Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫

যে কারণে উত্তাল পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীর

পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফারাবাদে শনিবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে।
পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফ্ফারাবাদে শনিবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে।
[publishpress_authors_box]

কাশ্মীর। ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে উত্তরের এক জনপদ। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কাশ্মীর বলতে বৃহত্তর হিমালয় ও পীর পাঞ্জাল রেঞ্জের মধ্যে অবস্থিত কাশ্মীর উপত্যকাকেই বোঝাত।

কাশ্মীর এখন কেবল এই উপত্যকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ, পাকিস্তানশাসিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান এবং চীনশাসিত আকসাই চিন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চল।

নয়নাভিরাম কাশ্মীর নিয়ে সেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে উত্তেজনা চলছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেশ কয়েকবার যুদ্ধেও জড়ায় তারা। দু’দেশই কাশ্মীরের পূর্ণ ‍নিয়ন্ত্রণ চায়।

কাশ্মীরের যে অংশ বর্তমানে পাকিস্তানের অধীনে, তা স্থানীয়ভাবে আজাদ জম্মু কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত। আধা স্বায়ত্তশাসিত এই অংশের জনসংখ্যা ৪০ লাখের বেশি।

পাকিস্তানশাসিত এই কাশ্মীর বেশ কিছুদিন ধরেই অশান্ত। সম্প্রতি সেখানে রক্ত ঝরেছে। বিক্ষোভ চলাকালে তিন তরুণ প্রাণ হারান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। এছাড়া এই অঞ্চলজুড়ে অস্থিতিশীলতার পেছনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জেরে সংকটের শুরু

গত বছর পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হঠাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য গম, আটা এবং বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির জেরে জীবনযাপনের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খায় মানুষ। একপর্যায়ে দাম কমানোর দাবিতে গত বছরের মে মাসে আন্দোলন শুরু করে আজাদ কাশ্মীরের জনগণ।

তাদের নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় সংগঠন জম্মু কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি (জেএএসি)। শ্রমিক নেতা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের সদস্যরা এর সঙ্গে যুক্ত। তাদেরই একজন ইমতিয়াজ আসলাম।

জেএএসির জ্যেষ্ঠ এই নেতা তাদের আন্দোলন নিয়ে আল জাজিরাকে বলেন, “গত বছর এ অঞ্চলে ব্যাপক আকারে গমের সংকট দেখা দেয়। ফলে গমের দাম যায় বেড়ে। এরপর বাড়ে বিদ্যুতের দাম।   

“পরিস্থিতি দেখে তখন আমরা গম-বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু করি।”

আসলাম জানান, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে যে সংকট সৃষ্টি হয়, তা নিরসনের উপায়ও বাতলে দেন আন্দোলনকারীরা। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের খরচ যাতে কমানো হয়। পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে আমলাদের সুযোগ-সুবিধা কমানো হলে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্ভোগ অনেকটাই কমানো সম্ভব, এমনটাই মনে করেন আন্দোলনকারীরা।

জেএএসির নেতা আসলাম বলেন, “গোটা বিশ্বে সুশীল সমাজ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছে। অথচ এ অঞ্চলের সমস্যা হচ্ছে, যখনই আমরা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে নামি, আমাদের অমুকের এজেন্ট তমুকের এজেন্ট বলা হয়। এসব ট্যাগ দিয়ে আমাদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।”

সংকট যেভাবে ঘনীভূত হলো

আসলামের ভাষ্য, গম-আটায় ভর্তুকি দেওয়া, বিদ্যুতের দাম কমিয়ে উৎপাদন খরচের সমান করা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থা সমন্বয়ে উন্নতিসাধনসহ ১০ দফা দাবি সরকারের কাছে পেশ করে আজাদ কাশ্মীরের বাসিন্দারা।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৯টি দাবিই পূরণের আশ্বাস দেয় পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীর সরকার। কিন্তু তার কোনও প্রতিফলন গত তিন মাসে দেখেনি উপত্যকার মানুষ।     

জেএএসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিদ্যুতের দাম কমানো ছাড়া বাকি ৯টি দাবি বাস্তবায়নে রাজি হয় সরকার। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হয়নি আন্দোলনকারীরা।

তাদের বক্তব্য, বিদ্যুৎ যেহেতু আজাদ কাশ্মীরের মিরপুর জেলার ঝিলম নদীর ওপর নির্মিত মংলা বাঁধের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবেই উৎপাদন করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে এর দাম বাড়ার কোনও যুক্তি নেই।     

আসলাম বলেন, “এ বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রতিনিধিরা আমাদের জানান, এক মাসের মধ্যে বিদ্যুতের দাম কমানোর দাবি ছাড়া বাকি সব দাবি মেনে নেওয়া হবে। কোনও দাবিই পূরণ না করে আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নির্মমভাবে থামানোর চেষ্টা করে সরকার।”

অবশ্য জেএএসি নেতার দাবি না মানার অভিযোগ মানতে নারাজ মিরপুর জেলার কমিশনার চৌধুরী শওকত আলি। তিনি বলেন, “পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনোয়ারুল হকের নির্দেশে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও আটার দাম কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে আঞ্চলিক প্রশাসন।”

তবে বিদ্যুৎ-আটার দাম কমানোর পদক্ষেপকে সংকট নিরসনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনে করছে না আন্দোলনকারীরা।

অন্যদিকে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীর কর্তৃপক্ষ বলছে, আন্দোলনকারীরা নিত্যনতুন দাবি-দাওয়া হাজির করছে। যেমন তাদের বিদ্যুতের দাম কমিয়ে উৎপাদন খরচের সমান করার দাবি নতুন- এমনটাই অভিযোগ মিরপুরের কমিশনার চৌধুরী শওকত আলির।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

দমন এবং দাবি আদায়  

এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে উত্তেজনা হঠাৎ বেড়ে যায়। জেএএসির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মধ্যে সম্প্রতি তাদের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে ১০ মে ধর্মঘটের ডাক দেয় জেএএসি। পরদিন ১১ মে আঞ্চলিক রাজধানী মুজাফ্ফারাবাদ অভিমুখে লং মার্চ কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করে আঞ্চলিক সরকার। শনিবার রাজধানী অভিমুখে লং মার্চ শুরুর প্রথম দিন আজাদ কাশ্মীরের বিভিন্ন শহরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে।   

সেদিন চলমান পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বলেন, প্রতিবাদ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে কারোর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার নেই।

পরদিন রবিবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জেএএসির নেতাদের কাছে বৈঠকে বসার প্রস্তাব দেন আঞ্চলিক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক।

“পারস্পরিক আস্থার ওপর ভিত্তি করে আমরা সমস্যার সমাধান চাই,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন তিনি।

পরে অবশ্য জেএএসি নেতা আসলাম আল জাজিরাকে জানান, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানী মুজাফ্ফারাবাদ অভিমুখে লং মার্চ চলবে।

লং মার্চ চলাকালে সোমবার আধাসামরিক বাহিনীর হাতে তিন তরুণ নিহত এবং আরও অনেকে আহত হয়। এর প্রতিবাদে মঙ্গলবার ধর্মঘটের ডাক দেয় আন্দোলনকারীরা।      

আন্দোলনের চাপে সোমবার বিকালে ২৩ বিলিয়ন রুপি ভর্তুকি কর্মসূচি অনুমোদন করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ।

এর প্রতিক্রিয়ায় জেএএসির চেয়ারম্যান শওকত নওয়াজ মীর জানান, সরকার তাদের দাবি মেনে নেওয়ায় আন্দোলনকে উদযাপনে পরিণত করার পরিকল্পনা আছে তাদের। তবে তারা রাজপথ ছাড়বেন না। তিন তরুণ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলবে।         

পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের জনগণের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে করাচির কাশ্মীরিদের বিক্ষোভ।

ভারতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ

অভিযোগ আছে, পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের সাম্প্রতিক উত্তাল পরিস্থিতিতে ভারতের ইন্ধন আছে। যদিও তা নাকচ করেছে জেএএসি। তারা জানায়, আজাদ কাশ্মীরের জনগণের মঙ্গলের জন্য দাবিগুলো তোলা হয়। এখানে কারও গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

জেএএসি নেতা আসলাম বলেন, “সরকার আমাদের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব প্রোপাগান্ডা ছড়ায়।

“আমাদের অধিকারের জন্যেই আমাদের প্রতিবাদ। এখানে কোনও জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা নেই। আমরা উন্নয়ন চেয়েছি। ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার চেয়েছি। অন্য কিছু নয়।”    

তিনি বলেন, “আমাদের লড়াই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। আমরা কেবল এই অঞ্চলের বর্তমান সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছি।

“যখনই কেউ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হয়, সঙ্গে সঙ্গে সরকার তার বিরুদ্ধে ভারত সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলে। এটা তারা সবসময়ই করে আসছে।” 

এ বিষয়ে মিরপুরের কমিশনার চৌধুরী শওকত আলি বলেন, “আন্দোলনকারীদের অধিকাংশই নিরীহ। অল্প কয়েকজনের হাতে বিক্ষোভকালে অস্ত্র দেখা গেছে, যা পরিস্থিতিকে সহিংস করে তোলে।       

“আমরা জানি, নির্দিষ্ট কিছু বিরোধী শক্তিকে অর্থায়ন করছে শত্রুপক্ষ। আমরা প্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা করছি।”

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত