বিজ্ঞাপনের মডেলরা ‘খুব মোটা’- প্রতিদিন এ ধরনের ১০০টিরও অভিযোগ পায় বলে জানিয়েছে অনলাইনে পোশাক বিক্রির বিখ্যাত ব্র্যান্ড স্ন্যাগ।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ব্রিজিট রিড বলেছেন, তাদের লার্জ সাইজের পোশাকের মডেলরা প্রায়ই তাদের ওজন নিয়ে ‘বিদ্বেষমূলক’ মন্তব্যের শিকার হন।
কিছুদিন আগে ব্রিটিশ পোশাক, পাদুকা ও গৃহস্থালীর পণ্যের রিটেইলার নেক্সট একটি বিজ্ঞাপনে অসম্ভব রোগা একজন মডেল ব্যবহার করে। বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, মডেল ‘অস্বাস্থ্যকর রকম পাতলা’। নেক্সট এর ওই বিজ্ঞাপনটি নিষিদ্ধ হয়েছিল।
একজন মডেলকে ‘অস্বাস্থ্যকরভাবে পাতলা’ দেখানোয় বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধের পর ‘অস্বাস্থ্যকরভাবে মোটা’ মডেলদের নিয়ে তৈরি বিজ্ঞাপনগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত কিনা, তা নিয়ে একটি অনলাইন চলছে জোর বিতর্ক।
যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এএসএ) বলছে, তারা এমন বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয় যেখানে মডেলদের অসম্ভব রকম কম ওজনের দেখায়। এর কারণ হলো, সমাজে রোগা হওয়ার একটা প্রবণতা আছে, তাই অতিরিক্ত ওজনের মডেলদের চেয়ে কম ওজনের মডেলদের বিজ্ঞাপন বেশি ক্ষতিকর।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলছে, ২০২৪ সালে মডেলদের ওজন নিয়ে ৬১টি অভিযোগ পেয়েছে, যার বেশিরভাগই ছিল খুব পাতলা মডেলদের সম্পর্কে। কিন্তু তদন্ত করার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল মাত্র আটটি অভিযোগের ক্ষেত্রে এবং এর মধ্যে একটিও স্ন্যাগের সম্পর্কে ছিল না।
সামাজিক রেড্ডিটে বিবিসি এ সংক্রান্ত থ্রেড চালু করার পর দেখা গিয়েছে, ১ হাজারেরও বেশি অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অধিকাংশই বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার যুক্তিতে সন্তুষ্ট নন।
অসন্তুষ্টদের দলে রয়েছেন, ৩৬ বছর বয়সী এডিনবার্গের বাসিন্দা ক্যাথরিন থম নেক্সট। তিনি বিবিসির সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন- পাতলা মডেলদের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে এই যুক্তিতে যে এটি সামাজিকভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন, কিন্তু যখন মডেলরা স্পষ্টভাবে স্থূল, তখন আমরা বলছি এটা বডি পজিটিভিটি- এই ব্যাপারটি ভণ্ডামি।
তিনি জানান, নিজের গর্ভকালীন সময়ে স্ন্যাগ থেকে কেনাকাটার পর তার ডিভাইস ‘মোটা মডেল’দের বিজ্ঞাপন দিয়ে ভেসে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সোশাল মিডিয়ায় আমি স্ন্যাগের টাইটস পরিহিত অসম্ভব মোটা মডেলদের বিজ্ঞাপন দেখতে পাচ্ছি।
“যখন নেক্সট মডেলের (অতিরিকত্ত পাতলা) ছবি অনুমোদিত নয়, তখন এটা কিভাবে অনুমোদন? রাজনৈতিকভাবে সঠিক ‘বডি পজিটিভিটি’ বিবেচনা না করে, এই ব্যাপারটিতে ন্যায্য হওয়া উচিত। স্থূল বা মারাত্মকভাবে কম ওজনের হোক না কেন, অস্বাস্থ্যকর ওজনকে স্বাভাবিক দেখানো বিজ্ঞাপনগুলো একইভাবে ক্ষতিকর।”
‘মেদভীতি’
তবে স্ন্যাগের প্রতিষ্ঠাতা মিস রিড বলেছেন, “লজ্জা দিলেই যে মোটা মানুষের ওজন কমে যাবে তা নয়। বরং এটি আসলে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলে এবং তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও।”
তিনি মনে করেন যে বড় শরীরের মডেলদের দেখানো বিজ্ঞাপনগুলো নিষিদ্ধ করার ধারণাটি সমাজে প্রচলিত ‘মেদভীতি’-র একটি লক্ষণ।
তার ১০০ জন কর্মীর মধ্যে ১২ জন ‘শুধু নেতিবাচক মন্তব্য মুছে ফেলা এবং বডি পজিটিভিটিকে প্রচার করা ব্যক্তিদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য’ নিয়োজিত।
তিনি বলেন, “মোটা মানুষরা বিদ্যমান, তারা পাতলা মানুষের মতোই বৈধ, তারা পোশাক কেনেন এবং তাদের মতো দেখতে লোকেদের উপর সেগুলো কেমন দেখায় তা তাদের দেখা দরকার।”
“আপনি যত মোটাই হোন না কেন আপনার মূল্য কম নয়। সব আকারের, আকৃতির, জাতিসত্তার এবং ক্ষমতার মডেলরা বৈধ এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করা উচিত।”
সোফি স্কট স্কটল্যান্ডের লসিমুথের ২৭ বছর বয়সী একজন সেলুন মালিক, যিনি স্ন্যাগের জন্য মডেলিং করেছেন। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় তার আকার সম্পর্কে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই ধরনেরই মন্তব্য পেয়েছেন।
আমি হয় ‘তুমি খুব সুন্দর’ অথবা ‘তোমার ওজন কমানো দরকার’ এই ধরনের মন্তব্য পাই। যখন আমি মডেলিং শুরু করি তখন আমার সাইজ ছিল ৩০ (কোমড় আড়াই ফিট)। এরপর ওজন কমালেও আমি বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের শিকার হই, কারণ কিছু লোক কণওই থামবে না ।”
সোফি অনলাইনে তার ‘অস্বাভাবিক’ শরীর নিয়ে কথা শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু তিনি বলেন, “বাইরে দেখে কেবল শরীর দেখেই কেউ ফিট কিনা সেটি বোঝা সম্ভব না। তারা কেবল অনুমান করছে, কিন্তু তারা আমাকে বা আমার কাজের মাত্রা সম্পর্কে জানেন না।”
“লোকেরা বলে ‘আপনি স্থূলতাকে মহিমান্বিত করছেন’। কিন্তু আমি কখনো মনে করিনি কেউ আমাকে দেখে বলছে- ‘আমি ওর মতো দেখতে হতে চাই’। সম্ভবত কিছু লোক আমাকে দেখে বলছে ‘ওর শরীরের ধরন আমার মতোই’।”
“যখন আমি কারো কাছ থেকে একটি বার্তা পাই যে ‘আমাদের আকার একই এবং আপনি আমাকে যা ইচ্ছা পরতে অনুপ্রাণিত করেছেন’, তখন আমার প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্যগুলো মন থেকে দূরে সরিয়ে দিই। আমি যদি একজন ব্যক্তিকেও তাদের শরীর মেনে নিতে সাহায্য করে থাকি, তবে আমার প্রতি বিদ্বেষমূলক মন্তব্যগুলোতে কিছু যায়-আসে না।”
ফ্যাশন সাংবাদিক ভিক্টোরিয়া মস মনে করেন বিজ্ঞাপনের মডেলদের নিয়ে চলমান বিতর্কটি বেশ ‘হতাশাজনক’। তিনি বলছেন, এই বিতর্কটি প্রমাণ করেছে যে সমাজ বিজ্ঞাপনী প্রচারণায় বড় শরীর দেখতে অভ্যস্ত নয়।
তিনি বলেন, “আপনার পক্ষে খুচরা বিক্রেতাদের ওয়েবসাইটে সত্যিকারের প্লাস-সাইজ মডেল খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হবে। এমনকি একটি মাঝারি সাইজের মডেল হিসেবেও ১০/১২ এবং প্লাস ১৪/১৬ সাইজের মডেল খুঁজে পাওয়াও কঠিন হবে, অথচ এসব আসলে যুক্তরাজ্যের একজন মহিলার গড় আকারের কাছাকাছি।”
“খুব ছোট বা খুব বড় মডেলদের দেখানো বিজ্ঞাপনের সমস্যা হল প্রসঙ্গ এবং উস্কানি। আমরা জানি যে খাদ্যজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুব পাতলা লোকেদের ছবি ‘থিনস্পিরেশন’ হিসেবে খোঁজেন। কিন্তু যদি কেউ বড় শরীরের ছবি দেখে, তারা মোটা হওয়ার চেষ্টা করার জন্য ১০টি ম্যাকডোনাল্ডস কিনতে ছুটবে না।”
বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তদন্ত ম্যানেজার জেস টাই বিবিসিকে বলেন, যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতি বছর সমস্ত বিজ্ঞাপন সম্পর্কে প্রায় ৩৫,০০০ অভিযোগ পায়। ২০২৪ সালে মডেলের ওজন সম্পর্কিত ৫২টি বিজ্ঞাপন নিয়ে মোট ৬১টি অভিযোগ পেয়েছে।
তিনি বলেন, যদি কোনো বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয় যে এটি মানুষকে অস্বাস্থ্যকর শরীরের ওজনের দিকে ঝুঁকে উৎসাহিত করছে তবে তা তদন্ত করা হবে। শুধু শরীরের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং পণ্যের আকারের সীমার সাথে প্রাসঙ্গিক মডেল ব্যবহার করেছে এমন বিজ্ঞাপনগুলো তদন্ত করা হবে না। “এটি বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে সম্পর্কিত। আমরা জানি যে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সমাজ পাতলাতাকে আকাঙ্ক্ষিত হিসেবে দেখে এবং অতিরিক্ত ওজনের ক্ষেত্রে তা নয়।”
(বিবিসি অবলম্বনে)