গত শতকের আশি এবং নব্বই দশক গোটা পৃথিবী যার গানে নেচেছিল তার নাম মাইকেল জ্যাকসন। ‘কিং অব পপ’ খ্যাত এই মহাতারকার মৃত্যু ঘটে ২০০৯ সালের ২৫ জুন ৫০ বছর বয়সে। মাইকেল শুধু গায়কই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেতা।
মাইকেল জ্যাকসনকে শুধু বিনোদন শিল্পীর ফর্মুলার খাপে আটকে ফেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কেননা এই শিল্পীর গানে উঠে এসেছিল রাজনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশ সংকটের নানা কথা। আর এ কারণেই তার সময়ের চাইতে যোজন যোজন এগিয়ে ছিলেন কিংবদন্তি এই শিল্পী। জ্যাকসনের ‘আর্থ সং’ গানটির কথাই ধরা যাক না। পপের সুর যে বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটকেও তুলেও ধরতে পারে তার প্রমাণ মাইকেল জ্যাকসনের দারুণ জনপ্রিয় এই গান।
সারা বিশ্বের জাতিগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে তুলে ধরা মাইকেল জ্যাকসনের এমন কিছু গান সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
ব্ল্যাক অর হোয়াইট
১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘ডেইঞ্জারাস’ অ্যালবামে ছিল এই সামাজিক সচেতনতামূলক গান। জাতিগত এবং বর্ণবাদমূলক বৈষম্য নিয়ে এই গান নির্মাণ করা হয়। মাইকেল জ্যাকসন সফলভাবে বর্ণবাদী বৈষম্যকে এই গানে চিত্রিত করতে পেরেছিলেন। গানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বর্ণবাদমুক্ত এক পৃথিবীর স্বপ্ন। দুঃখজনক হলেও, আজও গানটি একইভাবে প্রাসঙ্গিক।
ম্যান ইন দ্য মিরর
তর্কহীনভাবেই জ্যাকসনের অন্যতম সেরা গান ‘ম্যান অব দ্য মিরর’। প্রতিটি মানুষের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে নিজের অন্তরের গহীনে ডুব দেওয়ার আহবান আছে এই গানে। প্রতিটি মানুষের কাছে অন্যের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল হবার ডাক দিচ্ছে এই গান। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব সংগ্রামকে উপলব্ধি করে সমব্যথী হবার আবেদন আছে ‘ম্যান ইন দ্য মিরর’ এ।
হিল দ্য ওয়ার্ল্ড
কবি নবারুণ ভট্টাচার্য তার কবিতায় বলেছিলেন- “একদিকে চাষীরা মার খাচ্ছে, অন্যদিকে উনারা দাঁত কেলাচ্ছে, কবিতা পাঠ করছে, বান… মানুষ না অ্যামিবা?”
অন্যদিকে মাইকেল জ্যাকসনের এই গান আমাদের বলছে-
“দেয়ার আর পিপল ডায়্যিং
ইফ ইউ কেয়ার ইনাফ ফর দ্য লিভিং”
ঠিক যেন কবি নবারুণের কথাই ধরা পড়েছে এই গানে। বাঙালি কবি নবারুণ যে কথা বলছেন রূঢ় ভাষায়, সেই একই কথা ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’ আমাদের বলছে শান্ত অথচ করুণ ভঙ্গিতে।
মানুষ মরছে যুদ্ধ, আগ্রাসন, দখলদারত্ব এবং দাঙ্গায়। আমাদের নির্লিপ্ত থাকাই কি এর অন্যতম কারণ নয়?
এমন প্রশ্ন সারা বিশ্বের দিকে ছুড়ে দেয় এই গান।
দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস
মাইকেল জ্যাকসনের ‘দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস’ অত্যন্ত শক্তিশালী এক দ্রোহী গান। যে গানে উঠে এসেছে সামাজিক অবিচার, বৈষম্য এবং এসব বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রের নির্লিপ্ত থাকার কথা।
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত মাইকেল জ্যাকসনের ‘হিস্ট্রি : পাস্ট, প্রেজেন্ট এবং ফিউচার, বুক ওয়ান’ অ্যালবামে গানটি স্থান পায় এবং পরবর্তীতে তার অন্যতম জনপ্রিয় গানে পরিণত হয়।
গানটি মূলত রাষ্ট্রের কাঠামোগত নিপিড়নের বিরুদ্ধে হতাশা এবং ক্রোধের প্রকাশ। এ প্রসঙ্গে গানের “স্কিন হেড, ডেড হেড, এভ্রিবাডি গন ব্যাড” অংশটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘স্কিন হেড’ হলো শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা আর ‘ডেডহেড’ বলতে ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘বখে যাওয়া’ ওইসব তরুণদের, যারা কনসার্টে টিকেট ছাড়াই প্রবেশ করতে চায়, গণপরিবহনে চড়তে চায় ভাড়া ছাড়াই। আসলে এরা সবাই রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে হাজির থাকা বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার। এই গান অন্তত তাই বলতে চাইছে। রাষ্ট্র ধারণার মধ্যেই শ্রেষ্ঠত্য অর্থাৎ সমাজে কেউ ‘উঁচু’ তো কেউ ‘নিচু’ এমন দৃষ্টিভঙ্গি গেঁথে আছে বলেই তরুণদের মধ্যে জন্ম নেয় শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ। অন্যদিকে যথেষ্ট সামাজিক সুযোগ সুবিধা, এবং শিক্ষার অভাব কাউকে বাধ্য করছে ‘ডেডহেড’ তকমা বরণ করে নিতে। ঢাকাই বাংলায় একে ‘ছাপড়ি’ও বলেন কেউ কেউ। সমাজে এদের বলা হয় এই গানের মতোই ‘গন ব্যাড’ অথবা ‘বাতিল’।
আর্থ সং
মাইকেল জ্যাকসনের ‘আর্থ সং’ও তার ‘হিস্ট্রি : পাস্ট, প্রেজেন্ট এবং ফিউচার, বুক ওয়ান’ অ্যালবামের অন্যতম আলোচিত এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী গান। যে গান তুলে ধরেছিল বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি। এই গানে জ্যাকসন পৃথিবীকে এবং প্রাণ প্রকৃতিকে এক জীবিত সত্ত্বা হিসেবে উপস্থান করেছেন। আজও বিষয়টি এতই প্রাসঙ্গিক যে, এ নিয়ে লেখা হচ্ছে পাতার পর পাতা নিবন্ধ। অথচ মাইকেল জ্যাকসন বহু আগেই মাত্র একটি গানে দেখিয়েছেন পৃথিবী নামক গ্রহটির দুর্গতি। দেখিয়েছিলেন প্রাণ ও প্রকৃতির হাহাকার।
বিট ইট
জ্যাকসনের অ্যালবাম ‘থ্রিলার’ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। আর এই অ্যালবামের হিট গান ‘বিট ইট’। গত শতকের আশি-নব্বই দশকে গ্যাং ফাইট ছিল আমেরিকার এক নিত্য বিষয়। গানের বিষয়বস্তুও তাই। গানের মিউজিক ভিডিওতে দেখা যায় দুটো গ্যাং এর সদস্যরা সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে। যদিও গানের শেষদিকে দুই গ্রুপের সদস্যরাই একত্রে নাচে যোগ দেয়। অনেকের মতে, সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে কোন সমাধান সম্ভব নয় এমন বোঝাতেই গানের এমন সমাপ্তি দেখানো হয়েছে।