Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

ম্যাজিক হারানো মোদী এবার চলবেন কীভাবে

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের জয়ের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদযাপন। ছবি: রয়টার্স।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের জয়ের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদযাপন। ছবি: রয়টার্স।
[publishpress_authors_box]

ধারণার চেয়েও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদী। আগের দুবার তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার চালিয়েছিলেন, তবে এবার এককভাবে সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার দল পায়নি।

লোকসভার ৫৪৫ আসনের মধ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন ২৭২টি আসন। কিন্তু বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি আসন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট অবশ্য সম্মিলিতভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন পেয়েছে। এনডিএ জোটের মোট আসন সংখ্যা ২৯৩টি। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ২৩৫টি আসন।

জিতলেও এই ফলাফল মোদীর জন্য একটি বড় আঘাত। এর আগে তিনি গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যত নির্বাচন করেছেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। সেই সঙ্গে গত এক দশক ধরে দেশটির জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন।

ভারতের জনগণের এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি ও এর নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের চমকপ্রদ পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। এই নির্বাচনে কংগ্রেসের চূড়ান্ত পতন নিয়ে সব ভবিষ্যদ্বাণী এবং বুথফেরত ও নির্বাচনপূর্ব জরিপগুলোর ফলাফল ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

বিশ্বের অনেক নেতাকেই তাদের তৃতীয় দফার নির্বাচনে কষ্ট করে হামাগুড়ি দিয়ে শেষ লাইন পেরোতে হয়েছে। মোদীও এখন তাদেরই একজন। অবশ্য, আসনের দিক থেকে বিজেপি এখনও ভারতের একক বৃহত্তম দল হিসেবেই রয়ে গেছে।

মিত্রদের সমর্থনে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া প্রায় নিশ্চিত করেছেন মোদী, তাহলে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের একজন এবং দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ডে ভাগ বসাবেন।

ভারতে এর আগে একমাত্র নেহরুই টানা তিনবার পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং টানা ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আর মেয়াদ সম্পন্ন করলে মোদী ক্ষমতায় থাকছেন টানা ১৫ বছর।

কিন্তু তার দল গতবারের চেয়ে এবার ৬৩টি কম আসন পাওয়ায় তার তৃতীয় মেয়াদের উজ্জ্বলতা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। মোদী এবার তার দল বিজেপির জন্য এককভাবে ৩৭০ আসনে আর জোটগতভাবে ৪০০ আসনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। সে হিসাবে দলগতভাবে ২৪০ আর জোটগতভাবে ২৯৩ আসন অনেক কম অর্জন।

এই ফলাফল কংগ্রেস শিবিরে উল্লাস এবং বিজেপি মহলে কিছুটা হতাশা তৈরি করেছে। বিজেপি একক বৃহত্তম দল হিসেবে থাকা সত্ত্বেও প্রচার এবং প্রত্যাশার বোঝা তাদের অনেক সমর্থককে হতাশ করেছে।

মোদীর সমর্থকদের বিশ্বাস, তার নেতৃত্বাধীন জোটের তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভের পেছনে কয়েকটি বিষয় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। যেমন, মোদী সরকারের স্থিতিশীল শাসনের রেকর্ড, ধারাবাহিকতার আবেদন, কার্যকর জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং এই উপলব্ধি যে, তিনি ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি উন্নত করেছেন।

এছাড়া মোদী তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের দেওয়া প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলোও পূরণ করেছেন। যেমন, ভারত-শাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার ও অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ এবং বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন করেছেন। বিজেপিশাসিত অনেক রাজ্যেই হিন্দু-মুসলিম বিয়ে তথা আন্তঃধর্মীয় বিয়ে বন্ধেও কঠোর আইন করা হয়েছে।

তারপরও বিজেপির আসন কমার উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে বেকারত্ব বাড়া, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগ ব্যবস্থার বিতর্কিত সংস্কার। মোদীর বিভাজনমূলক সাম্প্রদায়িক প্রচার, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা-বার্তাও কিছু কিছু অঞ্চলে তার ভোট কমার একটি কারণ ছিল।

মোদীর উচ্চাভিলাষী স্লোগান ‘আবকি বার, ৪০০ পার’ তথা তার এনডিএ জোটের জন্য ৪০০টিরও বেশি আসনের লক্ষ্য নির্ধারণও হয়ত দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংবিধানিক পরিবর্তনের ভয় জাগিয়েছে।

চারশর বেশি আসন পেলে মোদী নিজের ইচ্ছামতো ভারতের সংবিধানকেই বদলে ফেলতে পারতেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, এমন সুযোগ পেলে মোদী শুধু ধনিক শ্রেণি এবং উচ্চ বর্ণের মানুষদেরই সুবিধা করে দেবেন। বঞ্চিত হবে কৃষক-শ্রমিকসহ নিম্ন বর্ণ, সংখ্যালঘু ও অবেহেলিত জাত-পাতের মানুষরা।

‘চারশে পার’ স্লোগান দেওয়ার পর থেকেই বিরোধী নেতারাও ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে আসছিলেন, এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী আসলে কী করতে চান? তার উদ্দেশ্যটা কী?

তার মধ্যেই কর্নাটকে বিজেপির তখনকার এক এমপি বলে বসেন, ‘চারশো পার’ আসন পেলে তাহলেই দল প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধন করতে পারবে এবং হিন্দুরাষ্ট্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সফলভাবে এগোতে পারবে। যদিও পরে বিজেপি সেই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে।

ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা জরুরি। লোকসভার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৩৬১ বা তার কাছাকাছি।

মোদীর দল সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে উত্তর প্রদেশে (ইউপি)। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এই রাজ্যে সংসদীয় আসনও সবচেয়ে বেশি। ৮০টি আসনের উত্তর প্রদেশ দেশটির কেন্দ্রে কে সরকার গঠন করবে, তা ঠিক করে দেয় বরাবরেই। দিল্লির প্রবেশদ্বারও বলা হয় উত্তর প্রদেশকে।

উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির নিম্নবর্গের, পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত ও মুসলমানদের মতো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের প্রার্থী করার কৌশলের কাছে পরাস্ত হয় বিজেপি।

তাহলে, এই নির্বাচনের ফলাফল কী কী বার্তা দিচ্ছে?

জৌলুশ হারিয়েছে ‘মোদী ব্র্যান্ড’

মোদীর জনপ্রিয়তার পেছনে তার নিজেকে ব্র্যান্ডিং করার দক্ষতা, সাধারণ সাফল্যকেও অসাধারণ করে তুলে ধরা এবং চতুর বার্তা দেওয়ার সক্ষমতাও অবদান রেখেছে। দুর্বল বিরোধী দল ও বন্ধুসুলভ গণমাধ্যমও তার মোদী ব্র্যান্ডকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে।

এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বলছে, মোদী ব্র্যান্ড তার সেই জৌলুশ হারিয়েছে। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে যে, মোদি অজেয় নন। অন্য কথায়, তার সমর্থকরা তাকে যতটা অপ্রতিরোধ্য ভেবেছিল আদতে তিনি ততটা অপ্রতিরোধ্য নন। এটি বিরোধীদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

জোটের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন

ভারতে বিশৃঙ্খল জোট সরকারের দীর্ঘ অতীত ইতিহাস রয়েছে। যদিও সেসব সরকার ১৯৯০ এবং ২০০০ এর দশকের প্রথম দিকে অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

এবার যদি বিজেপি সরকার গঠন করে তাহলে দলটিকে অনেকটাই মিত্রদের উপর নির্ভর করতে হবে। এজন্য দলটিকে আরও পরামর্শমূলক এবং সুচিন্তিত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

মিত্ররা অবহেলিত বোধ করলেই এই নির্ভরতা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর সর্বশক্তিমান হিসেবে বিবেচিত দলটি এবার মিত্রদের সমর্থন ছাড়া সরকারই গঠন করতে পারবে না।

বিজেপির আধিপত্যের ভিত নড়বড়ে

মোদীর নিরবচ্ছিন্ন এক দশক-ব্যাপী শাসনের ফলে অনেক রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ভেবেছিলেন ভারতে হয়তো ফের দীর্ঘদিনের জন্য একদলীয় আধিপত্য শেকড় গেড়ে বসবে।

এক দলীয় আধিপত্যের পাঁচটি মূল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা, সম্পদ এবং যোগাযোগের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, অতুলনীয় সাংগঠনিক কাঠামো এবং বিশৃঙ্খল বিরোধী দল। জনগণের স্বাধীনতা কমে যাওয়াও একদলীয় আধিপত্য ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য। মোদীর শাসনে এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট হয়ে উঠেছিল।

তবে মোদীর বিজেপিই ভারতের রাজনীতিতে এককভাবে আধিপত্য করা প্রথম দল নয়। স্বাধীনতার পর বহু বছর কংগ্রেস ভারতকে বিরতিহীনভাবে শাসন করেছে। মঙ্গলবারের নির্বাচনের ফলাফল ভারতকে অনেকটাই ‘স্বাভাবিক রাজনীতিতে’ ফিরিয়ে এনেছে। এর ফলে দেশ পরিচালনায় একাধিক দল থাকবে এবং ক্ষমতার জন্য বহুমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হবে।

পুনরুজ্জীবিত বিরোধী দল

এই নির্বাচনের ফলাফল বহুল সমালোচিত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটকেও শক্তি যোগাবে।

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (INDIA- ইন্ডিয়া) বা ভারতীয় জাতীয় উন্নয়নকামী অন্তর্ভুক্তিমূলক জোট রাজনৈতিকভাবে একটি বৈচিত্র্যময় জোট।

গত ফেব্রুয়ারিতে জোটটি এর অন্যতম প্রধান নেতা নীতিশ কুমারের প্রস্থানে কিছু সময়ের জন্য বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হয়েছিল। নীতিশ পরে বিজেপিতে যোগদান করেন।

কিন্তু রাহুল গান্ধীর কৌশলী ও নিবেদিত প্রাণ নেতৃত্বের কারণে জোটটি ভেঙে পড়েনি এবং নির্বাচনী প্রচারণায়ও উৎসাহ হারায়নি। গত প্রায় দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের মধ্যেও প্রাণ ফেরান।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করে কাশ্মীর পর্যন্ত একটানা পাঁচ মাস ধরে রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ বেশ সাড়া ফেলেছিল। পাশাপাশি রাহুল গান্ধী যে রাজনীতিবিদ হিসেবেও আন্তরিক, তার সেই নতুন পরিচিতিটাও ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল।

পরে দেশের পূর্বে মণিপুর থেকে পশ্চিমে মুম্বাই পর্যন্ত সেই পদযাত্রারই দ্বিতীয় পর্ব, ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ও যথেষ্ট সফল ছিল।

রাহুল তখন প্রায়ই বলতেন, বিজেপির ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি ‘মহব্বত কা দুকান’ (ভালোবাসা বিলি করার দোকান) খুলতে চান। তার এই ভাবনাটাকে ভারতের জনগণের একটা বড় অংশের মানুষ যে সাদরে মর্যাদা দিয়েছিলেন তার প্রমাণই মিলল এবারের নির্বাচনে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ভারত জোড়ো যাত্রার শেষ পর্যায়ে কাশ্মীরের শ্রীনগরে রাহুল গান্ধী।

সবমিলিয়ে বিজেপির প্রতি পক্ষপাতপ্রবণ গণমাধ্যম এবং কম সম্পদ ও লোকবল নিয়েও ইন্ডিয়া জোট নির্বাচনের ফলাফলে ব্যবধান অনেক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।

তাদের জন্য সামনে আরও আশা আছে। ভারতের ৪ হাজারের বেশি রাজ্য বিধানসভা আসনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ এখন বিজেপির দখলে। তারা এই লোকসভা নির্বাচনের আগে আঞ্চলিক দলগুলোর কাছেও হেরেছে। আগামী ১৪ মাসে আরও পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে। সবকটিতেই বিজেপি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে।

এবছর মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবে। দিল্লির আসন্ন নির্বাচনও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। অক্টোবরে বিহারও বিজেপির সামনে একটি আঞ্চলিক বাধা উপস্থাপন করতে পারে।

মোদীর তৃতীয় মেয়াদের পরিণতি কী হতে পারে

ভারতকে এখনও অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশটির এখনও অনেক কাজ এবং সমস্যার সমাধান বাকী আছে।

উচ্চ সরকারি ব্যয়ে চালিত অর্থনীতি প্রতি বছর প্রায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে দ্রুত গতিতে উন্নতি লাভ করছে সত্য। কিন্তু অন্যদিকে, আবার আর্থ-সামাজিক বৈষম্যও বাড়ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ এবং খরচ বাড়াতে হবে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তাদের আয়ও বাড়াতে হবে।

পর্যাপ্ত চাকরি না থাকলে সেটাও হবে না। উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং হতাশার মধ্যে খাবি খাওয়া একটি দেশে তরুণ ভোটাররা বিজেপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। দেশটির ১৪৪ কোটি মানুষের প্রায় দুই-পঞ্চমাংশের বয়স ২৫ বছরেরও কম।

মোদী ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ উস্কে দেওয়ার অভিযোগেও সমালোচনার মুখে পড়েছেন। তার সময়ে মুসলমানরা ব্যাপক সহিংসতার শিকার হয়েছে। তার সরকার ভিন্নমত দমনের অভিযোগের মুখোমুখিও হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় বিরোধী ব্যক্তিদেরকে ঠুনকো অভিযোগেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তথাপি তৃতীয় মেয়াদ বিশ্বের অনেক নেতার জন্যই কঠিন প্রমাণিত হয়েছে। অভূতপূর্ব এবং অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দীর্ঘমেয়াদি সরকার এবং তাদের পরিকল্পনাগুলোকেও উড়িয়ে দিয়েছে।

মোদীর জন্য বড় সতর্কতা সংকেত

২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদী এমন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, যা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচির পাশাপাশি মোদীর প্রবল হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শও তার জনপ্রিয়তায় অবদান রেখেছে।

মোদীর নেতৃত্বে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি এবং একটি আধুনিক বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তি এবং মহাকাশেও অগ্রগতি অর্জন করেছে। তথাপি এই সাফল্য সত্ত্বেও দারিদ্র্য এবং যুবকদের বেকারত্ব বজায় রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। আর ধনী গরীবের সম্পদের ব্যবধানও বেড়েছে অনেক।

মোদী আগামী ১ হাজার বছরের জন্য ভারতের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেন এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে এটিকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে চান। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশকে তিনি একটি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষাও স্পষ্ট করেছেন। এবার নির্বাচনের আগে মসজিদের জায়গায় মন্দিরও উদ্বোধন করেন মোদী।

তবে নয়া দিল্লি ভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষ্যকার আরতি জেরাথ বলেছেন, “এবারের লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কার পর মোদীকে এখন তার সমস্ত উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় কিছুটা ধীর গতিতে এগোতে হবে। বিশ্ব মঞ্চে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে সামনে ঠেলে দিতে তাকে সাবধানে চলতে হবে। তিনি নিজ ঘরেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।”

সমালোচকদের মতে, মোদির শাসনের এক দশকে ধর্মীয় মেরুকরণ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ইসলামভীতি দেশের ২০ কোটিরও বেশি মুসলমানকে প্রান্তিক করে দিয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার দীর্ঘ ইতিহাস থাকা একটি দেশে ধর্মীয় সহিংসতা আরও বেড়েছে।

নির্বাচনী প্রচারণা সময় মোদী বারবার ইসলামবিদ্বেষী বয়ান ব্যবহার করে এবং শতশত বছর ধরে ভারতে বসবাস করা মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে তীব্র বিতর্কের জন্ম দেন।

মঙ্গলবারের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, বিপুল সংখ্যক ভোটার এই ধরনের নির্লজ্জ বাগাড়ম্বর প্রত্যাখ্যান করেছে।

এই নির্বাচনে ভারতের জনগণের একটি বিশাল অংশ বার্তা দেয় যে, তারা বিজেপির টানা ১০ বছরের শাসনে ক্লান্ত এবং পরিবর্তন চায়।

বিজেপি তার জোট শরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেও নির্বাচনটি মোদীর জনপ্রিয়তার একটি রিয়েলিটি চেক বা বাস্তবতা পরীক্ষা হিসেবেই রয়ে যাবে।

ভারতের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর একজন সিনিয়র ফেলো নীলাঞ্জন সিরকার বলেন, “এই নির্বাচন অনেকটা এমন একজন নেতার জন্য একটি জেগে উঠার ডাক, যিনি এখনও খুব জনপ্রিয়। তথাপি অনেক ভোটার মনে করেন যে, জনপ্রিয়তার জোরে তিনি কিছুটা সীমা অতিক্রম করে গেছেন। তাকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলতে দিলে ভারতের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রও অস্তিত্বের ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে।”

তথসূত্র : বিবিসি, সিএনএন

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত