এক কালে ধারণা করা হতো, মধ্য বয়স পেরিয়ে গেলে সংসার জীবনে আর ছন্দপতন দেখা দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ ততদিনে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন একে অন্যের সঙ্গে; তাদের আর নতুন কোনো প্রত্যাশাও থাকে না দুজনের কাছে।
কিন্তু সাত বছরের প্রেম এবং বিবাহিত জীবনে আরও ২৭ বছর পার করার পর বিল গেটস আর মেলিন্ডা গেটস ডিভোর্সের ঘোষণা দিলে গোটা পৃথিবীতেও যেন পুরনো হিসাবে গোলমাল বেঁধে যায়। ডিভোর্স দেয়ার সময় বিল গেটসের বয়স ৬৫ বছর এবং মেলিন্ডা গেটসের বয়স ছিল ৫৬ বছর।
চুলে যখন পাক ধরে তখন আর নতুন সম্পর্কে জীবন জড়ানোর সময় থাকে না। ৫০ পেরিয়েছে মানে আর সন্তান হবে না; বিয়ের বয়সও নেই তাই। অর্থাৎ ৫০ পেরিয়েছে মানে চলতি সম্পর্কের জটিলতা মেনে নিতে হবে। এ বয়সে জীবনে নতুন কোনো মোড় আসবে না; ফলে পাকা চুলের বয়সে নতুন কোনো সূচনার সম্ভাবনা নিয়ে ভাবার অবকাশ একেবারে শূন্য।
এই অংকে জোরেশোরে ধাক্কা দিয়েছিলেন আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস ও তার স্ত্রী ম্যাককেনজি। ২০১৯ সালে দীর্ঘ ২৫ বছরের সংসার জীবনের ইতি টানেন দুজনে। তখন বেজোসের বয়স ৫৪ বছর, আর ম্যাককেনজির বয়স ৪৮ বছর।
৪০ অথবা ৫০ বসন্ত দেখা জীবনে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মতো চলার ধরণ গ্রে ডিভোর্স নাম পায় দ্রুত। গ্রে ডিভোর্স শুধু পশ্চিমা জীবনেই আটকে থেকেছে তা নয়; ভারতেও এসেছে।
আরবাজ় খান ও মালাইকা অরোরা তাদের ১৮ বছরের দাম্পত্যের ইতি টানেন ২০১৭ সালে। আরবাজ খান এবং মালাইকা দুজনেই তখন ৪০ পেরিয়েছেন। ২০২৩ সালে ৫৬ বছর বয়সে সুরা খানকে বিয়ে করে নতুন করে সংসার জীবন শুরু করেছেন আরবাজ খান। এখন ৫০ বছর পেরোনো বয়সী মালাইকা অরোরা আবারও বিবাহিত জীবনে নিজেকে না বাঁধলেও, নায়ক অর্জুন কাপুরের সঙ্গে দীর্ঘদিন একসাথে থাকার পর সম্প্রতি আলাদা হয়েছেন তারা।
মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খানের জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদ এসেছে দুইবার। ২০০৫ সালে প্রথম স্ত্রী রিনা দত্তের সঙ্গে বিচ্ছেদের সময় আমির খানের বয়স ছিল ৪০ -এর কোঠায়। এরপর ২০০৫ সালে আবার সংসার জীবন শুরু করেন কিরণ রাও সঙ্গে। ১৫ বছর দাম্পত্য জীবন পার করে এই দুজন বিচ্ছেদের পথে হাঁটবেন এমন সমীকরণ মেনে নিতে ভক্তরাও হিমশিম খেয়েছেন। তিন বছর আগে, ২০২১ সালে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাদের। স্বামী আমির খানের সঙ্গে কোনো ভাবেই নিজেকে স্ত্রী পরিচয়ে বেঁধে রাখতে চাননি কিরণ রাও। তবে বন্ধু ও সহকর্মী আমির খানের পাশে তিনি এখনও আছেন। তিন বছর আগে আমির খানের বয়স ছিল ৫৬ এবং কিরণ রাওয়ের ৪৮ বছর।
একদম হালে অস্কার বিজয়ী সঙ্গীতশিল্পী এ আর রহমান এবং তার স্ত্রী সায়রা বানু তাদের দীর্ঘ ২৯ বছরের দাম্পত্যে ইতি টেনেছেন। ১৯শে নভেম্বর এই বিচ্ছেদ ঘোষণা প্রকাশ্যে আসার পর গ্রে ডিভোস আবারও আলোচনায় উঠে আসে। এ আর রহমানের বয়স এখন ৫৭ এবং সায়রা বানুর বয়স ৫১ বছর। প্রায় তিন দশকের সংসার জীবনে এই দম্পতি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের মা–বাবা হয়েছেন।
সাবেক বিশ্ব সুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই এখন ৫০ পেরিয়েছেন। অভিষেক বচ্চনের বয়স ৪৮ বছর। বেশ কয়েক মাস ধরে এই দুজনের আলাদা থাকায় বিচ্ছেদের কানাঘুষা শিরোনাম হচ্ছে নিয়মিত। যদিও ভক্তরা কোনোভাবেই চান না আরাধ্যর মা-বাবা ঐশ্বরিয়া-অভিষেক ১৭ বছরের বিবাহিত জীবনের পাঠ চুকিয়ে গ্রে ডিভোর্স বেছে নিক।
অনেকেই গম্ভীর মুখে ভাবছেন, কেন এই বয়সে বিবাহ বিচ্ছেদ বাড়ছে?
সম্পর্কবিদরা বলছেন, মানুষের গড় আয়ু এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বাড়ছে বলে চুল পাকলেও মানুষের মধ্যে একে অন্যের প্রতি চাওয়া-পাওয়ার হিসাব ম্লান হয়ে যাচ্ছে না।
আবার মধ্যবয়সের পর সন্তানরা বড় হয়ে গেলে এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম ভোগায় বাবা-মাদের। সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ততা কমে গেলে স্বামী-স্ত্রী হঠাৎ খেয়াল করে দেখেন নিজেদের সম্পর্কে উষ্ণতা কমে গেছে। যারা এই মিইয়ে যাওয়া সম্পর্ক চাঙ্গা করতে পারেন না তারাই গ্রে ডিভোর্সের পথে হাঁটেন।
গ্রে ডিভোর্স নিয়ে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি, ভারত এবং বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও নানাভাবে প্রতিবেদন করছে। বিদেশি সংবাদ ও গবেষণার বরাতে জানা যাচ্ছে, ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে জন্মানো বেবি বুমার প্রজন্মের বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি। বিশেষ করে ১৯৯০ -এর দশকের পর এই প্রজন্মের বিচ্ছেদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
যে বয়সেই হোক, বিচ্ছেদের সামাজিক ও মানসিক ধকল আছে। মধ্যবয়সের পর ডিভোর্সে অনেকের বেলায় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা না থাকলেও সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের যোগাযোগের ছন্দ আগের মতো রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে হয় দুজনকেই। আবার দীর্ঘ জীবন পার করে একাকী জীবন সামনে আসার পর হুট করে আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে। দীর্ঘ জীবন পর আবারও সঙ্গী বেছে নেয়ার বেলায় নিজেকে সপ্রভিত মনে নাও হতে পারে।
তাহলে কি গ্রে ডিভোর্স বেছে নেয়া ভুল সিদ্ধান্ত হবে?
এক সঙ্গে থাকা যদি একান্তই দুরূহ হয়ে ওঠে তখন গ্রে ডিভোর্সে সম্মতি দেয়া দুজন বরং দুজনের প্রতি বিদ্বেষ না দেখিয়ে সামনের দিনগুলোতে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা ধরে রাখতে পারেন। আর সন্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ধরে রাখতে পারলে গ্রে ডিভোর্সের নেতিবাচক দিক কাটিয়ে ওঠা কারও জন্য কঠিন কিছু নয়।
বিবাহিত জীবনের ৪৯ বছর পার করে বিশ্বনাথ মজুমদারের উপলব্ধি হয়, এই সম্পর্কে প্রেম-ভালবাসার অস্তিত্ব ছিল না কখনও। তখন সামনে একটি প্রশ্ন উঠে আসে, সংসার কি শুধুই অভ্যাস? দাম্পত্য কি শুধুই শেষ বেলা পর্যন্ত টেনে নেয়ার দায়িত্ববোধ?
এই অভ্যস্ত হওয়ার সংসারের শেকল থেকে তখন মুক্তি পেতে চান বিশ্বনাথ মজুমদার। ৫০তম বিবাহবার্ষিকী ঘনিয়ে এলে বিশ্বনাথ গোটা পরিবারের সামনে স্ত্রী আরতিকে ডিভোর্স দেয়ার ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা গড়ায় আদালত পর্যন্তও।
এই গল্পের উপর ২০১৫ সালে মুক্তি পায় ভারতীয় বাংলা সিনেমা বেলা শেষে। ওই সময় বক্সঅফিসে বাজিমাত করা সিনেমাটি দেখলে গ্রে ডিভোর্স নিয়ে আরও গভীর ভাবে ভাবার অবকাশ হবে অনেকেরই।