Beta
রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
রবিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৫

হরর সিনেমা কেন উপেক্ষিত?

why-horror-films-are-negleted
[publishpress_authors_box]

ডেমি মুর যদি ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিততেন তাহলে এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হতো। কারণ, হরর সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য প্রায়ই শিল্পীদের উপেক্ষা করা হয়। এই ধারা এবারের অস্কারেও বদলায়নি।

২০২৪ সালের ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমাটি ক্লাসিক হরর সিনেমার সব উপাদানই ছিল। এর দানব, রক্ত এবং সাসপেন্স দর্শকদের চোখ পর্দায় আটকে রাখে। এমনকি রক্তপাতের চূড়ান্ত দৃশ্যেও চোখ ফেরানো কঠিন।

ফ্রেঞ্চ পরিচাললক কোরালি ফ্যাগেট পরিচালিত অস্বস্তি জাগানো কল্পকথার সিনেমা ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ বছরের অন্যতম আলোচিত সিনেমা। ডেমি মুর এখানে এলিজাবেথ স্পার্কল এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি ৫০ বছর বয়সে সেলিব্রিটি অ্যারোবিক্স প্রশিক্ষকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। সমালোচক ও দর্শকরা ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমাটিকে বছরের অন্যতম আকর্ষণীয় সিনেমা হিসেবে গণ্য করেছেন। রটেন টমেটোসে সিনেমাটি যথাক্রমে ৮৯% এবং ৭৫% রেটিং পেয়েছে। তবে, ডেমি মুর যখন সেরা অভিনেত্রী হিসেবে গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জেতেন, তখনই অস্কারে সিনেমাটির সাফল্য নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

সেরা সিনেমার পাশাপাশি সেরা চিত্রনাট্য, সেরা অভিনেত্রী, সেরা পরিচালক এবং সেরা মেকআপ ও হেয়ারস্টাইল ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায় সাবস্ট্যান্স। তবে জেতে কেবল মেকআপ ও হেয়ারস্টাইলেই।

‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ হয়তো গতানুগতিক হরর সিনেমা নয়। এটি হরর-কমেডি, যাকে কেউ কেউ ‘নারীবাদের মাস্টারপিস’ বলেছেন। সিনেমাটি পরিচিত গল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, তবে এতে অদ্ভুত মোড় রয়েছে: আমরা যা চাই, তা যদি পেয়ে যাই, তাহলে কী হবে? এলিজাবেথ একটি রহস্যময় সবুজ রঙের ‘সাবস্ট্যান্স’ নেওয়ার পর, তার একটি তরুণ সংস্করণ জন্ম নেয়। তবে, এই প্রক্রিয়ায় মধ্যবয়স্ক সেলিব্রিটির শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিনেমাটি বর্তমান ছবি-পাগল সংস্কৃতিতে নারীত্ব, সৌন্দর্য ও বার্ধক্য নিয়ে একটি সময়োপযোগী বার্তা দেয়। ডেমি মুর নিজেই বলেছেন, এই সিনেমার প্রশংসা তার কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জানান, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জেতা তার ৪৫ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথম কোনো পুরস্কার।

‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সেরা ছবি জিতলে অবশ্য বড় ঘটনা ঘটতো। অস্কারে এই সিনেমাটি সহ মোট ৭টি হরর জনরার সিনেমা এর আগে মনোনয়ন পেয়েছে। জিতেছে কেবল একটি।

ডেমি মুর স্পষ্টভাবে বলেছেন, হরর সিনেমা (এবং এর নির্মাতারা) পুরস্কার এবং স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়। ২০২৫ সালের ক্রিটিকস চয়েস অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার নেওয়ার সময় তিনি দর্শকদের বলেন, “আমি শুধু আমার অভিনয়ের জন্য নয়, এই সিনেমা ও এই জনরার জন্য কৃতজ্ঞ। সাধারণত, হরর সিনেমাগুলোকে উপেক্ষা করা হয় এবং এর গভীরতা দেখা হয় না।”

হরর জনরায় একমাত্র ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ সিনেমাটি সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে, যা ৩৩ বছর আগে ১৯৯২ সালে ঘটেছিল। এই সিনেমাটি সেরা ছবি, সেরা অভিযোজিত চিত্রনাট্য, সেরা পরিচালক (জোনাথন ডেমি), সেরা অভিনেতা (অ্যান্থনি হপকিন্স) এবং সেরা অভিনেত্রী (জোডি ফস্টার) সহ পাঁচটি প্রধান বিভাগে পুরস্কার জিতেছিল। ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ তিনটি সিনেমার মধ্যে একটি, যা ‘বিগ ফাইভ’ বিভাগে পুরস্কার জিতেছে। অন্য দুটি সিনেমা হলো ‘ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট’ এবং ‘ওয়ান ফ্লু ওভার দ্য কুকুস নেস্ট’।

হরর জনরায় একমাত্র অস্কার জিতেছে ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্ব’ সিনেমাটি।

সেরা ছবির পুরস্কার আর কোনো হরর সিনেমা জিততে না পারলেও, কিছু হরর সিনেমায় অসাধারণ অভিনয়ের জন্য শিল্পীরা পুরস্কার পেয়েছেন। উল্লেখযোগ্যরা হলেন- ১৯৬৯ সালে ‘রোজমেরিজ বেবি’ সিনেমার জন্য রুথ গর্ডন, ১৯৯১ সালে ‘মিসারি’ সিনেমার জন্য ক্যাথি বেটস এবং ২০১১ সালে ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ সিনেমার জন্য নাটালি পোর্টম্যান।

অ্যাকাডেমি কিছু অসাধারণ হরর অভিনয়কে স্বীকৃতি দিলেও, অনেক ভালো অভিনয়কে উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্যান্য জনরার তুলনায় হরর অভিনয়ের স্বীকৃতি এখনও বিরল। আরী অ্যাস্টারের ‘হেরিডিটারি’ (২০১৮) সিনেমাটি অনেক পুরস্কার ও মনোনয়ন পেলেও, টনি কোলেটের অভিনয় অস্কার বা গোল্ডেন গ্লোব-এ কোনও মনোনয়ন পায়নি।

পরিচালক ও হরর বিশেষজ্ঞ রেবেকা ম্যাককেনড্রি বলেন, টনি কোলেটের অভিনয় অসাধারণ ছিল, কারণ তিনি একজন মানসিক চাপে থাকা মা, সন্তান হারানোর বেদনা, এবং অলৌকিক ঘটনার শিকার হওয়া থেকে নিজেই দানবে পরিণত হওয়ার মতো জটিল চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

হরর সিনেমা কেন উপেক্ষিত হয়?

সমালোচক ও দর্শকরা মনে করেন, হরর জনরাকে গতানুগতিক দৃষ্টিতে দেখার কারণেই এমনটা হয়। রেবেকা ম্যাককেনড্রি বলেন, অনেকে হরর সিনেমাকে নিম্নমানের, সস্তা ও হাস্যকর মনে করে। তাই তারা এটিকে শিল্প বা সামাজিক বার্তা দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখে না। বেশিরভাগ দর্শক হরর সিনেমা দেখতে ভয় পায়, পুরস্কার দেওয়া তো দূরের কথা।

অস্কার সামাজিক বার্তা দেওয়া হরর সিনেমা পছন্দ করে। জর্ডান পিলের ‘গেট আউট’ (২০১৭) সিনেমাটি এর প্রমাণ। এই সিনেমার জন্য জর্ডান পিল সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের পুরস্কার জেতেন, এবং তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে এই পুরস্কার পান। সিনেমাটি সেরা অভিনেতা, পরিচালক ও ছবির জন্যও মনোনীত হয়েছিল।

জর্ডান পিলের ‘আস’ (২০১৯) সিনেমায় লুপিতা নিয়ংও এর দুর্দান্ত অভিনয়ের পরও অস্কারে মনোনয়ন না পাওয়ার কারণ ছিল হয়তো ‘গেট আউট’-এর মতো স্পষ্ট সামাজিক বার্তা না থাকা। কিম নিউম্যান মনে করেন, ভালো হরর সিনেমা দর্শকদের মনে দাগ কাটে এবং সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। তবে, হরর সিনেমাগুলো প্রায়ই বিতর্কিত হয়, তাই যারা এগুলো অপছন্দ করেন, তারা ভোট দেন না। তিনি বলেন, “হরর সিনেমাকে ধারালো হতে হয়, যা পুরস্কারের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।”

হরর অভিনয় শিল্পীদের সীমা ছাড়িয়ে যেতে বাধ্য করে, যা আরও বেশি স্বীকৃতির দাবি রাখে। অভিনয় প্রশিক্ষক স্কট সেডিতা বলেন, হরর অভিনয়ে শারীরিক দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তিনি ২০১৩ সালের ‘দ্য কনজ্যুরিং’ সিনেমায় ভেরা ফার্মিগার অভিনয়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “তার চিৎকারে বিশেষ দক্ষতা ছিল, প্রচুর শক্তি ছিল।”

ভালো হরর অভিনয়ে দর্শকদের অনুভূতি স্পর্শ করার পাশাপাশি, শারীরিক শক্তি ও আত্মত্যাগ প্রয়োজন, যা দর্শকদের অভিজ্ঞতা বাড়ায়। ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমায় ডেমি মুরের অভিনয়, বিশেষ করে তার বিকৃত রূপান্তর, সিনেমাটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

এলিজাবেথ তার তরুণ সংস্করণকে শেষ করার চেষ্টা করলে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় এবং মনস্ট্রো এলিসাস্যু নামে একটি বিশাল, অদ্ভুত চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। এই দৃশ্যে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অদ্ভুত লাগলেও, এটি সিনেমার মূল বার্তা তুলে ধরে।

‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমায় সৌন্দর্যের মানদণ্ড কতটা অদ্ভুত সেটি তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি সতর্কতামূলক গল্প, মনস্ট্রো এলিসাস্যু চরিত্রটির মধ্য দিয়ে দর্শকদের সামনে আয়না ধরে: সে কি দানব, নাকি আমি, যে এভাবে ভাবছি?

দর্শকদের সাথে সংযোগ রেখে হরর অভিনয় করা কঠিন, যা অনেকে করতে ব্যর্থ হন। এলিজাবেথের শেষ রূপের প্রতি দর্শকদের সহানুভূতি তার অভিনয়ের প্রমাণ।

হরর জনরার ভবিষ্যৎ কী?

২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী হরর ফিল্ম মার্কেটের আয় ছিল প্রায় ১১২.০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি ২০৩৩ সাল নাগাদ বেড়ে ১৯৫.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হরর জনরার বাজার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। এই জনরা সবচেয়ে বেশি দেখা এবং আলোচিত জনরাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যেখানে নির্মাতারা বিভিন্ন ইফেক্ট এবং পুরনো গল্প বলার কৌশল ব্যবহার করে দর্শকদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেন। হরর সিনেমা, বই বা টিভি অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হলো দর্শকদের মনে ভীতিকর অনুভূতি তৈরি করা।

সামনের দিনগুলোতে হরর সিনেমাগুলো কি দর্শকদের খুশি করার চেষ্টা করবে, নাকি চমকপ্রদ গল্প বলবে? এর উত্তর হয়তো জনরার একমাত্র অস্কার জেতা সিনেমা সিনেমা ‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ এবং এর থিমগত বৈচিত্র্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে। ‘

‘দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস’ হরর জনরার সিনেমা, তবে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞরা এটিকে অন্য জনরাতেও ফেলতেন। রেবেকা ম্যাককেনড্রি বলেন, “যখন কোনো হরর সিনেমা বড় পুরস্কার পায়, তখন গণমাধ্যম এর জনরার পরিবর্তন করে। ‘দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস’-কে কখনো হররের বদলে ‘ক্রাইম ফিল্ম’ বলা হতো।”

হরর, থ্রিলার, ক্রাইম এবং অ্যাকশনের মধ্যে পার্থক্য সামান্য মনে হলেও, সিনেমার শ্রেণীকরণ পরিবর্তন করলে মূলধারায় এর ধারণা বদলে যায় এবং এটি পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়!


(বিবিসি অবলম্বনে)

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত