কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকে এখন আতঙ্কে রয়েছে বিদেশি শিক্ষার্থীরা। স্থানীয়দের হামলায় অনেক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে বাংলাদেশিও রয়েছে।
মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত দেশ কিরগিজস্তান পড়াশোনার জন্য অনেক দেশের শিক্ষার্থীদেরই পছন্দের গন্তব্য। এর প্রধান কারণ দেশটিতে পড়াশোনার ব্যয় কম, মানও বেশ উন্নত।
এছাড়া কিরগিজস্তানের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও (ডব্লিউএইচও) স্বীকৃতি অর্জন করেছে দেশটির মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এসব কারণে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক শিক্ষার্থী কিরগিজস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যান্য বিভাগের পাশাপাশি এমবিবিএস পড়তে যায়।
কিরগিজ সরকারের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, প্রায় সাড়ে ৯ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী এ মুহূর্তে দেশটির বিভিন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
অন্যদিকে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার (পিটিআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিরগিজস্তানে অধ্যয়নরত ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এদের মধ্যে কতজন বিশকেকে পড়াশোনা করছেন, তা জানা যায়নি।
কেবল ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশ নয়, রাশিয়া, ইউক্রেন থেকেও শিক্ষার্থীরা কিরগিজস্তানের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
বাংলাদেশের কত শিক্ষার্থী দেশটিতে আছে, তার কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে নানা তথ্যে দেখা যায়, চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়তে অনেকে যাচ্ছে দেশটিতে। সব মিলিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে রয়েছেন বলে নানা সূত্রে জানা গেছে।
হামলা কেন হচ্ছে
কিরগিজ সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ১৩ মে বিশকেকের একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে কিরগিজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একদল বিদেশি শিক্ষার্থীর মারামারি হয়। এর ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যতদূর জানা যাচ্ছে, মিশরীয় একদল শিক্ষার্থী স্থানীয়দের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল।
মারামারির ঘটনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় বিশকেকের সাধারণ মানুষ। তাদের ভাষ্য, বিদেশি শিক্ষার্থীরা তাদের দেশে অতিথি হয়ে পড়তে এসেছে। সেটা মাথায় রেখেই তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে বিদেশিদের স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটা আতিথেয়তার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে মারামারির ঘটনার জেরে বিশকেকে শুক্রবার রাতে অনেক কিরগিজ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ জানায়। তাদের অভিযোগ, ১৩ মে এর ঘটনায় জড়িত বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতি নমনীয় আচরণ করেছে কর্তৃপক্ষ।
যদিও কিরগিজ পুলিশের দাবি, হোস্টেলে স্থানীয় ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের মারামারির ঘটনা জানার পরপরই তারা তিন বিদেশি শিক্ষার্থীকে আটক করে।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার একপর্যায়ে বিশেকেকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব হোস্টেলে বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরা থাকেন, তাদের লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে শত শত কিরগিজ। তারা বেশ কয়েকটি ভবন ভাঙচুরও করে।
ক্ষুব্ধ জনতাকে ঠেকাতে কর্তৃপক্ষ দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করে বলে কিরগিজ দৈনিক টাইমস অব সেন্ট্রাল এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়।
সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের দরজা ভেঙে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছে বিক্ষুব্ধ মানুষ।
হতাহতের কী খবর পাওয়া যাচ্ছে
বিশকেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে ঢুকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে হামলায় এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন বলে খবর ছড়িয়েছে। তবে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওই শিক্ষার্থীর পরিচয় মেলেনি।
এছাড়া এই তিন দেশের শিক্ষার্থীরা হোস্টেল ছাড়াও আন্তর্জাতিক ছাত্রদের বাসভবন এমনকি রাস্তাঘাটে স্থানীয়দের হামলার শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সোশাল মিডিয়ায় বিভিন্ন পোস্ট বলছে, বিশকেকে স্থানীয়দের হামলায় পাকিস্তানি ছাত্র প্রাণ হারিয়েছে। বেশ কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যদিও এসব খবর উড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তান সরকার।
এ বিষয়ে কিরগিজস্তানের পাকিস্তানি কনস্যুলেট এক বিবৃতিতে বলেছে, “বিশকেকে পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের মৃত্যু ও ধর্ষণ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় লেখালেখি হলেও আমরা এখন পর্যন্ত বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারিনি।”
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, চলমান উত্তেজনা থামাতে এরই মধ্যে বিশকেকে বেশ কয়েকজন স্থানীয়কে গ্রেপ্তার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।
বাংলাদেশিদের খবর কী
কিরগিজস্তানে ভারত ও পাকিস্তানের কনস্যুলেট থাকলেও বাংলাদেশের কোনও কনস্যুলেট নেই।
এ কারণে ভারত ও পাকিস্তান সরকার কিরগিস্তানে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সহায়তা করতে পারলেও আটশর মতো বাংলাদেশি মেডিকেল শিক্ষার্থী সেখানে নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
সাধারণত কিরগিজস্তানের পার্শ্ববর্তী দেশ উজবেকিস্তানে থাকা বাংলাদেশের দূতাবাস কিরগিজস্তানের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
কিরগিজস্তানে থাকা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওই দূতাবাস সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে বলে দৈনিক প্রথম আলো তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
এছাড়া কিরগিজস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
বিশকেকের রয়্যাল মেট্রোপলিটন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সৈয়দ রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কক্ষের বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। সহিংসতা হঠাৎই শুরু হয়। ফলে সবাই যে নিজ নিজ কক্ষে ফিরতে পেরেছেন, বিষয়টি এমন নয়। যে যেখানে পেরেছেন, আত্মগোপন করেছেন।
তিনি আরও বলেন, “যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে আমি দেশে ফেরত যেতে চাই। প্রায় দুই দিন হতে চলল, না খেয়ে রয়েছি। গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে যখন বিদেশিদের ওপর হামলা শুরু হয়, তখন থেকে আত্মগোপনে রয়েছি।
“স্থানীয় গণমাধ্যমে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার খবর প্রচার করা হলেও এখনও কোথাও কোথাও বিদেশিদের ওপর হামলার খবর পাচ্ছি।”
কিরগিজস্তানের স্টেট মেডিকেল একাডেমির দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সায়মা কবির প্রথম আলোকে এসএমএস পাঠিয়ে বলেন, “সংঘর্ষের পর থেকেই এখানকার লোকজন বিদেশি শিক্ষার্থী ও শ্রমিকদের ওপর হামলা করছে।
“আমরা নিরাপত্তার জন্য সহায়তা চাই। আমি যে ছাত্রাবাসে রয়েছি, সেটিও নিরাপদ নয়। ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন এখন ছাত্রাবাসের বাইরে অবস্থান করছে। বিদেশিদের পেলেই তারা নির্বিচারে পেটাচ্ছে।”
ভারত, পাকিস্তান কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে
বিশকেকে অবস্থানরত নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের অবস্থা ভারত সরকার পর্যবেক্ষণ করছে বলে শনিবার জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
সোশাল মিডিয়া এক্সে এক পোস্টে তিনি কিরগিজস্তানে পড়তে যাওয়া ভারতীয় শিক্ষার্থীদের দূতাবাসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেন জয়শঙ্কর। একই সঙ্গে তাদের হোস্টেলের বাইরে বের না হওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “কিরগিজস্তানে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি আমরা।
“পরিস্থিতি এ মুহূর্তে শান্ত। তারপরও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বাইরে বের না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে পরামর্শ নিতে তাদের ভারতীয় দূতাবাসের শরণাপন্ন হতে বলা হচ্ছে।”
অন্যদিকে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকে ১৩ মে এর সংঘর্ষ ও তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ।
তিনি এক্সে বলেছেন, পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দিতে কিরগিজস্তানে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি এও বলেন, “আমার কার্যালয় কিরগিস্তানে পাকিস্তানি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এবং প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।”
দ্য ডন বলছে, রবিবার উড়োজাহাজের বিশেষ ফ্লাইটে ৫৪০ জন পাকিস্তানি শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দেশটির তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার দার লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “গতকাল বাণিজ্যিক ফ্লাইটে করে কিরগিজস্তান থেকে ১৩০ শিক্ষার্থী দেশে ফিরেছে। আজ তিনটি বাণিজ্যিক ও বিশেষ ফ্লাইটে ৫৪০ জন শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।”
কিরগিজস্তান সরকার কী বলছে
এনডিটিভি শনিবার জানিয়েছে, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হোস্টেলে কিরগিজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের বিরোধের জেরে সহিংসতার ঘটনায় শনিবার বিবৃতি দেয় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিশকেকের পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কিরগিজস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ধ্বংসাত্মক শক্তিগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতি সম্পর্কে মিথ্যা ও ভুল তথ্য বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানে এসব বানোয়াট তথ্য ছড়ানো হয়েছে বেশি।
কিরগিজস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে পাওয়া সরকারি ও নিশ্চিত তথ্য যেন প্রকাশ করা হয়, সেজন্য সাংবাদিক ও ব্লগারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর।