Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

ইসরায়েলি তরুণরা কেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাইছে না 

তেল আবিবে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে হাস্যোজ্জ্বল ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। সেও সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তেল আবিবে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে হাস্যোজ্জ্বল ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। সেও সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
[publishpress_authors_box]

ইতামার গ্রিনবার্গ, ১৮ বছরের ইহুদি ইসরায়েলি। গত বছর পাঁচবার সাজা হয় তার। কারাগারে ছিলেন ১৯৭ দিন। এ মাসের শুরুতে মুক্তি পান তিনি।

গ্রিনবার্গকে এক বছরে এতবার সাজা দেওয়ার কারণ কী? এত অল্প বয়সে কী এমন অপরাধ করেছিলেন তিনি?

ইসরায়েলি এই তরুণকে গত বছর সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বলা হলেও তিনি যোগ দেননি- এই ছিল তার অপরাধ।

১৮ বছর বয়স হলেই ইসরায়েলের বেশির ভাগ ইহুদি ও জাতিগত সংখ্যালঘু একাংশের সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক।

তাহলে রাষ্ট্রের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে গ্রিনবার্গ কেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি? তিনি কি এর পরিণতি জানতেন না?

এই প্রশ্নের জবাবে সিএনএনকে গ্রিনবার্গ বলেন, “আমার পড়াশোনা ও এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নীতি-নৈতিকতা আমাকে রাষ্ট্রের অবাধ্য হতে বলে।    

“আমি যত বেশি পড়েছি, জেনেছিও তত। আমি বুঝতে শিখেছি, হত্যা ও নিপীড়নের প্রতীক সেনাবাহিনীর পোশাক পরা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়।”

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, গ্রিনবার্গ ‘হত্যা ও নিপীড়ন’ বলতে হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনের গাজায় ২০২৩ সাল থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল পরিচালিত হত্যাযজ্ঞকেই বুঝিয়েছেন।

তিনি বলেন, “গাজায় ইসরায়েল যা করছে, তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই হত্যাযজ্ঞ আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে সহযোগিতা করে।

“তাছাড়া যারা গণহত্যা চালাচ্ছে, তাদের বাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণ খোঁজার প্রয়োজন দেখি না।”  

গাজায় যে ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে, তা গ্রিনবার্গের মতো ইহুদি তরুণরা বারবার বলে এলেও মানতে নারাজ বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার।

গাজায় হামলা চালিয়ে ১৭ মাসে ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গত মঙ্গলবার থেকে নতুন করে শুরু করা হামলায় এরই মধ্যে প্রায় ৭০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২০০শোর বেশি কেবল শিশুই।

গ্রিনবার্গের মতো তরুণরা তাই মনে করে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জন্য কাজ করার চেয়ে নির্দেশ অমান্য করে কারাগারে থাকাই শ্রেয়।

গ্রিনবার্গ বলেন, “যা চলছে, আমি তার পরিবর্তন চাই। আমি আমার জীবন এর জন্য উৎসর্গ করতে রাজি আছি।”

তেল আবিবে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ আয়োজনে ইসরায়েলি তরুণরাই রাখছেন মূল ভূমিকা।

মগজ ধোলাই শৈশব থেকেই

গ্রিনবার্গের মতো যারা নৈতিক কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান না, তাদের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। কারণ সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়ার অর্থ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বা একঘরে হয়ে পড়া।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনী কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি সামাজিক কাঠামোরই অংশ, যেখানে ইসরায়েলি পরিচয়ের সঙ্গে সামরিক সেবা আলাদা করার সুযোগ নেই।

যেমন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরপরই ইসরায়েলি শিশুদের শেখানো হয়, বড় হয়ে একদিন তারা সৈনিক হবে, যারা তাদের মতো শিশুদের রক্ষা করবে।

এই ইসরায়েলি শিশুদের আগামী দিনের সৈনিক হতে উৎসাহ দেওয়ার জন্য তাদের ক্লাসরুমেও হাজির হয় সেনাবাহিনীতে দায়িত্বরত সৈনিকরা।

এই শিশুদের বয়স যখন ১৬ ছুঁইছুঁই, তখন তাদের হাতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের আদেশ ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ১৮ বছর বয়সে তাদের বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া লাগে।

অনেক ইসরায়েলিই এই প্রথাকে সম্মান, দায়িত্ব ও জীবনের ধাপ হিসেবে দেখে।

জীবনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পা দিতে না চাওয়ায় গ্রিনবার্গের আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধুরা তাকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী, ‘সন্ত্রাসী সমর্থক’, ‘বিশ্বাসঘাতক’ ট্যাগ দিয়েছে।

এছাড়া নিয়মিত হত্যার হুমকিও পান তিনি।    

গ্রিনবার্গ বলেন, “ইনস্টাগ্রামে লোকজন আমাকে মেসেজ পাঠিয়ে বলে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলিদের যেভাবে মেরেছে, তারাও ঠিক সেভাবে আমাকে হত্যা করবে।”

এমনকি সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়ার ‘অপরাধে’ কারাগারে বন্দি থাকার সময়ও অন্য বন্দিরা তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিত।

একপর্যায়ে গ্রিনবার্গের নিরাপত্তার জন্য তাকে আলাদা কক্ষে রাখে কারা কর্তৃপক্ষ, যেখানে তিনি একা থাকতেন।

সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়ায় সামাজিকভাবে একঘরে করা হয়েছে লিওর ফোগেলকে।

অবাধ্যদের সংখ্যা বাড়ছে

সমাজ থেকে এভাবে বিচ্ছিন্ন ও জীবনের নিরাপত্তাকে এভাবে হুমকির মুখে ফেলার পরও ইসরায়েলে গ্রিনবার্গের মতো বিবেকবান তরুণের সংখ্যা, বিশেষ করে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরুর পর বেড়েছে।      

ইসরায়েলের যুদ্ধবিরোধী সংগঠন ইয়েশ জিভাল সিএনএনকে জানায়, সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য তরুণদের মধ্যে গড়ে প্রতি বছর ২০ শতাংশ সেখানে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

গ্রিনবার্গ বলেন, “সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে আমি সমস্যার অংশ হয়ে যাব। আমি সমস্যার নয়, বরং সমাধানের অংশ হতে চাই।”

গত শনিবার ইসরায়েলের বামপন্থী রাজনৈতিক জোট হাদাশের প্রধান কার্যালয়ে গ্রিনবার্গের মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না চাওয়া তরুণরা সমবেত হন।

গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তেল আবিবে প্রতি সপ্তাহে আয়োজন করা বিক্ষোভ সমাবেশের প্রস্তুতি হাদাশের এই কার্যালয় থেকে নেওয়া হয়।

তো এই তরুণদের একজন লিওর ফোগেল। ১৯ বছর বয়সী এই তরুণী জানান, সহিংসতা ও জোরজবরদস্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধাচরণ তিনি সব সময় করে গেছেন।

এরই অংশ হিসেবে সামরিক সেবাপ্রদান থেকে অব্যাহতি পেতে তার ‘মানসিক সমস্যা’ আছে, তা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে বলিয়ে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অব্যাহতিপত্র জোগাড় করেন তিনি।

ফোগেল জানান, তার মা-বাবা তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং সেনাবাহিনীতে যোগ না দেওয়ায় সামাজিকভাবে তাকে একঘরে করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ইসরায়েলের বর্ণবাদী ব্যবস্থা ও এর শাসনপ্রক্রিয়া সক্রিয়ভাবে অন্য গোষ্ঠীকে নিপীড়ন করে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

“এ পরিস্থিতি কেবল অনৈতিক নয়, এর পরিণাম হবে ভয়াবহ,” সতর্ক করেন এই ইসরায়েলি তরুণী।

তথ্য সূত্র : সিএনএন

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত