যতই আঁকার খাতা, কাগজ, ক্যানভাস কিনে এনে হাতে তুলে দিন না কেন, আপনার বাচ্চা ঘুরেফিরে ঘরের দেয়ালেই দাগ টেনে যাবে, আঁকিবুকি কাটবে। এমনকি বাদ দেবে না আসবাবও। আলমারি হোক অথবা দেয়াল, এতো বড় আর ফাঁকা একটি ক্যানভাসে আঁকার স্বাধীনতা শিশুর সৃজনশীল জগতকে জাগিয়ে তোলে। দেয়ালে রঙিন পেনসিল আর ক্রেয়ন ঘষার আওয়াজে ওদের আঁকার আনন্দ বেড়ে যায়।
ঘরের সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তিত অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের দেয়ালে আঁকা ঠেকাতে যান; কিন্তু না পেরে হাঁপিয়ে ওঠেন। অনেকে ভাবেন, শুধু তার সন্তানই বুঝি এমন দুষ্টুমি করছে।
আসলে বড়দের মতো শিশুরাও চায় নিজের কাজ যেন অন্যের নজরে আসে সহজে এবং প্রশংসা কুড়ায়। যখন বাচ্চাদের আঁকা দেয়ালচিত্র দেখে বাবা-মা নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখান, ওরা আরও উৎসাহি হয়ে ওঠে। অর্থ্যাৎ বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়ার প্রকাশও শিশুদের দেয়ালে আঁকিবুকি কাটার বড় একটি কারণ।
চিন্তামুক্ত হতে প্রথমেই ধোয়ামোছা যায় এমন রঙ বেছে নিন দেয়ালের জন্য। আঁকার রঙ পেনসিল, কলমের কালিও যেন দেয়ালে কাপড় দিয়ে ঘষে দিলে উঠে যায়। এতে করে দেয়াল নিয়ে ভাবনা কেটে যাবে অনেকখানি।
সন্তানের আঁকার আগ্রহ দমাবেন না
দুই বছর বয়সী বিহানের মা দর্শী মোদি সবরকম চেষ্টা চালিয়েছেন দেয়াল আর আসবাবে আঁকা থেকে সন্তানকে নিবৃত করতে।
তিনি বলেন, “এ যেন যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল; ওর (সন্তান) আসবাব, বিছানা, সোফা, দেয়ালে আঁকা থামানো। এরপর সন্তানের শিক্ষকের পরামর্শে বাড়িতে অনেকবার শুধু কাগজে আঁকার কথা মনে করিয়ে দেয়া হয়।”
এতে করে অবশ্য খুব একটা লাভ হয়নি এই মায়ের।
“আমার বাচ্চাও আমার সঙ্গে সঙ্গে বলত, শুধু কাগজে! আর তারপর রান্নাঘরের কেবিনেট রঙ করতে বসে যেত।”
এরপর কলমের বদলে দর্শী সন্তানকে পেনসিল এনে দিয়েছিলেন। তিনি খেয়াল করে দেখলেন, ইজেলে রাখা হোয়াইট বোর্ডে আঁকতে খুব পছন্দ করে বিহান। তারপর আঁকা শেষ করে নিজেই হোয়াইট বোর্ড মুছে ফেলে যত্ন করে।
অভিভাবকদের জন্য ভারতের গুরুগ্রামের কলম্বিয়া এশিয়া হসপিটালের মনোবিদ ও চিকিৎসক শ্বেতা শর্মা বলছেন, “এভাবে আঁচড় কাটা, আঁকিবুকি করা সন্তানের মানসিক বিকাশের আভাস দেয়।
“শিশুরা একটু চঞ্চল হবেই। তাই দেয়ালে আঁকার অভ্যাস নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। ওদের মনোজগতে অনেক কিছু খেলা করে, সেসবই ওরা বড় জায়গায় আঁকার চেষ্টা করে।”
“এই অভ্যাস বরং সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। মনোরোগের চিকিৎসাতেও তো আমরা আর্ট থেরাপি করে থাকি।”
দর্শী শেষ পর্যন্ত সন্তানকে আঁকার জন্য ১৫ মিনিট সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। ‘১৫ মিনিট পর কলম ক্লান্ত হয়ে যায়, ওরা ঘুমাতে চায়’ – এই কথা বেশ কাজে দিয়েছিল।
হোক না দেয়াল, যদি আপনার সন্তান এঁকে আনন্দ পায় তাহলে তার সৃজনশীল দিকের পরিপূর্ণ বিকাশ হতে দিন। কোথায় কী দিয়ে আঁকতে হবে এ নিয়ে ধীরে ধীরে তার মধ্যে পরিবর্তন আনুন। যখন সে পেনসিল হাতে নিচ্ছে, তাকে শিখিয়ে দিন ইরেজার দিয়ে কীভাবে মুছতে হয়। কলমে আঁকা মোছার জন্য ম্যাজিক ইরেজার দিতে পারেন শিশুর হাতে।
দেয়াল মোছার কাজে আপনি হাত লাগাতে পারেন। তবে এই কাজ আপনার সন্তানের সামনে করাই ভালো, যেন সে নিজের দায়িত্ব নিয়ে ধীরে ধীরে বুঝতে শেখে।
সন্তান যত্রতত্র আঁকবে বলে কলম-পেনসিল লুকিয়ে রাখা খুব ভুল হবে। এতে করে বাচ্চা যে কোনো ভাবে এসব খুঁজে বার করার চেষ্টা করে। তারপর যেখানে-সেখানে আঁকাআঁকি শুরু করে।
তাই লুকোচুরি না করে রঙ, কলম, পেনসিল, ইরেজার নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিন সবসময়। এতে করে আপনার সন্তানও যেখান থেকে এসব হাতে নেবে সেখানেই রেখে দেবে।
সন্তান যদি মেঝেতে বসে আঁকাআঁকি করে, তাহলে সহজ উপায় হচ্ছে অনেক বড় কাগজ ও ক্যানভাস মেঝেতে বিছিয়ে দেয়া।
বাচ্চাদের আঁকার ঘর
যদি বড় বাসা হয় অর্থ্যাৎ বেশ কয়েকটি ঘর থাকে তাহলে একটি ঘর অবশ্যই বাচ্চাদের আঁকার জন্য বরাদ্দ করে দিন। শিশুকে বলুন, এই হলো তার ড্রইং স্টুডিও।
নিবেদিতা তার সন্তানকে আঁকার জন্য আলাদা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমার মতে, বাচ্চাদের আঁকাআঁকি নিয়ে একেক অভিভাবকের অভিজ্ঞতা একেকরকম হয়।
“আমি তো আমার মেয়েকে একটি নির্দিষ্ট দেয়াল দিয়েছি ওর আঁকার জন্য। ঘরের সব দেয়ালে যত্রতত্র আঁকাটা আসলে সঠিক মনে হয় না আমার কাছে।”
“আমার মেয়ে অবশ্য দেয়াল কমই আঁকে। ওকে যথেষ্ট পরিমাণে কাগজ, বোর্ড, চক দিয়েছি যেন ও মেঝেতে ছড়িয়ে-বিছিয়ে আঁকতে পারে। অনেক বড় কাগজ দিয়েছি ওকে। আমরা এখনও এভাবে মজা করি।”
একটু সতর্কতা
সন্তানকে কী আঁকছে, কী আঁকতে চায় তা নিয়ে গল্প করুন। সন্তানকে তার নিজের আঁকা ব্যাখ্যা করতে দিন আপনার সামনে। সন্তানের আঁকা দেয়ালচিত্র থেকে তার চিন্তাধারা, ব্যক্তিত্বের গড়ন বোঝা সহজ হবে অভিভাবকের জন্য।
শ্বেতা শর্মা বলছেন, দেয়ালে আঁকছে বলে বাচ্চাদের বকাঝকা দেয়া ঠিক হবে না। তাতে বরং বাচ্চার মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সন্তান দেয়ালে কোন রঙ দিয়ে বেশি আঁকছে তা খেয়াল করুন।
“যদি বাচ্চা কালো রঙ দিয়ে বেশি আঁকিবুকি কাটে, বেশি বেশি আঁচড় কাটে, কাগজে ফুটো করে ফেলে তাহলে বুঝতে হবে কোনো কারণে ওর মন দমে আছে। এসব মানসিক অস্থিরতার লক্ষণ।”
সন্তানকে আঁকার স্বাধীনতা দেয়ার পাশাপাশি একটু নজর রাখতে হবে রান্নাঘরে যেন এই আঁকিবুকি না হয়। দুর্ঘটনা এড়াতেই এই সতর্কতা জরুরি।
ঘরের বাইরে ও ছাদের দেয়ালে, উঁচু জায়গায় অতি উৎসাহি হয়ে আর বড়দের চোখে ফাঁকি দিয়ে আঁকা থেকেও বিরত রাখতে হবে বাচ্চাদের। আর এজন্য ঘরেই বেশি বেশি আঁকার সুযোগ পেলে সন্তানের মধ্যে নিজের দায়িত্বের জায়গা নিয়ে ধারণা গড়ে উঠবে।