Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

সোনার দাম বাড়ছে কেন

Gold Price
[publishpress_authors_box]

নিরাপদ বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম সোনার দাম বিশ্ব বাজারে বিগত কয়েক মাস ধরেই বাড়ছিল একটু একটু করে। তবে গতকাল শুক্রবার সোনার দাম প্রথমবারের মতো আউন্স প্রতি ৩ হাজার ডলার ছুঁয়ে রেকর্ড করেছে।

বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ায় সোনার চাহিদা বেড়েছে।

বিশ্ব বাজারে শুক্রবার সোনার দাম আউন্স প্রতি (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৪ দশমিক ৮৬ ডলারে পৌঁছায়। ২০২৫ সালের শুরু থেকে সোনার দাম ১৪ শতাংশ বেড়েছে।

১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রামে হয় এক ভরি সোনা। অর্থাৎ এক আউন্স ৩ হাজার ডলার হিসাবে এক ভরি সোনার দাম পড়ছে ১ হাজার ১২৫ ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৬৪ টাকা)।

বাংলাদেশের বাজারে গত ৯ মার্চ থেকে সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) প্রতিভরি সোনা ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিশ্ব বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারেও সোনার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল। চড়তে চড়তে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২২ ক্যারেটের সোনার ভরি ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৫ টাকায় উঠেছিল, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, ৯ মার্চ থেকে দেশের বাজারে এক গ্রাম ২২ ক্যারেট সোনা কিনতে ১২ হাজার ৯৩৪ টাকা লাগছে। ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রামে এক ভরি হিসাবে প্রতিভরি কিনতে লাগছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৬২ টাকা।

সোনার মূল্য বৃদ্ধির কারণ

অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে বিনিয়োগকারীরা সোনাকে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই এমন পরিস্থিতিতে এর চাহিদা বাড়ে।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে। এতে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ও ভোক্তাদের ওপর প্রভাব পড়ছে; বাড়ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ।

বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা সোনার দিকে ঝুঁকছেন।

শুল্ক বসানোর ফলে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত খরচ হয়। তারা এই খরচ পণ্যের দামে যোগ করতে পারে। ফলে ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার এক ঘোষণায় জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে আমদানি করা যেকোনো অ্যালকোহলের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্ক বসানো হবে। এটি চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের নতুন একটি ধাপ।

এই ঘোষণা ইইউর পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে। ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি হুইস্কির ওপর ৫০ শতাংশ কর বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সব দেশের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানিতে শুল্ক বসানোর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ।

এছাড়া ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপরও শুল্ক বাড়িয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ করেছেন।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মূল্যবান ধাতু বিশ্লেষক সুকি কুপার বলেছেন, “ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও শুল্ক পরিবর্তনের মধ্যে সোনার চাহিদা এখন বেশি।”

হারগ্রিভস ল্যান্সডাউনের তহবিল গবেষণা প্রধান ভিক্টোরিয়া হাসলার মনে করেন, বর্তমানে সোনার দাম বৃদ্ধির দুটি প্রধান কারণ আছে। তিনি বলেন, “ট্রাম্পের শুল্ক নীতি ও মধ্যপ্রাচ্য এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান উত্তেজনা অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। বাজার অনিশ্চয়তা পছন্দ করে না। এই পরিস্থিতি সোনার দাম নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।”

তার মতে সোনার দাম বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনা। তবে এর সঠিক কারণ নির্ধারণ করা কঠিন। সম্ভবত এর একটি কারণ হলো মুদ্রার মজুদকে যুক্তরাষ্ট্রের ডলার থেকে পৃথক করা। এই দুই কারণ এখনও বিদ্যমান। ফলে শিগগিরই সোনার দাম কমবে বলে মনে হচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো শুধু সোনা কিনছে না, তারা নিজেদের দেশে সোনা ফিরিয়েও আনছে। অধিকাংশ দেশ যেমন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো, বিনিয়োগকারীরা এবং ব্যবসায়ীরা তাদের সোনার একটি অংশ ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের ভল্টে রাখে। গত বছর থেকে তারা সোনা নিজেদের দেশের ভল্টে ফিরিয়ে নিয়ে আসছে।

ভারত যুক্তরাজ্য থেকে ২০২৪ সালের মে মাসে ১০০ টন সোনা দেশে পাঠিয়েছে। অক্টোবর মাসে আরও ১০২ টন সোনা পাঠিয়েছে। ২০২৪ সালে মোট ২০০ মেট্রিক টন সোনা লন্ডন থেকে ভারতীয় ভল্টে স্থানান্তরিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সোনার দামে উত্থান-পতন হয়েছে। ২০০৭ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হলে বিনিয়োগকারীরা সোনাকে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বেছে নেয়। ফলে এর দাম বাড়ে।

এজে বেলের বিনিয়োগ পরিচালক রাস মোল্ড বিশ্ব স্বর্ণ পরিষদের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, গত বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভে প্রায় ১ হাজার ৪৫ টন সোনা যুক্ত করেছে। এটি টানা তৃতীয় বছর ছিল, যখন ১ হাজার টনের বেশি সোনা কেনা হয়।

তিনি বলেন, “আমরা এমন এক যুগে আছি, যেখানে সোনা সত্যিই গুরুত্ব পাচ্ছে।”

২০১৮ সালের শেষ দিকে সোনার দাম প্রতি আউন্স ১ হাজার ২০০ ডলারের নিচে নেমেছিল। এরপর থেকে এর দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। রাস মোল্ড জানান, কোভিড মহামারি ও সরকারি ঘাটতির কারণে বিনিয়োগকারীরা আবার সোনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, “সোনার এই দাম বৃদ্ধির মূল কারণ নির্ধারণ করা কঠিন। বিশেষ করে ট্রাম্পের শুল্কনীতি মূল্যস্ফীতি বা স্থবির মুদ্রাস্ফীতির দিকে নিয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। পাশাপাশি এটি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের কর হ্রাস পরিকল্পনার জন্য কতটা কার্যকর হবে, সেটিও আলোচনার বিষয়।”

সম্প্রতি সোনার দাম বেড়েছে। যদিও সাধারণভাবে এটি কমার কথা ছিল। এর দুটি কারণ হলো উচ্চ সুদের হার ও শক্তিশালী ডলার (যুক্তরাষ্ট্র)। সাধারণত যখন ব্যাংকে নগদ অর্থ বা বন্ড থেকে ভালো মুনাফা পাওয়া যায়, তখন সোনার আকর্ষণ কমে যায়। কারণ এটি সুদ দেয় না।

সোনা মূলত ডলারে কেনাবেচা হয়। তাই ডলারের মূল্য বাড়লে অন্য মুদ্রার ধারকদের জন্য সোনা কেনা ব্যয়বহুল হয়ে যায়। ফলে সাধারণত সোনা বিক্রির চাপ বাড়ে।

সোনার দাম বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্ত। ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ ছিল, এরপর এটি কমতে শুরু করে।

২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত ফেড সুদের হার বাড়াতে থাকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। তারপর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফেড সুদের হার অপরিবর্তিত রেখেছে এবং কোনও হ্রাসের দিকে যায়নি।

তবে ধারণা করা হচ্ছিল, সুদের হার কমানো হবে। এ কারণে ডলারের তুলনায় আরও আকর্ষণীয় হয় সোনা। ফেব্রুয়ারিতে বাড়তে শুরু করে সোনার দাম।

কিছু অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী শুরুর দিকে ট্রেন্ড ধরার চেষ্টা করছেন। উচ্চ সুদ হারের সময় সোনা পছন্দসই সম্পদ নয়। তবে যখন সুদের হার কমে, তখন এটি ডলারের তুলনায় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

ফেড ইতোমধ্যে সুদের হার ১ শতাংশ (১০০ বেসিস পয়েন্ট) কমিয়েছে। তবে সর্বশেষ এফওএমসি (ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটি) মিটিংয়ে এটি অপরিবর্তিত রেখেছে।

ফেড প্রধান পাওয়েল বলেছেন, তারা মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত সুদের হার কমানোর জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না। তবে সুদের হার কমানো হবে নিশ্চিত।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, ব্লুমবার্গ, ফাইনান্সিয়্যাল টাইমস।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত