Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

বিশ্বে মানুষের প্রজনন হার কমছে ‘অভূতপূর্ব হারে’

Baby
[publishpress_authors_box]

নম্রতা নাঙ্গিয়া ও তার স্বামী তাদের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ের জন্মের পর থেকেই আরেকটি সন্তান নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু তাদের বারবার নিজেদের একটি প্রশ্নের মুখেই পড়তে হয়- “আমরা কি তা সামলাতে পারব?”

নম্রতা মুম্বাইয়ে একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন। তার স্বামী কাজ করেন একটি টায়ার কোম্পানিতে। তবে একটি সন্তানকে বড় করতে গিয়েই তাদের খরচ খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে – স্কুলের বেতন, স্কুলবাসের ভাড়া, সাঁতার শেখার ক্লাস, এমনকি একজন সাধারণ চিকিৎসকের কাছে যাওয়াটাও অনেক খরচের।

নম্রতার শৈশবে পরিস্থিতি ছিল আলাদা। তিনি বলেন, “আমরা শুধু স্কুলে যেতাম, বাড়তি কোনও কিছু ছিল না। কিন্তু এখন আপনার সন্তানকে সাঁতার শেখাতে হবে, ছবি আঁকা শিখতে পাঠাতে হবে, আর কী কী করতে পারে, সেটাও দেখতে হবে।”

ভারতের নম্রতার অভিজ্ঞতা এখন সারাবিশ্বেই সাধারণ একটি চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে- বলা হয়েছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।

এই সংস্থা তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলছে, কোটি কোটি মানুষ তাদের ইচ্ছামতো সন্তান নিতে পারছেন না। এর প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সন্তান পালনের বিপুল ব্যয় ও উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব।

ইউএনএফপিএ ১৪টি দেশের ১৪ হাজার মানুষের মধ্যে একটি জরিপ চালিয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের তাদের ভবিষ্যতে সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। এতে প্রতি পাঁচজনের একজন বলেছেন, তারা এখনও তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান নিতে পারেননি বা ভবিষ্যতেও হয়ত নিতে পারবেন না।

এই জরিপে অংশ নেওয়া দেশগুলো হলো – দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইতালি, হাঙ্গেরি, জার্মানি, সুইডেন, ব্রাজিল, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়া। দেশগুলো বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে।

দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশ এবং কম ও বেশি প্রজনন হারের দেশ। জরিপে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি এমন ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা ইতোমধ্যে সন্তান নেওয়ার উপযুক্ত সময় অতিক্রম করেছেন।

ইউএনএফপিএ’র প্রধান ডা. নাটালিয়া কানেম বলেন, “বিশ্ব এখন এক নজিরবিহীন জনসংখ্যা হ্রাসের পথে চলছে।”

তিনি আরও বলেন, “আমাদের জরিপে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মানুষ দুটি বা তার বেশি সন্তান চায়। কিন্তু অনেকেই তাদের পছন্দের পরিবার গড়ে তুলতে পারছেন না বলেই সন্তান নেওয়ার হার কমছে। সেটাই আসল সঙ্কট।”

ইউরোপে প্রজনন নিয়ে গবেষণা করা জনসংখ্যাবিদ আনা রটকিরচ বলেন, “এটিকে সঙ্কট বলা হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে এটি বাস্তব—এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় পরিবর্তন।” তিনি ফিনল্যান্ড সরকারের জনসংখ্যা নীতিতে পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “সাধারণভাবে দেখা যায়, মানুষ যত সন্তান চায়, বাস্তবে তার চেয়ে কম সন্তান নিচ্ছে।” ইউরোপে দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি এবং এখন এটি বৈশ্বিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে দেখে তিনি আগ্রহী হয়েছেন।

তাকে সবচেয়ে অবাক করেছে একটি তথ্য—৫০ বছরের বেশি বয়সী অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩১ শতাংশ বলেছেন, তারা ইচ্ছেমতো সন্তান নিতে পারেননি।

এই জরিপটি মূলত একটি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ। বছর শেষে ৫০টি দেশে এ ধরনের আরও গবেষণা চালানো হবে। তবে এখনকার এই জরিপের আওতা সীমিত। যেমন, প্রতিটি দেশের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক গোষ্ঠী নিয়ে বিশ্লেষণ করার মতো যথেষ্ট তথ্য এখানে নেই।

তবুও কিছু বিষয় একেবারে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

সব দেশ মিলিয়ে ৩৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তাদের সন্তান নেওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তর এসেছে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে—৫৮শতাংশ। আর সবচেয়ে কম সুইডেন থেকে—১৯ শতাংশ।

মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ বলেছেন, সন্তান না নিতে পারার পেছনে বন্ধ্যত্ব বা সন্তান ধারণে সমস্যা দায়ী। তবে থাইল্যান্ডে এই হার ১৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫ শতাংশ, নাইজেরিয়ায় ১৪ শতাংশ ও ভারতে ১৩ শতাংশ। আর এই হার গড়ের চেয়ে বেশি।

হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির জনসংখ্যাবিদ অধ্যাপক স্টুয়ার্ট গিয়েটেল-বাস্টেন বলেন, “জাতিসংঘ এই প্রথমবারের মতো কম প্রজনন নিয়ে এত জোর দিয়ে বক্তব্য রাখল। এতদিন পর্যন্ত জাতিসংঘ মূলত সেইসব নারীদের নিয়ে কাজ করত, যারা তাদের চেয়েও বেশি সন্তান নিচ্ছেন বা যাদের গর্ভনিরোধের সুযোগ নেই।”

তবে বর্তমানে ইউএনএফপিএ কম প্রজনন নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিচ্ছে। তবে তার সঙ্গে সতর্কতাও রাখছে।

ইউএনএফপিএ’র প্রধান ডা. নাটালিয়া কানেম বলেন, “এই মুহূর্তে আমরা দেখছি, জনসংখ্যা সঙ্কট নিয়ে অনেক অতিরঞ্জিত ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। কখনও বলা হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, আবার কখনও বলা হচ্ছে জনসংখ্যা হ্রাস। এতে করে অনেক সময় অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আর কখনও কখনও এই প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে চালিত হয়।”

তিনি বলেন, “নারীদের বেশি সন্তান নিতে উৎসাহ দেওয়া হোক কিংবা কম—উভয় ক্ষেত্রেই এই ধরনের প্রতিক্রিয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।”

তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ৪০ বছর আগে চীন, কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড ও তুরস্ক উদ্বিগ্ন ছিল তাদের জনসংখ্যা বেশি হয়ে যাচ্ছে ভেবে। অথচ ২০১৫ সালের দিকে সেই দেশগুলোই আবার প্রজনন হার বাড়াতে চাচ্ছিল।

অধ্যাপক গিয়েটেল বাস্টেন বলেন, “আমরা চাই এসব দেশ যেন আতঙ্কিত হয়ে কোনও নীতিগত ভুল সিদ্ধান্ত না নেয়। আমরা দেখছি কম প্রজনন, জনসংখ্যার বার্ধক্য ও স্থবিরতা ব্যবহার করা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী, অভিবাসনবিরোধী এবং নারীবিরোধী রক্ষণশীল নীতির অজুহাত হিসেবে।”

ইউএনএফপিএ আরও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে—অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, বরং সময়ের অভাব।

মুম্বাইয়ের নম্রতার জন্য এটি বাস্তব।

প্রতিদিন তিনি অফিসে যাতায়াতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করেন। বাড়ি ফিরে তিনি ক্লান্ত থাকেন। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। পরিবারের কেউই পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারেন না।

তিনি বলেন, “একটা কর্মদিবস শেষে, একজন মা হিসেবে মনে হয় আমি আমার সন্তানের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটাতে পারছি না। সেই অপরাধবোধও কাজ করে।”

তাই তিনি ও তার স্বামী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, “আমরা শুধু একটিতেই মনোযোগ দেব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত