরও এটা প্রযোজ্য হত না।”
আদালত রায়ে দ্বিতীয় অভিযোগপত্র বেআইনি ঘোষণা করেছেন জানিয়ে শাহজাহান বলেন, “দ্বিতীয় অভিযোগপত্র নিয়ে আইনের যে বিধান আছে, অফিসার ইনচার্জ নতুন কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পেলে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিতে পারেন। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আনা হয়েছে পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনে।”
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ আমলে না নিলে দায়রা আদালতে সরাসরি অভিযোগপত্র দাখিল করা যায় না। এখানে এই কার্যবিধির ১৯৩(১) ধারা পালন করা হয়নি বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান।
তিনি বলেন, “পাবলিক প্রসিকিউটরের আবেদনটি মঞ্জুর করে আদালত যখন মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য পাঠালেন, পুনঃতদন্তের প্রতিবেদন আসার পর সেই অভিযোগপত্র আবার কোনও ম্যাজিস্ট্রেট গ্রহণ করেননি। সরাসরি এটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়, মহানগর দায়রা আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৩ ধারা অনুসারে আমলে নিয়েছেন। হাইকোর্ট রায়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, দ্বিতীয় অভিযোগপত্রটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৩(১) ধারা অনুসরণ করা হয়নি।”
এ মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিল না দাবি করে আইনজীবী শাহজাহান বলেন, “২২৫ জন সাক্ষীর কেউই বলেননি, আমি গ্রেনেড ছুড়েছি বা ছুড়তে দেখেছি। ফলে, প্রকৃত খুনি কে সেটি নাই। এক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না।”
মামলার অভিযোগপত্র, আসামির দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষী না থাকার পরও সর্বোচ্চ সাজাসহ অন্যান্য দণ্ড দেওয়ায় বিচারিক আদালতের রায়টি হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যারা আপিল করেননি, তাদেরসহ হাই কোর্ট সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন।
“ফলে তারেক রহমান, কায়কোবাদসহ যারা আপিল করেননি তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে। মফস্বল আদালতে একটা কথা প্রচলিত আছে, নথিসুদ্দ খালাস। এই মামলাটিও নথিশুদ্ধ খালাস হয়েছে।”
তবে ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিন্দা জানান জানিয়ে আইনজীবী শাহজাহান বলেন, “অপরাধের গুরুত্ব বা নৃসংশতা যতটাই হোক না কেন, আসামিকে সাজা দিতে হলে তার সম্পৃক্ততা দেখতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই মামলার তদন্ত হয়ে যে অভিযোগপত্র আসলো, যে বিচার ১৬ বছর ধরে চললো তার নিষ্পত্তি হলো আজ।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসন অবসানের প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে এসে হাই কোর্টের এই রায়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন কায়সার কামাল।
তিনি বলেন, “তারেক রহমান সাহেব আজকের এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আজকে প্রমাণিত হয়েছে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তারেক রহমান সাহেবকে যে মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছিল, সেই মামলায় আইগতভাবে মোকাবেলার মাধ্যমে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন।
“তারেক রহমান সম্পূর্ণভাবে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রোপাগান্ডার শিকার হয়েছেন। আমরা ও দেশবাসী মনে করেন, তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন।”
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলাটি গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাব বিস্তার করে আছে বলে স্বীকার করেন কায়সার কামাল।
হাই কোর্টের এই রায়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনও প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে দেশ ছেড়ে এখন ভারতে রয়েছেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের অন্য নেতাদের কেউ কারাগারে, কেউবা পালিয়ে রয়েছেন।