Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

হজ নিবন্ধনে কম সাড়া কেন

Hajj
[publishpress_authors_box]

আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে হজে যেতে আগ্রহীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। অক্টোবর পর্যন্ত প্যাকেজ ঘোষণা না করায় তখন হজ নিবন্ধনে সাড়া মিলছিল না। এরপর ৩১ অক্টোবর সরকার আগের বছরের চেয়ে খরচ কমিয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে। এরপর নভেম্বর মাস পার হতে চললেও নিবন্ধনে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।

নিবন্ধনে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হলেও ২৯ নভেম্বর শুক্রবার পর্যন্ত প্রাথমিক নিবন্ধন হয় মাত্র ৩২ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বৃহস্পতিবার (২৮ নভেম্বর) নিবন্ধনের সময় আরও বাড়িয়ে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু তাতে খুব একটা সাড়া মিলবে বলে মনে করছে না হজ এজেন্সিগুলো।

এবার বাংলাদেশ থেকে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যাওয়ার কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছে সৌদি আরব সরকার। ২০২৪ সালে একই কোটা ছিল বাংলাদেশের জন্য। বিপরীতে হজে যান ৮৫ হাজার ২৫৭ জন। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬৭ শতাংশ পূরণ হয়; খালি ছিল কোটার প্রায় ৩৩ শতাংশ।

নিবন্ধন শুরুর প্রায় তিন মাসে সৌদি আরবের বেঁধে দেওয়া কোটার বিপরীতে প্রাথমিক নিবন্ধন হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ। এই অবস্থায় ২০২৫ সালে কোটার সর্বোচ্চ ৫০-৫৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে পারে বলে ধারণা করছে দীর্ঘদিন হজ কার্যক্রমে জড়িত এজেন্সিগুলো।

তাদের ধারণার মিল পাওয়া গেছে হজের প্রাক নিবন্ধনের অগ্রগতি দেখে। সরকারের হজ ব্যবস্থাপনা পোর্টালে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রাক নিবন্ধন হয়েছে ৫৩ হাজার ১৯৯ জনের। আর প্রাথমিক নিবন্ধন হয়েছে ৪১ হাজার ৫৩৬ জন।

এবার হজে যেতে আগ্রহীকে প্রথমেই ৩০ হাজার টাকা দিয়ে প্রাক নিবন্ধন করতে হবে। এরপর প্রাথমিক নিবন্ধনের জন্য ৩ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে তিনি এবার হজে যাবেন।

নিবন্ধনের অগ্রগতি ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩০ হাজার টাকা দিয়ে যে প্রাক নিবন্ধন করতে হয় তাতেই তেমন সাড়া নেই। কোটার বিপরীতে এখন পর্যন্ত প্রাক নিবন্ধন হয়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। এই ৪২ শতাংশ থেকেই প্রাথমিক নিবন্ধন করতে হবে।

কিন্তু নিবন্ধনে সাড়া এত কম কেন– এমন প্রশ্নে একাধিক কারণের কথা বলছে হজ এজেন্সিগুলো। এর মধ্যে অন্যতম মূল্যস্ফীতি চরম আকারে বেড়ে যাওয়া, অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং হজ প্যাকেজ নাগালে না আসা। বিগত সরকারের সময়ের সুবিধাভোগী বিশাল এক গোষ্ঠীর ‘অফ’ হয়ে যাওয়া।

জানতে চাইলে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব), চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হজের ঘোষিত সরকারি প্যাকেজেই শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। যাতে খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি জটিলতা তৈরি হবে।

“এবার হজ প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছে হেরেম শরীফ থেকে ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। এতদূর থেকে মক্কার হেরেম শরীফে প্রতি ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে বাংলাদেশিরা অভ্যস্ত নন। কারণ বাংলাদেশ থেকে যারা যান তারা বয়স্ক, হেরেম শরীফের এক কিলোমিটারের মধ্যেই তারা থাকতে পছন্দ করেন।”

তিনি বলেন, “এবার প্যাকেজে ৪০ দিনের খাবার খরচ যোগ করা হয়নি। যেখানে দিতে হবে ৪০ হাজার টাকার মতো। আবার কোরবানির জন্য ৩০ হাজার টাকা যোগ হয়নি প্যাকেজে। আগে এসব খরচ প্যাকেজে যোগ করা থাকত। ফলে সরকার ঘোষিত প্যাকেজেই বাড়তি ৭০ হাজার টাকা যোগ করতে হবে। কিন্তু ঘোষণার সময় বাহবা নেওয়ার জন্য এক লাখ টাকা খরচ কম দেখানো হয়েছে। যেটাকে আমি শুভঙ্করের ফাঁকি বলছি।”

গালফ ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম বলেন, “৩-৫ কিলোমিটার দূরে থাকার জন্য ৬ জনের জন্য একটি রুম দেওয়া হয়েছে। এখন আপনি যদি দুজনের রুম নেন তাহলে সেখানে খরচ আরও বাড়বে। থাকার ব্যবস্থা করার সেই স্থানে বাঙালি হোটেল নেই। ভাষাগত সমস্যা তো আছেই। এগুলো হজ নিবন্ধনে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।”

তিনি বলেন, “গত বছর প্যাকেজে বিমান ভাড়া দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। আমরা সেটিকে কমিয়ে সোয়া লাখের মধ্যে আনতে বলেছিলাম। কিন্তু সেটি কমিয়ে করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। ফলে যেই খাতে খরচ কমানোর কথা সেখানে কমানো হয়নি।”

শাহ আলম মনে করছেন, হজ নিবন্ধনের শেষ সময় আগামী ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো গেলে কোটার বিপরীতে সর্বোচ্চ ৬৫-৭০ হাজার পর্যন্ত নিবন্ধন চূড়ান্ত হতে পারে। তারপরও গত বছরের চেয়ে হজযাত্রী অনেক কম হবে।

‘রিলিজিয়াস ট্রাভেল’ নিয়ে কাজ করছে চট্টগ্রামভিত্তিক ট্রেফেল ট্যুরস এন্ড সার্ভিস।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ইখতিয়ারুল ইসলাম সাবিত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হজ যারা করতে যান তাদের বিশাল অংশ কয়েক বছর আগে থেকেই পরিকল্পনা করেন। অর্থসংস্থান কোত্থেকে হবে, সেটি নিয়ে আগান। এটা এমন না যে, এই বছর সিদ্ধান্ত নিয়েই এই বছরই যাবেন। ফলে হজ নিবন্ধনে সাড়া কতটা মিলবে সেটি আঁচ করা যায় আগে থেকেই।”

তিনি বলেন, “সামর্থ্য অনুযায়ী হজ করা ফরজ হলেও গত অন্তত তিন বছর ধরেই সেটি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এই কারণে মহান আল্লাহর ঘরের সান্নিধ্য পেতে মুসলমানরা ওমরাহকেই বেছে নিচ্ছেন। দেড় লাখ টাকার মধ্যে একজন মুসলিম সৌদি আরব ঘুরে আসতে পারছেন।”

চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষস্থানীয় হজ এজেন্সির একাধিক মালিক সকাল সন্ধ্যাকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিত্তশালীদের বিশাল অংশ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলেছেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় সরকারি থেকে বেসরকারি অনেকেই হজ করতে আগ্রহী ছিলেন। সেই আগ্রহীদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। তারা নিশ্চিতভাবেই হজে যেতেন। সেই বড় অংশ এবার হজে যাচ্ছেন না।

আবার মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বিশাল অংশ যারা হজে যাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করেছেন তারা মূল্যস্ফীতি, অস্থির রাজনৈতক পরিস্থিতি, ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পারায় সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।

হজ এজেন্সি বিসমিল্লাহ ওভারসিজ অ্যান্ড হজ সার্ভিসের কর্ণধার মোহাম্মদ আবুল আনোয়ার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “একজন চাকরিজীবী অবসরের পর পেনশন নিয়ে হজে যাওয়ার যে পরিকল্পনা করেছেন, তা এবারও বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

“কারণ হজের খরচ তো বাস্তবিক অর্থেই কমেনি। আর পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেই মানুষ এখন জীবনযাপনেই চরম হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়েই ফিরে আসছেন। ফলে তার সিদ্ধান্ত থেকে বাধ্য হয়েই সরে আসছেন।”

তার মতে, তিন লাখ টাকা দিয়ে প্রাথমিক যারা নিবন্ধন করেছেন তারা হজে যাবেন– এটা একেবারে চূড়ান্ত। কারণ, নিবন্ধনের জন্য জমা দেওয়া তিন লাখ টাকা তারা ফেরত পাবেন না।

ধর্ম মন্ত্রণালয় কী বলছে

ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক বলছেন, প্রাথমিক নিবন্ধনে তিন লাখ টাকা যে নেওয়া হচ্ছে সেটি সৌদি আরব অংশেই খরচের জন্য। বাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন খরচের জন্য সেই টাকা সৌদি আরবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠাতে না পারলে সেখানকার কার্যক্রম পিছিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, “এই খরচ যোগানোর জন্য গত বছর ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটা তহবিল ছিল। আমরা সেই তহবিল দিয়েই সামাল দিতাম। এবার সেই তহবিলটা না থাকায় তিন লাখ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে প্রাথমিক নিবন্ধনের জন্য।”

আর কোনোভাবে খরচ কমিয়ে হাজযাত্রীদের স্বস্তি দেওয়া যায় কি না– সরকার তা ভেবে দেখছে জানিয়ে আফতাব হোসেন বলেন, “বিমান ভাড়া রিভিউ করার বিষয়টিও আমরা দেখছি।”

হজের প্যাকেজে খরচ কত

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তৈরি প্রস্তাব অনুযায়ী, এবার কাবা শরিফ ও মসজিদে নববি থেকে দূরে আজিজিয়া এলাকায় বাড়ি নিয়ে থাকার ক্ষেত্রে হজ প্যাকেজে খরচ হবে প্রায় পৌনে ৫ লাখ টাকা। কাছের বাড়ির ক্ষেত্রে খরচ মোটামুটি গত বছরের সাধারণ  প্যাকেজের মতো, পৌনে ৬ লাখ টাকার কাছাকাছি।

ধর্ম মন্ত্রণালয় ৩০ অক্টোবর সরকারিভাবে দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে। ঘোষিত সাধারণ প্যাকেজ-১ অনুযায়ী খরচ ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রায় প্রত্যেক হজযাত্রীর চলতি বছরের প্যাকেজ-১ এর চেয়ে এক লাখ ৯ হাজার ১৪৫ টাকা কম খরচ হবে।

অন্য প্যাকেজে (প্যাকেজ-২) খরচ ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। এসব প্যাকেজে ৪০ দিনে খাবার খরচ এবং কোরবানি খরচ যুক্ত করা হয়নি।

বেসরকারিভাবে ‘সাধারণ হজ এজেন্সির মালিকবৃন্দ’ ব্যানারে প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্যাকেজে খাবার খরচ যুক্ত করে সাধারণ হজ প্যাকেজের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার এবং বিশেষ হজ প্যাকেজ ৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।

আবার ‘বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সি মালিক’ ব্যানারে বেসরকারিভাবে তিনটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের প্রথম প্যাকেজ ধরা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা, দ্বিতীয় প্যাকেজ ৫ লাখ ৮৫ হাজার এবং বিশেষ প্যাকেজ ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ২০২৪ সালে সরকারিভাবে হজে যেতে সাধারণ প্যাকেজে ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮৭ টাকা খরচ হয়েছিল। বিশেষ হজ প্যাকেজ পড়ে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা। কিন্তু এবার বিশেষ প্যাকেজ করা হয়নি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত