Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

আইফোনের বাড়তি দাম কি ভোক্তাদের ওপর চাপাবে অ্যাপল

Apple Store
[publishpress_authors_box]

স্টিভেন রুবিওর স্বামী পুরনো আইফোনটি ভবিষ্যতে বদলানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে এখনই তিনি সেটি বদল করেছেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত।

রুবিও ও তার স্বামী সোমবার দুপুরে সান ফ্রান্সিসকোর ডাউনটাউন এলাকায় অবস্থিত অ্যাপল স্টোরে গিয়ে নতুন আইফোন কেনেন।

গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনসহ বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর ঘোষণা দেন। ট্রাম্প তখন জানান, চীনা পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক ৫৪ শতাংশে উন্নীত হবে। তার ওই ঘোষণার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনে তৈরি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

অ্যাপল মূলত চীনে তাদের আইফোন উৎপাদন করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতেও উৎপাদন বাড়িয়েছে। কিন্তু এই দুই দেশেও ট্রাম্প প্রশাসন উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়।

৬৬ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত রুবিও বলেন, “আমরা ভাবলাম, এখনই গিয়ে নতুন ফোনটা নিয়ে নেওয়া ভালো।”

তিনি জানান, তাদের কয়েকজন বন্ধু সম্প্রতি এই শুল্ক বৃদ্ধির খবরে আইপ্যাডসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য বদলে নতুন মডেল কিনেছেন।

রুবিওর মতো সাধারণ ভোক্তারাই শুধু এই বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন না। পুরো প্রযুক্তি শিল্প এখন কঠোর শুল্কনীতির সঙ্গে লড়াই করছে। এসব শুল্ক তাদের সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক পরিকল্পনাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, শুল্ক বহাল থাকলে ১,০০০ ডলারের একটি আইফোনের দাম ২৫০ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।

আইফোন হলো বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার একটি অন্যতম প্রতীক। এটি ক্যালিফোর্নিয়ায় উচ্চ বেতনের প্রকৌশলী ও ডিজাইনাররা ডিজাইন করেন। কিন্তু আইফোন তৈরি হয় চীন ও ভারতে। সেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা যন্ত্রাংশ একত্রিত করা হয়। প্রতিটি যন্ত্রাংশেরই আলাদা ও জটিল সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে। এই জটিলতা সত্ত্বেও অ্যাপল বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান কোম্পানির পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এটিকে একটি “অর্থনৈতিক বিপ্লব” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার লক্ষ্য হলো, এসব সরবরাহ ব্যবস্থা ও যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারীদের যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে নিয়ে আসা, যাতে দেশটির শ্রমিকরা চাকরি পায়।

গত রবিবার সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক বলেন, “আইফোন তৈরির জন্য যে লাখ লাখ মানুষ ছোট ছোট স্ক্রু লাগায়, সে রকম কাজ এখন আমেরিকায় আসবে।”

অ্যাপলের মতো কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত খরচ নিজেরা বহন করবে, না কি তা ভোক্তাদের ওপর চাপাবে- এটা এখনও নিশ্চিত নয়। বিশেষ করে উচ্চমূল্যের আইফোনে বড় মুনাফার সুযোগ রয়েছে।

কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে সংরক্ষিত সব আইফোন বিক্রি হয়ে গেলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন মডেলের দাম বাড়তে পারে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসির গ্রুপ ভাইস প্রেসিডেন্ট রায়ান রেইথ বলেন, “আমি এর বাইরে আর কোনও বিকল্প দেখছি না।”

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে অ্যাপলকে সাধারণ শুল্ক থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কুপারটিনোভিত্তিক অ্যাপল ঘোষণা দেয়, তারা আগামী চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। এই ঘোষণার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সোশাল মিডিয়া ট্রুথ সোশালে অ্যাপলের সিইও টিম কুককে ধন্যবাদ জানান।

গতকাল মঙ্গলবার এক ব্রিফিংয়ে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট বলেন, আইফোনের মতো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রেই উৎপাদন করা হতে পারে।

তিনি বলেন, “ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, আমাদের দেশে সেই পরিমাণ শ্রমিক, কর্মক্ষমতা ও সম্পদ রয়েছে, যা এই কাজ সম্ভব করতে পারে। অ্যাপল যদি মনে না করত যে যুক্তরাষ্ট্র এটি করতে পারবে, তাহলে তারা এত বড় অংকের বিনিয়োগ করত না।”

চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অ্যাপল বহু বছর ধরে উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করছে। বর্তমানে এয়ারপডস, অ্যাপল ওয়াচ ও ম্যাকবুকের গায়ে ‘ভিয়েতনামে তৈরি’ লেখা দেখা যায়। আগে শুধু চীনে আইফোন তৈরি হতো। কিন্তু এখন অ্যাপল ভারতের ওপর আরও বেশি নির্ভর করছে। বিশেষ করে কমদামি মডেল ও আইফোন ১৬-এর কিছু অংশ তৈরির জন্য ভারতকে ব্যবহার করছে।

যেসব দেশে অ্যাপল পণ্য তৈরি হোক না কেন, প্রসেসর, স্ক্রিন, ক্যামেরা, মেমোরি চিপ এবং মডেমের মতো যন্ত্রাংশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে। এসব যন্ত্রাংশ একত্র করে সম্পূর্ণ পণ্য তৈরি হয়।

কাউন্টার রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, আইফোন ১৬ প্রো মডেলের যন্ত্রাংশের মোট মূল্য প্রায় ৫০৭ ডলার। এটি এই পণ্যের খুচরা মূল্যের অর্ধেকেরও বেশি।

তবে অ্যাপলের এই উৎপাদন বৈচিত্র্যকরণ কৌশলও এখন হুমকির মুখে।

ট্রাম্প প্রশাসন চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর কঠিন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পাল্টা শুল্ক না তুললে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১০৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেয়। গতকাল বুধবার ১২৫ শতাংশে উন্নীত করেছেন ট্রাম্প।

২ এপ্রিল ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ ও ভারত থেকে আসা পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়, যা বুধবার স্থগিত করা হয়েছে।

অ্যাপলের পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটা এক ধরনের প্রতারণা মনে হচ্ছে। কারণ বহু বছর আগে অ্যাপলকে বলা হয়েছিল চীনের বাইরে উৎপাদন বাড়াতে। তারা সেটাই করেছে। কিন্তু এখন ভারত ও ভিয়েতনাম থেকেও আসা পণ্যে শুল্ক বসানো হচ্ছে।”

সংক্ষিপ্ত সময়ের একটি সমাধান হিসেবে অ্যাপল তাদের ভারতীয় কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে সেখান থেকে আইফোন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো যায়।

এই শুল্ক ঘোষণার ফলে বাজারে এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয় এবং ব্যাপকভাবে শেয়ার বিক্রি শুরু হয়। শুধু অ্যাপলেরই প্রায় ৬৪০ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্য সোমবার পর্যন্ত হারিয়ে যায়। পরদিন মঙ্গলবার অ্যাপলের শেয়ারের মূল্য আরও ৫ শতাংশ কমে যায়।

এই শুল্ক যুদ্ধ এমন সময় শুরু হয়েছে, যখন অ্যাপল ভোক্তাদের আগ্রহে মন্দাভাব এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে।

কাউন্টার রিসার্চের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক গ্যারিট শ্নেমান বলেন, “আইফোন ১৬-এর বিক্রি শুরু থেকেই আইফোন ১৫-এর তুলনায় পিছিয়ে আছে। গত বছর বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর অভিযোগ করেছিল, ফোন পরিবর্তনের হার ছিল রেকর্ড পরিমাণে কম। এর মানে, এমনিতেই মানুষ নতুন স্মার্টফোন কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না।”

অ্যাপলের ব্যয়বহুল ভিশন প্রো হেডসেটও সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এছাড়া তাদের প্রতীক্ষিত ‘অ্যাপল ইন্টিলিজেন্স’ ফিচারগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও সম্প্রতি সমালোচনা দেখা গেছে।

এদিকে বিদেশি বাজারের গ্রাহকরা, বিশেষ করে চীনে আগের চেয়ে বেশি হুয়াওয়ে ও স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। আর যারা আগে থেকেই অ্যাপলের পণ্য ব্যবহার করছেন, তারা সেগুলোই ধরে রাখছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অ্যাপল আইফোনের দাম বাড়াতে বাধ্য হলে অনেক ভোক্তা সেপ্টেম্বরে নতুন মডেল বাজারে আসার পরও পুরোনো ডিভাইসই রেখে দিতে পারেন। ওই সময় অ্যাপল তিনটি নতুন আইফোন মডেল উন্মোচনের পরিকল্পনা করছে।

অ্যাপল এখন ভারতে আইফোন উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এটি আইফোনের সম্ভাব্য দাম বাড়ার প্রভাব থেকে কোম্পানিটিকে পুরোপুরি রক্ষা করতে পারবে না। কারণ শুধু ভারত থেকে উৎপাদন করে বৈশ্বিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে অনেক আইফোন এখনও চীনে তৈরি হবে। আর অ্যাপল যে দাম নির্ধারণ করবে, সেটি সব বাজারেই একই রকম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অ্যাপল পুরো শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপাবে কি না, সে বিষয়ে প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা এখনও একমত নন।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসির রায়ান রেইথ মনে করেন না, অ্যাপল এই নতুন শুল্কের খরচ নিজেরা বহন করবে। তিনি বলেন, “তারা অতীতের কঠিন সময়গুলোতেও কখনও নিজেরা খরচ বহন করেনি।”

কাউন্টার রিসার্চের বিশ্লেষক গ্যারিট শ্নেমান মনে করেন, আইফোনের উচ্চ মুনাফার কারণে অ্যাপল অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় এই অতিরিক্ত খরচ মোকাবিলায় ভালো অবস্থানে রয়েছে। কোম্পানি পুরো খরচ নিজেরা বহন না-ও করতে পারে, তবুও নিয়ন্ত্রিতভাবে দাম বাড়ালে অনেক গ্রাহক নতুন আইফোন কিনবে।

তিনি বলেন, নতুন আইফোনের দাম সামান্য বাড়লে যারা সরাসরি এককালীন অর্থ দিয়ে ফোন কেনেন, তাদের জন্য এটি কিছুটা কষ্টকর হতে পারে। তবে যারা মাসিক কিস্তিতে মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ফোন কেনেন, তাদের জন্য এটি তেমন বড় বিষয় নাও হতে পারে।

অ্যাপলের সরবরাহ ব্যবস্থা ঘিরে তৈরি হওয়া সমস্যাগুলো দেখে কিছু বাজার বিশ্লেষক ভাবছেন, আইফোন উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে কি না।

তবে অ্যাপল যুক্তরাষ্ট্রেই আইফোন তৈরি করতে চাইলে সেখানে উচ্চ শ্রম ব্যয় এবং এশিয়ার ওপর যন্ত্রাংশ নির্ভরতার কারণে আইফোনের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে।

অ্যাপলের পরিকল্পনার সঙ্গে পরিচিত একজন ব্যক্তি বলেন, “আইফোন উৎপাদন আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসবে, এটা বাস্তবসম্মত নয়।”

এমনকি স্মার্টফোন কেনা রুবিওও এই বিষয়ে সন্দিহান। তিনি বলেন, “আমরা আর সেই উৎপাদনশীল দেশ হিসেবে ফিরতে পারব না, যেমনটি একসময় ছিলাম।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত