দেশের মানুষের খাদ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সবজির মধ্যে আলু অন্যতম, যার দাম গত এক বছরে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কোরবানির ঈদের ছুটির পর ঢাকার বাজারগুলোতে খুচরায় আলু কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা পর্যন্ত। যদিও গত বছরের জুনে পণ্যটির দাম ছিল এর প্রায় অর্ধেক।
গত বুধবার (১৯ জুন) থেকে দেশের বিভিন্ন পাইকারি হাট ও বাজারে যে আলু বেচাকেনা হচ্ছে, তা দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার। ওই অঞ্চলের আড়ৎদাররা আলু পাইকারিতে ৪৭-৪৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। ঢাকার পার্শবর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জের হাট-বাজারে পাইকারিতে ৪২-৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এসব আলুই ঢাকার শ্যামবাজার ও কারওয়ান বাজারসহ প্রধান প্রধান পাইকারি বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৬ টাকা কেজি। আর ঢাকার বিভিন্ন কাঁচাবাজার ও পাড়া-মহল্লার মুদি দোকানগুলোতে খুচরা পর্যায়ে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৫-৭০ টাকা কেজি দরে।
সাদা (ডায়মন্ড) ও লাল ( কার্ডিনাল ও স্টিক আলু বলে পরিচিত) আলুর দাম সব এলাকায় পাইকারিতে যেমন এক, তেমনি খুচরায়ও তেমন।
ঢাকার রায়ের বাজার বেড়িবাধ সংলগ্ন সাদেকখান কৃষি মার্কেটের আড়ৎদার ছলেমান হাওলাদার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনও বাজার জমেনি। ঈদের পর অল্প কিছু আলু উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছে। দাম ঈদের আগে যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে।”
রাজশাহীর আলু ব্যবসায়ী ভাই-ভাই এন্টারপ্রাইজের মালিক আ. মতিন বলেন, বর্তমানে মোকামে ৪৭ টাকা দরে সাদা ও লাল আলু বিক্রি হচ্ছে। ঈদের আগে থেকেই আলুর এই দাম রয়েছে। সপ্তাহ খানেক পরে আলুর নতুন দাম নির্ধারণ হতে পারে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন মাসে খুচরা পর্যায়ে আলুর দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৫-৩৮ টাকা। সে অনুযায়ী, গত এক বছরে আলুর দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
এর কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের যুক্তি- এবার ফলন কম। তারা বলছেন, চলতি বছর আলুর ফলন কিছুটা কম। একারণে মৌসুমের শুরু থেকেই আলুর দাম কিছুটা চড়া। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ১ কোটি ১৬ লাখ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই)। তবে প্রতিকূল আবহাওয়া ও আগাম আলু উত্তোলনের ফলে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তারের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার টনের কিছু বেশি, যা সরকারি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৬ লাখ ৩৭ হাজার টন কম।
তবে হিমাগার মালিকরা বলছেন, আলুর প্রকৃত উৎপাদন সরকারি হিসাবের চেয়েও কিছুটা কম হবে। হিমাগারগুলোয় এবার আলু জমা হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কম।
দেশে কৃষি পণ্যের উৎপাদনের দিক থেকে চালের পরই আলুর অবস্থান। আলুকে খাদ্যপণ্যের অন্যতম উৎস হিসেবে দেখা হয়। বাহারি খাদ্যপণ্য শিল্পেও বেড়েছে আলুর ব্যবহার। ফলে আলুর মাথাপিছু ভোগ গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। আলু আগের মতো উদ্বৃত্ত থাকছে না।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭ সালের পর থেকেই দেশে উদ্বৃত্ত আলুর পরিমাণ কমছে। তাদের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালেও দেশে আলুর প্রকৃত চাহিদা ছিল ৬২ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০২০ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ লাখ ১৭ হাজার টনে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে দেশে আলুর উদ্বৃত্ত ছিল ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। ২০২০ সালের মধ্যে তা নেমে আসে ৩ লাখ ৪০ হাজার টনে। এই প্রবণতা পরবর্তী বছরগুলোতে দেখা যায়।
দেশে এখন আলুর বার্ষিক চাহিদা ৭৫-৮০ লাখ টনের মতো। তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে আলুর ঘাটতি দেখা দেওয়ায় এই খাদ্যপণ্যটি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ওই সময়ে প্রথম দফায় ১৯ হাজার ৪০০ টন আলুর আমদানির অনুমোদন দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে শেষ পর্যন্ত ১০ হাজার টনের মতো আলু আমদানি হয়েছিল বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৮ লাখ ৮৭ হাজার ২৪২ টন আলু উৎপাদন হয়।
উৎপাদন-পরবর্তী ক্ষতি বিবেচনায় নিলে প্রতি বছর দেশে প্রায় ২৬-২৭ লাখ টন আলু নষ্ট হয়ে যায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, দেশে উৎপাদিত আলুর প্রায় ২৫ শতাংশ বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে যায়।
আলুর মাথাপিছু ভোগ নিয়ে বিএআরসির তথ্য, ২০১০ সালে দেশের দৈনিক মাথাপিছু আলু খাওয়ার হার ছিল ৭০ দশমিক ৩০ গ্রাম। ২০২০ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬ দশমিক ৩০ গ্রামে।
আলুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহার হয় প্রাণিখাদ্য হিসেবে। ২০১৬ সালে প্রাণিখাদ্য হিসেবে আলুর ব্যবহার হয় প্রায় ১১ লাখ ১৩ হাজার টন, যা ২০২০ সালে বেড়ে হয় প্রায় ১১ লাখ ৪৯ হাজার টন। এছাড়া বীজ হিসেবে সংরক্ষিত আলুর পরিমাণ ২০১৬ সালে ছিল ১০ লাখ ৪২ হাজার টন, যা ২০২০ সালে হয় ১০ লাখ ৬ হাজার টন।
এবার আলু উৎপাদন মৌসুমের (রবি) প্রায় পুরোটাজুড়েই আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। শীতকালে কখনও টানা বৃষ্টি, কখনও শৈত্যপ্রবাহে আলুর ক্ষেতে রোগবালাই ছড়িয়েছে। এছাড়া বছরজুড়ে দাম বেশি মেলায় অনেক কৃষক আগেভাগেই আলু তুলে বিক্রি করেন, যার প্রভাব পড়ে আলুর উৎপাদনে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে। মোট ১ কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার টন উৎপাদনের সিংহভাগই উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের, যার পরিমাণ ১ কোটি ১ লাখ ৫৬ হাজার টন। আর স্থানীয় জাতের আলু উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৭ হাজার টন।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু শুক্রবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উত্তরবঙ্গ ও মুন্সীগঞ্জের আলু দিয়েই দেশের আলুর চাহিদা মেটে। এবার আলুর দাম কৃষকরাই বেশি পেয়েছেন। কৃষকের কাছ থেকে আলু কেনার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১৭ টাকা দাম নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু চাহিদা বেশি থাকায় কৃষকদের কাছ থেকে এর থেকে বেশি দামে আলু কিনতে হয় হিমাগার মালিকদের।”
চাষী কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবু বলেন, “উত্তরবঙ্গের আলুর দাম ধরা হয়েছিল ১৯ টাকা, মুন্সীগঞ্জের ১৫ টাকা। গড় করা হয়েছিল ১৭ টাকা। কিন্তু এই দামে কৃষকদের কাছ থেকে আলু কেনা যায়নি। তারাই কেজি ২৫ টাকার বেশি দরে আলু বিক্রি করেছে। এর সঙ্গে হিমাগারের খরচ যোগ হবে। এর সঙ্গে যোগ হবে গাড়ি ভাড়া ও মুনাফা।”
সংরক্ষণ করা আলুর দাম আরও বাড়বে জানিয়ে বাবু বলেন, “হিমাগারের আলু এখনও বাজারে ছাড়া শুরু হয়নি। আরও কিছুদিন পর থেকে হিমাগারের আলু বাজারে আসবে।”
কারওয়ান বাজারের আড়ৎদার আলী হোসেন জানান, ঈদের পর এখনও বাজার জমে ওঠেনি। হাতে গোনা যে কয়েকজন আড়ৎদার আলু নিয়ে বসেছেন। এসব আলুর মধ্যে বেশিরভাগই মুন্সীগঞ্জের আলু।