পাকিস্তান অনেকদিন ধরেই রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পদচ্যুত করার পর থেকেই দেশটি উত্তপ্ত অবস্থায় আছে। নির্বাচনের পর নওয়াজ শরীফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) এখন দেশটির ক্ষমতায়।
ইমরানকে হটিয়ে ক্ষমতায় বসা পিএমএল-এন শুরু থেকেই তোপের মুখে। একের পর এক বিক্ষোভের ঘটনায় টালমাটাল দেশটির প্রশাসন। সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক সংকট, উচ্চ বেকারত্বের হার, জ্বালানিসহ বিভিন্ন সমস্যা।
ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফিতী ও করের উচ্চ হার কমানোর দাবিতে গত এক মাস ধরেই পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে বিক্ষোভ চলছে। করাচিতে শুক্রবারও জামায়াত-ই-ইসলামি পাকিস্তান পার্টির ডাকে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছে।
গত মাসেই দেশটিতে পেট্রোলের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে সরকার। এর বিরুদ্ধে দেশটির পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন ধর্মঘট ডাকে। এতে সাড়া দিয়ে দেশটির কয়েক হাজার পেট্রোল পাম্প স্টেশন বন্ধও রাখা হয়।
এদিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশেও চলছে বিক্ষোভ। প্রদেশের হাজার হাজার নারী পুরুষ সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়ে রাজপথে নেমেছে। নিজেদের স্বাধীনতার দাবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবার মেডিকেল কলেজে বর্ধিত ফির বিষয়টি। এনিয়ে প্রদেশের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নেমেছে।
একইসঙ্গে চলছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে জেল থেকে মুক্ত করার আন্দোলন। তাকে মুক্ত করতে সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছে দেশটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ৩০ আগস্টের মধ্যে ইমরানকে মুক্তি দেওয়া না হলে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু করবে তারা।
পাকিস্তানের এমন বাস্তবতার মধ্যেই বারবার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেট। একযোগে সারা দেশে বন্ধ করা না হলেও, বিভিন্ন রাজ্যে বিঘ্নিত হচ্ছে ইন্টারনেট সেবা। এনিয়ে পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না সুষ্পষ্ট কোনও বার্তা।
শুরুর দিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলা হলেও, এখন পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি (পিটিএ) বলছে, সাইবার নিরাপত্তা জোরদারে নতুন ‘ফায়ারওয়াল’ ইন্সটল করা হচ্ছে। আর এ কারণেই ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। কিন্তু এই ফায়ারওয়াল ইন্সটল করতে কত সময় লাগবে, সেবিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট তথ্য দেয়টি পিটিএ।
তবে পাকিস্তানের তথ্য-প্রযুক্তি ও টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রী সাজা ফাতিমা খাজা হোয়াটস অ্যাপ, ফেইসবুক ও এক্সের মতো জনপ্রিয় প্লাটফর্ম নিরাপত্তার খাতিরে বন্ধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
ফাতিমা খাজা ডনকে বলেন, “পিটিএ ও অন্য কয়েকটি দপ্তরের অভিযোগের ভিত্তিতে সরকার ইন্টারনেট সংক্রান্ত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা ইন্টারনেট বন্ধের পক্ষে নই। চেষ্টা করছি ফাইভজি নেটওয়ার্ক চালু করতে।”
দ্য নিউজ ডটকম জানিয়েছে, ডিজিটাল জার্নালিজমকে কেন্দ্র করে গত মাসে পাকিস্তানে একটি ফায়ারওয়াল ট্রায়াল দেওয়া হয়। এরপরই সোশাল মিডিয়াসহ বহু অ্যাপ চালানো কঠিন হয়ে যায়। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ফায়ারওয়াল ট্রায়াল শেষ হলে ইন্টারনেটের গতি স্বাভাবিক হবে।
দেশটির ওয়্যারলেস অ্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস আ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান (ডব্লিউমাইএসপিএপি) বলছে, নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়াতেই সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক জায়গায় ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দিয়েছে। আবার কোথাও বন্ধও করে দিয়েছে।
পাকিস্তানে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া নতুন কোনও ঘটনা নয়। এ বছরের শুরুতে প্রায় দুই মাস দেশটির ১২৮ মিলিয়ন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সমস্যায় পড়েন। জানুয়ারিতে ফেইসবুক, ইউটিউব ও ইন্সটাগ্রামের মতো সোশাল মিডিয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে পাকিস্তানের গত নির্বাচনের সময় টানা ৭২ ঘণ্টা ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়।
২০২৩ সালে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের সময়ও ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল। ওই বছর মোট ৪২ বার ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত করা হয়েছিল। নিরাপত্তার কারণে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া দেশের তালিকায় পাকিস্তান তৃতীয়।
পাকিস্তান ইনিস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকসের মতে, দেশটিতে একদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন রুপি ক্ষতি হয়। দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ফ্রিল্যান্সাররা। সবচেয়ে বেশি ফ্রিল্যান্সার থাকা দেশের তালিকায় পাকিস্তান তৃতীয়।
গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভের পলিসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন প্রধান রেশমা জাহাঙ্গীরের মতে, স্বৈরাচারী সরকারগুলো ভিন্নমত দমনের অস্ত্র হিসেবে ক্রমবর্ধমানভাবে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত করছে। গত ৫ বছরে অন্তত ৪৬টি সরকার সোশাল মিডিয়া ও মেসেজিং অ্যাপে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
তথ্যসূত্র : ডন, আল-জজিরা, বিবিসি, ডয়েচে ভেলে।