“হাত বোমা নিয়ে ক্রিকেট খেলল কয়েক জন
নিমেষেই ঘটলো ভোটের সকালে বিস্ফোরণ,
খেলতে খেলতে মরল দু’জন বালাইষাট
বস্তির ছেলে বয়েস তাদের সাত কি আট!!
বাহবা সাবাস বড়দের দল এইতো চাই
ছোটরা খেলবে আসুন আমরা বোমা বানাই।।
ছোট্ট রাজুর চোখ দু’টো গেছে হাউ’স দ্যাট!
ভোটের সকালে লজ্জিত শুধু ক্রিকেট ব্যাট! ।।
দেখুন বড়রা, কত কতটা লজ্জা পান…
লজ্জা কিসের বোমা তন্ত্রটা চালিয়ে যান।”
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীতশিল্পী কবির সুমনের ‘হাউ’স দ্যাট’ শিরোনামের গানটি থেকে নেওয়া এই লাইনগুলো।
১৯৯৬ সালের ৭ মে ছিল রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। ভোটের দিন সকালে দক্ষিণ কলকাতার এক পাড়ার রাস্তার পাশে পলিথিন ব্যাগে থাকা ৩ থেকে ৪টি বলের মতো দেখতে জিনিস পড়েছিল। বল ভেবে সেই জিনিস নিয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিল কয়েকটি শিশু। ওগুলো আসলে বল ছিল না, ছিল বোমা। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ। ঘটনাস্থলেই দুই শিশু মারা যায়।
সেদিনের বাস্তবতা নিয়েই কবির সুমন লেখেন এই গানটি।
কবির সুমনের গানটি আজও ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকেন্দ্রিক বোমা সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে। রাজ্যটিতে গত তিন দশকে অন্তত ৫৬৫ শিশু হাতে তৈরি বোমায় আহত বা নিহত হয়েছে।
সম্প্রতি বিবিসি আইয়ের একটি দল এনিয়ে প্রতিবেদন করেছে। সেখানে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে কী এই প্রাণঘাতী অস্ত্রগুলো, কীভাবে এগুলো পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত? আর কেন এত শিশু এর মাশুল গুনছে?
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালের মে মাসের এক ঝলমলে গ্রীষ্মের সকাল। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার একটি বস্তি থেকে ছয়জন ছেলে ক্রিকেট খেলতে বেরিয়েছিল সরু এক গলিতে।
যোধপুর পার্কের মধ্যবিত্ত এলাকার ঠিক মাঝের ওই বস্তির সেদিনের সকালটিও ছিল অন্য দিনের মতো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। ছিল ছুটির আমেজ। কারণ সাধারণ নির্বাচনের জন্য রাজ্যজুড়ে সেদিন সবকিছু বন্ধ ছিল।
ওই ছেলেদের মধ্যে একজন নয় বছরের পুচু সরদার। ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে নিঃশব্দে তার ঘুমন্ত বাবার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় পুচু। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ব্যাটে-বলের আঘাতের শব্দ পুরো গলিতে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
ঘটনার শুরু এভাবে…তাদের অস্থায়ী ক্রিকেট মাঠের সীমানা ছাড়িয়ে একটি বল অন্যত্র চলে যায়। ছেলেরা সেটি খুঁজতে পাশের একটি ছোট বাগানে ঢুকে পড়ে। সেখানে একটি কালো প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে তারা ছয়টি গোলাকার বস্তু দেখতে পায়।
সেগুলো দেখতে ক্রিকেট বলের মতোই লাগছিল, যেন কেউ সেগুলো ফেলে রেখে গেছে। ছেলেরা সেই ‘বল’ নিয়ে খেলতে শুরু করল।
ব্যাগ থেকে একটি ‘বল’ পুচুর দিকে ছোড়া হলে সে সেটিকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করে। আর তখনই বিকট বিস্ফোরণে পুরো গলি কেঁপে উঠে। আসলে ওই বস্তুটি ছিল একটি বোমা।
ধোঁয়া কেটে গেলে প্রতিবেশীরা ছুটে বাইরে এসে দেখতে পায়, পুচু ও তার পাঁচ বন্ধু রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাদের ত্বক পুড়ে কালো হয়ে গেছে, পোশাক ঝলসে গেছে, শরীর ক্ষত-বিক্ষত।
আতঙ্কে চিৎকারে চারপাশে হাহাকার শুরু হয়।
খালার কাছে মানুষ হওয়া রাজু দাস আর সাত বছর বয়সী গোপাল বিশ্বাস বোমার আঘাতে মারা যায়। বাকি চারজন হয় গুরুতর আহত।
পুচু কোনোমতে বেঁচে গিয়েছিল। তবে তার বুক, মুখ ও পেটে পুড়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বোমার টুকরো ঢুকে যায়। হাসপাতালে এক মাসেরও বেশি সময় থাকতে হয় তাকে। বাড়ি ফেরার পর তার শরীরে আটকে থাকা বোমার টুকরোগুলো সরাতে তাকে রান্নাঘরের চিমটা ব্যবহার করতে হয়েছিল। কারণ তার চিকিৎসার খরচ আর পরিবার চালাতে পারছিল না।
পুচু ও তার বন্ধুরা সেই দীর্ঘ ও করুণ তালিকার অংশ, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের সহিংস রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের রক্তাক্ত লড়াইয়ে দশকের পর দশক ধরে ব্যবহৃত দেশি বোমার কারণে অসংখ্য শিশু নিহত বা পঙ্গু হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের হতাহতের নির্দিষ্ট সংখ্যা নিয়ে প্রকাশিত কোনও তথ্য নেই।
তাই বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাজ্যের দুটি প্রধান সংবাদপত্র – আনন্দবাজার ও বর্তমান পত্রিকার প্রতিটি সংস্করণ পর্যালোচনা করেছে। যেখানে এই বোমার কারণে শিশুদের আহত বা নিহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বিবিসি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৫৬৫ শিশুর হতাহতের ঘটনা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ও ৪৭১ জন আহত হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ১৮ দিনে একটি শিশু বোমা-সংক্রান্ত সহিংসতার শিকার হয়েছে।
তবে বিবিসি এমন কিছু ঘটনাও খুঁজে পেয়েছে যেখানে শিশুদের আহত হওয়ার খবর এই দুটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। তাই প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই ঘটনাগুলোর ৬০ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শিশুরা বাড়ির বাইরে খেলার সময় আহত হয়েছে। বাগান, রাস্তা, খামার, এমনকি স্কুলের আশেপাশে- যেখানে বোমাগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সাধারণত এগুলো নির্বাচন চলাকালীন প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
বিবিসির সঙ্গে কথা বলা অধিকাংশ ভুক্তভোগীই দরিদ্র পরিবারের। তারা গৃহপরিচারিকা, দিনমজুর বা কৃষি শ্রমিকদের সন্তান।
পশ্চিমবঙ্গের বোমার ‘বিপ্লবী ইতিহাস’
পশ্চিমবঙ্গ হলো ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রাজ্য। এর জনসংখ্যা ১০০ মিলিয়নেরও বেশি। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক সহিংসতার সঙ্গে সংগ্রাম করে আসছে রাজ্যটি।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে রাজ্যটি বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী শাসন করেছে। কংগ্রেস পার্টি দুই দশক শাসন করেছে। তারপর তিন দশক কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট এবং ২০১১ সাল থেকে বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস।
১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে রাজ্যটি নকশালপন্থী ও সরকারের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে জর্জরিত ছিল।
তবে যে বিষয়টি সবার মধ্যে অভিন্ন, তা হলো বোমার ব্যবহার। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করতে এবং বিশেষ করে নির্বাচনকালে ভীতি সৃষ্টির জন্য এর ব্যবহার করে।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সাবেক ইনস্পেক্টর জেনারেল পঙ্কজ দত্ত বলেন, “বোমা ব্যবহৃত হয়েছে। এটা বাংলা অঞ্চলে বহু বছর ধরে হচ্ছে। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।”
বাংলায় বোমা তৈরির ইতিহাস ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৯০০-এর দশকের শুরুর বিদ্রোহে নিহিত। প্রথম দিকে বোমা তৈরি করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ছিল বেশ সাধারণ ঘটনা। এক বিদ্রোহী তার একটি হাত হারিয়েছিলেন। আরেকজন বোমা পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
এরপর এক বিদ্রোহী ফ্রান্স থেকে ফিরে আসেন বোমা তৈরির কৌশল শিখে। তার বইবোমার ভেতরে বিস্ফোরক লুকানো ছিল ক্যাডবেরি কোকো টিনে। লক্ষ্যবস্তু ছিলেন এক ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট। টিনটি খুললেই মারা যেতেন তিনি।
প্রথম বিস্ফোরণটি ১৯০৭ সালে মেদিনীপুর জেলা কাঁপিয়ে দেয়। তখন বিপ্লবীরা ট্রেন লাইনের ওপর বোমা পুঁতে এক উচ্চ পদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
কয়েক মাস পর মুজফফরপুরে এক ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যায় ব্যর্থ চেষ্টা হয়। তবে বোমাটি একটি ঘোড়ার টানা গাড়িতে ছোড়া হলে দুই ব্রিটিশ নারীর প্রাণ যায়।
ঘটনাটি তখন পত্রিকায় জায়গা পেয়েছিল। শিরোনাম হয়, “শহরকে চমকে দেওয়া ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ।”
ওই ঘটনা কিশোর বিপ্লবী ক্ষুদিরামকে শহীদ এবং ভারতীয় বিপ্লবীদের তালিকায় প্রথম ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ হিসেবে পরিণত করেছিল।
ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক ১৯০৮ সালে লিখেছিলেন, বোমা কেবল অস্ত্র নয় বরং একটি নতুন ধরনের ‘যাদুকরী জ্ঞান’, যা বাংলা থেকে ভারতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আজকাল বাংলায় দেশি বোমাকে স্থানীয়ভাবে ‘পেটো’ বলা হয়। এগুলো পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। শত্রুদের আঘাত করতে পেরেক, লোহা ও কাচের টুকরো ব্যবহার করা হয় এসব বোমায়।
বিভিন্ন ধরনের পাত্রে বোমা তৈরি করা হয়। যেমন বিস্ফোরকে ভর্তি স্টিলের কনটেইনার বা কাচের বোতল। এগুলো প্রধানত প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষে ব্যবহৃত হয়।
রাজনৈতিক কর্মীরা, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার কর্মীরা এই বোমাগুলো ব্যবহৃত করে বিরোধীদের ভয় দেখাতে। ভোট কেন্দ্রগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে অথবা শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে।
এসব বোমা প্রায়ই নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রগুলো ধ্বংস করার জন্য বা নির্দিষ্ট এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় লাগে।
পৌলমী হালদারের মতো শিশুদেরই এমন সহিংসতার সবচেয়ে বড় শিকার হতে হয়।
উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি গ্রাম গোপালপুর। ২০১৮ সালের এপ্রিলের এক সকালে ওই গ্রামের সাত বছরের পৌলমী ভোরের পূজার জন্য ফুল তুলছিল। গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচন তখনও এক মাস দেরি।
প্রতিবেশীর পানি তোলার পাম্পের কাছে পৌলমী একটি বল দেখতে পায়।
তার ভাষ্যে, “আমি সেটা তুলে নিয়ে বাড়ি আনি।” যখন সে বাড়িতে ঢুকছিল তার দাদা চা খাচ্ছিলেন। তিনি পৌলমীর হাতের জিনিসটি দেখে থমকে যান।
তিনি বললেন, “এটা বল নয়, এটা বোমা! ফেলে দাও।” কিন্তু কিছু করার আগেই পৌলমীর হাতে সেটি বিস্ফোরিত হয়।
বিস্ফোরণে গ্রামটির নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায়। পৌলমীর চোখ, মুখ ও হাত ঝলসে যায়। অজ্ঞান পৌলমীকে নিয়ে চারপাশে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।
পৌলমী সেই স্মৃতি মনে কলে বলেন, “লোকজন আমার দিকে দৌড়ে আসছিল। কিন্তু আমি খুব বেশি দেখতে পারছিলাম না। সারা শরীরে আঘাত পেয়েছিলাম।”
গ্রামবাসীরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায়। আঘাত ছিল ভয়াবহ। তার বাম হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল। টানা এক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাকে। একটি সকালের বিধ্বংসী মুহূর্ত পৌলমীর পুরো জীবনটাই পাল্টে দেয়।
পৌলমী একা নয়।
২০২০ সালের এপ্রিলে মুর্শিদাবাদ জেলার জিতপুর গ্রামে ১০ বছর বয়সী সাবিনা খাতুনের হাতে একটি পেটো বিস্ফোরিত হয়।
সাবিনা তার ছাগলটি চরাতে গিয়ে ঘাসের মধ্যে পড়ে থাকা বোমাটি দেখতে পায়। আগ্রহী হয়ে সে সেটি তুলে নিয়ে খেলতে শুরু করলে বিস্ফোরিত হয়।
তার মা আমিনা বিবি বলেন, “বিস্ফোরণের শব্দ শোনার পর আমি ভাবলাম, এবার কে অক্ষম হবে? সাবিনা কি পঙ্গু হয়ে যাবে? আমি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, সবাই সাবিনাকে কোলে নিয়ে আসছে। তার হাত থেকে মাংস বেরিয়ে ছিল।”
প্রাণ বাঁচানোর জন্য সাবিনার হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল।
এক হাত না থাকা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন সাবিনার বাবা-মা। তাদের ভয় অমূলক নয়। কারণ ভারতে প্রতিবন্ধী নারীরা সামাজিক কলঙ্কের শিকার হন। তাদের বিয়ে ও চাকরির সম্ভাবনা জটিল হয়ে পড়ে।
মা আমিনা বলেন, “আর কখনও হাত ফিরে পাবে না বলে মেয়ে বারবার কাঁদত। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, তোমার হাত আবার বের হবে। তোমার আঙুল আবার বড় হবে।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি আই।