Beta
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলাদেশকে পানি দিতে মমতার কেন এত আপত্তি

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে আটকে আছে  তিস্তা চুক্তি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে আটকে আছে তিস্তা চুক্তি।
[publishpress_authors_box]

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্ষমতায় ছিলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বামফ্রন্টের জ্যোতি বসু, যার পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশ। ভারতের যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়াও এই চুক্তির জন্য জ্যোতি বসুর অবদান স্মরণ করেন।

এরপর ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় অভিন্ন আরেক নদী তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের সবই ঠিকঠাক হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিতে ঘটেছে পালাবদল। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে রাজ্যটিতে ক্ষমতায় আসা মমতা আপত্তি তুললে সেই চুক্তি আর আলোর মুখ দেখেনি।

কংগ্রেসের পর বিজেপি সরকার গঠনের পর নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে নানা সময়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির আশ্বাস দিলেও মমতা থাকেন অনড়। ফলে যুক্তরাষ্টীয় কাঠামোয় চলা ভারতে রাজ্যের অমতে মোদীর কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা চুক্তি নিয়ে আর এগোতে পারেনি।

গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছিল ৩০ বছরের জন্য, ২০২৬ সালে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। গঙ্গার পানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল বাংলাদেশের তাই পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতে চুক্তি নবায়নের আগ্রহী।  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে মোদীর সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ওই চুক্তি নবায়নের কথা যেমন উঠেছে, তেমনি তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকার মধ্যে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাংলাদেশের মহাপরিকল্পনায়ও ভারত যুক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়েছে।

নয়া দিল্লিতে হায়দরাবাদ হাউজে শনিবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী। ছবি : পিআইডি

কিন্তু এবারও তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন মমতা। মোদীকে চিঠি দিয়েছেন তিনি; তাতে সাফ বলে দিেয়ছেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারকে পাশ কাটিয়ে ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন কিংবা তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও চুক্তি করলে তা তিনি মানবেন না। এমনকি এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলনও গড়ে তুলবেন।

গত শুক্রবারই দুদিনের সফরে ভারত যান শেখ হাসিনা। তার দুদিনের দিল্লি সফরে মোদীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়।

বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, তার সরকার ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্যও ভারতের একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।

এরপরই সোমবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা দিল্লিতে চিঠি লিখে ‘ফারাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি’ নবায়ন এবং তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী চিঠিতে মমতা লিখেছেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা এবং ফারাক্কার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও চুক্তিতে আমার তীব্র আপত্তি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে কোনও আপস করব না।”

চিঠিতে মমতা আরও লিখেেছন, “গঙ্গা এবং তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হয়ত আপনার (মোদী) কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনও মতামত না নিয়ে এমন একতরফা আলোচনা কাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য নয়।”

তবে মমতা এটাও বলেছেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে তার কোনও শত্রুতা নেই। বরং তিনি প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করেই চলতে চান। ছিটমহল বিনিময়, রেল ও বাস যোগাযোগের মতো পদক্ষেপ নিয়ে তার কোনও আপত্তিও নেই। কিন্তু পানি নিয়ে তিনি কোনও আপস করবেন না।

মমতার ভাষায়, “জল অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণধারণের রসদ নিয়ে কোনও সমঝোতা করতে আমরা প্রস্তুত নই।”

পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে পানি বণ্টনের বিষয়টি ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে চিঠিতে মমতা আরও বলেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনও রকম পরামর্শ ছাড়াই চুক্তিটি নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু কেন্দ্রের এই একতরফা সিদ্ধান্ত মানবে না পশ্চিমবঙ্গ।

তবে মমতার এই দাবি খারিজ করে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি, তিস্তার পানি বণ্টন এবং ফারাক্কা চুক্তি দুটি বিষয়েই অনেক আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানানো হয়েছিল।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সেচের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তা, যা সিকিম পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যমুনার সঙ্গে মিলেছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা নিয়ে প্রথম একটি অস্থায়ী চুক্তি হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। কিন্তু সেটি আর বাস্তবায়ন হয়নি।

এরপর ২০১১ সালে মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির খসড়াও তৈরি হযয়েছিল, যেখানে শুষ্ক মওসুমে ভারতের ৩৭.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৪২.৫ শতাংশ পানি পাওয়ার কথা লেখা ছিল। তখন মমতা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানির যুক্তি দেখিয়ে আপত্তি তোলেন। সেই সফরে মমতাও ঢাকা এসেছিলেন, তবে মনমোহনের সঙ্গে নয়, তিনি আলাদাভাবে কলকাতা থেকে এসেছিলেন।

২০১১ সালে ঢাকা সফরে মনমোহন সিং; তখন তিস্তা চুক্তির খসড়া তৈরি হলেও তা সই হয়নি।

২০১১ সালের পর থেকে তিস্তার পানি একতরফা প্রত্যাহার করছে ভারত। এমনকি অভিন্ন নদীর বিষয়ে আন্তর্জাতিক রীতি না মেনে পানি সরাতে গত বছর উজানে আরও দুটি খাল খননের উদ্যোগ নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

ভারতের জলপাইগুড়ি এলাকা দিয়ে লালমনিরহাট হয়ে বাংলাদেশে ঢোকা তিস্তা শুষ্ক মৌসুমে ভারতের উজানে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে প্রায় শুকিয়ে যায়। আবার বর্ষাকালে যখন নদী উপচে পড়ে, তখন বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যা দেখা দেয়। বর্ষাকালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই পানির চাপ কমাতে গজলডোবা ব্যারেজে ফ্লাডগেট খুলে দেয়।

পানির অপ্রাপ্তি ও বন্যার সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ২০১৯ সালে চীনের সহায়তা চায়। চীন এই প্রকল্পে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয়। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটির জন্য তিস্তা এলাকায় একটি সমীক্ষা সম্পন্ন করে চীন আনুষ্ঠানিক প্রকল্প প্রস্তাবও জমা দিয়েছে।

তবে বাংলাদেশ এখনও চীনকে চুড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে তিস্তার বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে।

এদিকে চীনের ওই বিনিয়োগমূলক অর্থায়ন প্রস্তাব ঝুলে থাকার মধ্যেই তাতে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখালো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। গত মে মাসে ভারত প্রথম এই ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলেও সেসময় এই বিষয়ে কোনও ঘোষণা দেয়নি। গত শনিবারই প্রথম বিষয়টি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। আর তাতেই ফের বাগড়া দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা।

কেন মমতার ঘোর বিরোধিতা

মোদীকে পাঠানো চিঠিতে মমতা লিখেছেন, বাংলাদেশকে কোনোভাবেই তিস্তার পানি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তিস্তার পানি ভাগাভাগি করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ পানীয় জল ও সেচের পানি থেকে বঞ্চিত হবে।

মমতা বলেন, “পানি খুবই মূল্যবান এবং জনগণের জন্য লাইফলাইন। জনগণের ওপর বহুমাত্রিক ও মারাত্মক প্রভাব ফেলা এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে আমরা কোনও ছাড় দিতে পারব না। এ ধরনের কোনও চুক্তি হলে তার ভয়ংকর প্রভাবের শিকার হবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ।”

চিঠিতে মমতা জানান, সিকিমেও তিস্তার ওপর একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করায় নদীর স্বাস্থ্য এখন ভালো নেই। এর ফলে উজানে নদী অববাহিকায় বন কমছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনেও এটি ভূমিকা রাখছে।

“তারপরও বাংলাদেশ অংশে তিস্তার সুরক্ষা ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আগ্রহ দেখিয়েছে কেন্দ্র সরকার। এ কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি, যেখানে তিস্তার উৎসভূমিতে একে রক্ষা করতে এবং ভারতীয় অংশে এর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এখনও কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয় কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।

“এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে যদি তিস্তার পানি ভাগাভাগি করা হয়, তাহলে চাষাবাদের পানির অভাবে উত্তরবঙ্গে (পশ্চিমবঙ্গের) বিপর্যয়কর প্রভাব পড়বে। তাছাড়া পান করার জন্যও উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের তিস্তার পানি খুবই প্রয়োজন। এসব বিষয় মাথায় রেখে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।”

বাংলাদেশে তিস্তার জল শুকিয়ে পড়েছে এমন চরা।

অতীতে সিপিআইএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারও তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করেছিল উল্লেখ করে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস বলেছে, স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের দলের কাছে রাজ্যের মানুষের চাহিদা প্রাধান্য পাবে।

এর আগে ২০১৭ সালে কলকাতার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এ বি পি আনন্দকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও মমতা তার আপত্তির মূল কারণটা কী তা জানিয়েছিলেন।

মমতা বলেছিলেন, “তিস্তা নিয়ে আমার রাজ্যের স্বার্থে যা করার, আমি তাই করব। বাংলাদেশকে আমি ভালবাসি এবং যতটা সম্ভব সাহায্য করব, তবে নিজের রাজ্যকে বাঁচিয়ে।”

মমতা বারবার বলে আসছেন যে, তার রাজ্যের কৃষকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে পানি বণ্টনে তিনি সম্মতি দিতে পারবেন না।

কিন্তু শুধুই কি তাই? নাকি বিজেপির সঙ্গে অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বিরোধও রয়েছে এর পেছনে? অথবা অন্য কোনও কারণ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিবিসি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একাধিক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছিল। বিশ্লেষকেরা এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেন।

পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বিবিসিকে বলেছিলেন, “মমতা ব্যানার্জীর আপত্তির কার‌ণ হচ্ছে তিস্তা চুক্তি হলে পশ্চিমবঙ্গ জলের প্রাপ্য ভাগটা পাবে কী না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা।

“তিস্তা অববাহিকার ওপরের দিক থেকে সেই পরিমাণ জল নিশ্চিত করা যাবে কি না? বাংলাদেশকে যে পরিমাণ জল দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা তখনই সম্ভব যদি পাহাড়ি এলাকায়, সিকিমে, জল বেশি থাকে। সেটা কিন্তু নেই।”

বিশ্লেষকদের কেউ আবার বলছেন, তিস্তার পানি কী হিসাবে দুদেশের মধ্যে ভাগ হবে, তার জন্য যে পরিসংখ্যান দরকার, তাও নেই। যদিও কিছু তথ্যানুসন্ধান করা হয়েছে ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে।

কলকাতার মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ড. শ্রীরাধা দত্ত বলেছিলেন, “যখন তিস্তা চুক্তি হতে চলেছিল, তখন জলপ্রবাহের সঠিক পরিমাণ আমাদের জানা ছিল না। সবসময়েই নদীর জলপ্রবাহের ক্ষেত্রে ৩০ বছরের একটা গড় হিসাব করা হয়। যে হিসাব এখন আছে, সেটা অনেক পুরনো।

“সেই সময়কার হিসাব নিয়ে এখন এগোতে যাওয়া সমীচীন নয়। জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে, পরিবেশগত বিষয় রয়েছে, জলপ্রবাহে বদল ঘটেছে। তাই পুরনো নথি বা হিসাবের ওপরে ভিত্তি করে চুক্তি সই করা বোধহয় ঠিক হবে না।”

তিনি আরও বলেছিলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করেছে। কিন্তু তা এখনও জনসমক্ষে আনা হয় নি।

ইনস্টিটিউট অব ফরেন পলিসি স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জয়ন্ত রায়ের মতে, যথেষ্ট তথ্য আর পরিসংখ্যান না থাকলে চুক্তি করা হলেও সেটা কোনও দেশের জন্যই ভালো হবে না।

তার কথায়, “গঙ্গার জল বণ্টন চুক্তি হওয়ার সময়ে আমাদের হাতে প্রচুর তথ্য পরিসংখ্যান ছিল। কিন্তু তিস্তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। খুবই কম তথ্য রয়েছে তিস্তার জলপ্রবাহ নিয়ে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে তিস্তার জলপ্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ। এই অবস্থায় জল বণ্টন হলেও কারও যে লাভ হবে, তা মনে হয় না। শতকরা ৫০ ভাগ জলও যদি আমরা দিয়ে দিই, তাতে যে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে, তা মনে হয় না।”

অধ্যাপক রায়ের পরামর্শ, উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু মজে যাওয়া নদী বা খাল যদি সংস্কার করা যায় এবং নতুন করেও কিছু খাল খনন করা যায়, তাহলে তিস্তায় জলের প্রবাহ অনেক বাড়বে। জলের অভাব হবে না আর।

সিকিমের পাহাড়ি এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে তিস্তা নদী।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী বলেছিলেন, তিস্তা সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারের উচিৎ হবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সিকিমকেও এই আলোচনায় যুক্ত করা।

তিনি বলেন, “তিস্তা নদী সিকিম পাহাড় থেকে নেমে এসে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে যায়। ফলে তিস্তার জল বণ্টনে পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিমকে যুক্ত করা বাঞ্ছনীয় ছিল। যদি আগাম আলোচনা হয়, তাহলে সমস্যা মিটতে দেরী হওয়ার কথা নয়। এটাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করছেন। একটা কথা তো ঠিক, এ রাজ্যে যে সরকারই থাকুক, এখানকার কৃষকদের স্বার্থ তো তারা দেখবেই।”

কিন্তু শুধুই কি উত্তরবঙ্গের বিপুল সংখ্যক কৃষকদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই মমতা এই তিস্তা জল বণ্টন নিয়ে বিরোধিতা, যার জেরে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সম্পর্কে একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে?

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এমনও বলছেন, মমতার বিরোধিতাটা রাজনৈতিক কারণেও হতে পারে। তিনি দিল্লিকে চাপে রাখার একটি কৌশল হিসাবে এটাকে ব্যবহার করতে পারেন।

মমতার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তার তিস্তা চুক্তির বিরোধিতাকে একটি রাজনৈতিক চমক হিসাবে দেখেন। তাই অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে আন্তঃরাষ্ট্রীয় পানি সহযোগিতা এখন জটিল আকার ধারণ করেছে।

ভারতের সংবিধানে বিদেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ ও চুক্তির ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ফলে রাজ্যকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে চুক্তিটি করা সম্ভব। কিন্তু এর রাজনৈতিক ঝুঁকি আছে। আর এ জন্যই বিজেপি বা এর আগে কংগ্রেস সরকারও তিস্তা চুক্তি সই করেনি।

গঙ্গা নিয়েও বাগড়া মমতার

বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত শুধু গঙ্গা পানিচুক্তি করা গেছে, যা ফারাক্কা চুক্তি নামে পরিচিত। ২০২৬ সালে চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে এবং শেখ হাসিনার এবারের সফরে উভয় দেশই ফারাক্কা চুক্তি নবায়নের সিদ্ধান্তও নিয়েছে।

গত শনিবার নয়াদিল্লিতে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিটি নবায়নের আলোচনা শুরুর জন্য একটি ‘যৌথ কারিগরি কমিটি’ গঠনের ব্যাপারে সম্মত হন দুই দেশের সরকারপ্রধান। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে শনিবার ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন। কিন্তু মমতা এবার এই চুক্তি নবায়নেরও বিরোধীতা করছেন।

পশ্চিমবঙ্গের অবকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফারাক্কা বাঁধ, যা দিয়ে গঙ্গার পানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয় এবং হুগলি নদীতে পানি সরানো নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। গঙ্গার পানি কলকাতা বন্দরের কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং কলকাতাসহ হুগলি-ভাগীরথী নদীর তীরে শহুরে বসতিগুলোর পানির চাহিদা পূরণ করে।

গঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে নাম নিয়েছে পদ্মা; শুষ্ক মৌসুমে এমন চর জাগে পদ্মায়।

ভারতের এই গঙ্গা চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে নাম হয়েছে পদ্মা। এরপর এটি রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, চাঁদপুর হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। বাংলাদেশের উত্তর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার প্রাণ-প্রকৃতির জন্য এই নদীর পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু মমতার অভিযোগ ফারাক্কা চুক্তির কারণেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। বহু বছর ধরে ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশে নদীর গতিপ্রকৃতি বদলে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে মমতা সোমবারের চিঠিতে লিখেছেন, “গত ২০০ বছর ধরে গঙ্গা পূর্বমুখী হওয়ায় কয়েকটি নদীর সঙ্গে এর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। জলাঙ্গি ও মাথাভাঙ্গা তার মধ্যে দুটি নদী, যারা পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গেছে।”

মমতার আরও দাবি, ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প শুরু করায় ভাগীরতী নদী গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ প্রকল্পের আওতায় কলকাতা বন্দরের জন্য ৪০ হাজার কিউসেক পানি দেওয়ার জন্য একটি খাল খনন করার কথা। ব্যারেজ নির্মাণের পর গত কয়েক বছর ধরে হুগলি অংশে পানির প্রবাহ কমে গেছে।

মমতা বলেন, গঙ্গায় দীর্ঘদিন ধরে খনন হচ্ছে না, সংস্কার হচ্ছে না। ফলে বাংলায় বন্যা ও ভাঙনের মতো সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। উজানে ও ভাটিতে নদী ভাঙনে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে বহু মানুষ; জীবিকাও হারিয়েছে অসংখ্য।

তৃণমূল কংগ্রেসের বিশেষজ্ঞরাও বলেছে, এই চুক্তি নবায়ন হলে মধ্যপশ্চিমবঙ্গের মালদা ও মুর্শিদাবাদের নদীয়ায় বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।

হিমালয় থেকে উৎপত্তির পর ভারতে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে গঙ্গা নদী।

ফারাক্কার বাঁধকে মুর্শিদাবাদ ও মালদায় গঙ্গার ভাঙনের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তৃণমূল কংগ্রেসের দাবি, ২০১৭ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও ফরাক্কার বাঁধের বিরোধিতা করেছিলেন। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, বেড়িবাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে সেসময়ের ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতি ও নদীভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্র। তবে তা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ মমতার।

এসব বিষয় তুলে ধরে এর আগেও তিনবার প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি দেওয়ার কথা সোমবারের চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী।

চিঠির শেষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে মোদীকে সতর্ক করে মমতা বলেছেন, তিস্তার পানি ও ফারাক্কা চুক্তি নবায়ন বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া যেন কোনও কিছু না করা হয়।

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, স্ক্রল ডট ইন, ট্রেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত