সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন এখন সরকারের পদত্যাগের এক দফায় গড়িয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শনিবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে রবিবার থেকে অসহযোগ কর্মসূচির ডাক দেয়।
এই সমাবেশে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের, নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। একদল রিকশাচালককেও দেখা গেছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্লোগান মেলাতে।
নানা বয়সী মানুষের স্লোগান ছিল ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ ইত্যাদি।
এই স্লোগানে সুর মেলানো আলমাস নামে এক রিকশাচালক বলেন, “আইজক্যা কোনও খ্যাপ মারুম না। আইজক্যা শুধু আন্দোলন। বিজয় আমাদের হবে।”
কেন আন্দোলনে নেমেছেন- প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের ছাত্র ভাইদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, ওইডা দেখে কেউ থাকতে পারবে না। জিনিসপত্রে দাম চড়া, আমাদের সংসার চলে না। আন্দোলন না কইরা উপায় আছে।”
সমাবেশে আগতদের পানি খাওয়াচ্ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী। কথা বলতে চাইলে বললেন- “ছবি তোলা যাবে না, নামও বলব না।”
তার শর্তে রাজি হলে তিনি বলেন, তিনি এসেছেন বসুন্ধরা এলাকা থেকে। ঢাকায় তিনি একাই থাকেন। স্বামী নেই, তিন ছেলে-মেয়ের সবাই বিদেশে।
এখানে আসার কারণ জানিয়ে এই নারী বলেন, “মূলত আমাকে এখানে এনেছে মূগ্ধ ছেলেটা। যে ছেলেটা মানুষকে পানি খাওয়াতে গিয়ে কপালে গুলি খেয়ে মারাই গেল, তার স্মরণে, তার অসমাপ্ত কাজের কিছুটা হলেও যদি আমি করতে পারি, তাহলে শান্তি পাব।
“এই বয়সে ঘুমের ওষুধ খেয়েও আমি ঘুমাতে পারছি না, চোখ বুজলেই মুগ্ধকে দেখি, মুগ্ধর কথা কানে বাজে।”
নিজের ছোট মেয়েকে কাঁধে নিয়ে শহীদ মিনারের সামনের ফুটপাত ধরে আসছিলেন রাজিউল আলম, পাশে স্ত্রী। শহীদ মিনার থেকে ভেসে আসা স্লোগানে গলা মেলাচ্ছিলেন হাঁটতে হাঁটতেই।
‘ইতিহাসের সাক্ষী’ হতেই শহীদ মিনারে আসা, বললেন রাজিউল।
শহীদ মিনারে সমবেত হওয়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, গত কয়েক বছরে সরকারের দেশ পরিচালনা নিয়ে তাদের ক্ষোভ জন্মেছে। দ্রব্যমূল্যের দামের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাদের দাপট নিয়ে অসন্তুষ্ট তারা।
সরকারের ভিন্নমত গ্রহণ করতে না পারার যে প্রবণতা, তা নিয়ে অসন্তোষের কথা বললেন এক চিকিৎসক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “গতকাল ( শুক্রবার) একজন বিচারপতির টকশোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে উপস্থাপককে যেভাবে তিনি রাজাকার বললেন!
“আওয়ামী লীগ না করলেই সে রাজাকার, শিবির করে- এই ট্যাগ দিতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।”
দেশের তরুণদের মনের ভাষা বুঝতে না পারা সরকারের বড় ব্যর্থতা বলে মনে করেন তিনি।
“সরকারের এত এত তরুণ মন্ত্রী, সরকার দেশটাকে ডিজিটালাইলজড করেছে, কিন্তু তারা নিজেরাই অ্যানালগ। এই তরুণদের চোখের ভাষা না বুঝতে পারাই আজকের এ অবস্থার জন্য দায়ী।”
সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলেন, এরপর একটি জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানান তিনি। অন্য সমন্বয়করাও মঞ্চে তার সঙ্গে ছিলেন।
এই আন্দোলনের শুরু সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল করে গত জুন হাইকোর্টের রায়ের পর।
আন্দোলনের সূচনায় গত ৯ জুন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে প্রথম সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে ব্যানার বদলে হয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’।
গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণই ছিল। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালালে তা সহিংসতায় গড়ায়।
পরদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়। ১৮ জুলাই সংঘাত ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এরপর কয়েকদিনে দুই শতাধিক নিহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করে সরকার।
এরই মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় সব ধরনের সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কার করে সরকার। ৫৬ শতাংশ থেকে কোটার অনুপাত নামিয়ে আনা হয় ৭ শতাংশে।
এরপর আন্দোলনের যৌক্তিকতা নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৯ দফা দাবি তুলে তা আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। সংঘাত-সহিংসতা চলার মধ্যে তা এক দফায় গড়াল।