দেশের পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের মধ্যে গতবছর সরকার যখন তাদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার ঠিক করল, সেসময় তাদের দেওয়া হয় রেশনের দাবি পূরণের আশ্বাস।
গত ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় পোশাক শ্রমিকদের বেতনের নতুন কাঠামো। এরপর গড়িয়েছে ছয় মাস, তবে রেশনের জন্য ফ্যামিলি কার্ডের ব্যবস্থা এখনও হয়নি।
গতবছর আন্দোলনের সময় পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবি ছিল ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা। দেশের অনেক সংগঠন তাদের সেই দাবি পূরণে সরকারকে আহ্বানও জানিয়েছিল, তবে তা করা হয়নি। মালিকপক্ষ তাতে রাজি ছিল না।
২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তখন বলা হয়েছিল, মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, এতে পোশাক শিল্পের ৩৯ লাখ শ্রমিকের বেশিরভাগই উপকৃত হবেন।
শ্রমিকদের রেশনও দেওয়ার আশ্বাস দেন তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণার সময় তিনি বলেন, “শ্রমিকদের রেশনের দাবি আছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি পরিবারের জন্য একটি ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যেই নির্ধারিত থাকবে কত সদস্য কার্ডটি ব্যবহার করতে পারবে। পরবর্তীতে এই কার্ডের মাধ্যমে রেশনিং ব্যবস্থা চালুর কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন।”
নতুন বেতন কাঠামোর মূল গেজেটে রেশনিংয়ে ফ্যামিলি কার্ডের কথা না থাকলেও মালিকপক্ষ ও সরকার রাজি ছিল এ বিষয়ে, সেজন্যই ঘোষণা এসেছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
মালিকপক্ষ বলছে, তারা সরকারকে নিয়মিত তাগদা দিচ্ছে ফ্যামিলি কার্ডের জন্য। বাজেটের পরই সরকারের সঙ্গে কাজ শুরু করতে চান তারা।
তবে শ্রমিকপক্ষ বলছে, শ্রমিকদের রেশনের দাবি বহু পুরনো। কেবল আশ্বাসই পাওয়া যায়, কিন্তু কাজ হয় না। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বললেও কোনও কাজ হয়নি।
আর মন্ত্রণালয়ের দাবি, নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, এখন পরিকল্পনা তৈরির কাজ শুরু হবে।
বেতনের টাকায় তো কিছুই হয় না
নুরজাহান বেগম গাজীপুরের এক কারখানার সুয়িং অপারেটরের কাজ করেন। তার স্বামী জসিম মোল্লাও কাজ করেন গাজীপুরের আরেক কারখানায়। দুই সন্তান নিয়ে তারা থাকেন গাজীপুরের এক শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায়। দুইজন মিলে আয় করেন ৩৫ হাজার টাকা। তা দিয়ে বর্তমান বাজারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয় নূরজাহান বেগমের। তিনি বলেন, বাসা ভাড়াই দিতে হয় সাত হাজার টাকা। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। তারপর বড় ছেলেটা স্কুলে যাচ্ছে। ওর খরচ আর ছোটটার জন্য খরচের পর বাজার করার টাকা থাকে না। সবকিছুর দাম বেশি।
“শুধু আমাদের বেতনটাই নিয়ম মতো বাড়ে না। যে বেতন পাই তাতে তো কিছুই হয় না,” বলেন নূরজাহান।
পোশাক শ্রমিকদের ফ্যামিলি কার্ড দেওয়ার ঘোষণার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন নূরজাহান। পোশাক শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার সরকারি আশ্বাসের কথা তুললে তিনি হেসে বলেন, “এসব তো শুধু টিভি পর্দায় শুনছিলাম। কিন্তু কোনোদিন তো এগুলো নিয়ে কারখানায় বা কোনও জায়গায় কাজ করতে দেখি নাই। তাই ভুলেই গেছিলাম।
“এগুলো এরা শুধু কয়। কামে তো হয় না। বেতনও দেবে না, সুবিধাও দেবে না। আমাদের নিয়ে কে ভাবে বলেন।”
নূরজাহানের মতো হতাশা প্রকাশ করেন নারায়ণগঞ্জের ডায়িং কোম্পানিতে চাকরি করা প্রকাশ শীলও। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “কইতে হবে দেখে কইছে। ওই সময় আমরা যেন আন্দোলন না করি, তাই কইছিল। এখন সব শেষ, আর আলাপ দিয়ে কী হবে?”
বারবার শুধু প্রতিশ্রুতিই আসে
শ্রমিকদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে, কিন্তু কাজ হবে না—এটাই শ্রমিকের নিয়তি বলে মন্তব্য করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক সাদেকুর রহমান শামীম।
সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “আন্দোলন চলছিল ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির জন্য। কিন্তু সরকার ঘোষণা করল এর অর্ধেক। তখন নির্বাচন প্রায় চলে আসছিল। তখন যদি শ্রমিকদের আন্দোলন আরও হতো তাতে বিপদে পড়ত সরকার। সেই বিপদ থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য এই ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে রেশন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল।
“এখন নির্বাচন শেষ। পরিস্থিত সরকারের অনুকূলে। এখন কি আর তাদের এটা মনে থাকবে। ছয় মাসের মতো হয়ে গেল, কিন্তু এখন পর্যন্ত এটা কীভাবে দেওয়া হবে—তা নিয়ে একটা মিটিং পর্যন্ত হলো না। শুধু আমরা যখন বলি তখন বলবে যে হয়ে যাচ্ছে। আমরা করে ফেলছি। কিন্তু সেই কাজ কখনোই হয় না।”
সাদেকুর রহমান শামীম বলেন, “সরকারের ভূমিকা খুব প্রয়োজন। একইসঙ্গে ফ্যামিলি কার্ডের জন্য মালিকপক্ষের উচিত ভূমিকা নেওয়া। তাদের সরকারকে চাপ দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
“বড় বড় গার্মেন্টস মালিক সবই সরকারেরই লোক। কেউ এমপি, মন্ত্রী, তা না হলে মেয়র। তারা চাইলেই তো অনেক কিছু হয়। কিন্তু তাদের শ্রমিকের জন্য কোনও টান নেই, তারা ভাবেই না শ্রমিকরা কীভাবে বাঁচে।”
পোশাক শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার সরকারি ঘোষণাকে ‘ছেলে ভোলানো’ বলে মন্তব্য করেছেন গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রতিবার মজুরি ঘোষণার সময় ছেলে ভোলানোর মতো করে রেশনের এই ঘোষণা আসে। কিন্তু পরে আর কিছু থাকে না। সবসময় সরকার এটা করে। মালিকপক্ষও এখানে সরকারের সহযোগী।”
প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় রেশনের দাবি জানিয়ে এই শ্রমিকনেতা বলেন, “রেশনের ব্যবস্থা করা খুব প্রয়োজন। কিন্তু দলীয় নেতাদের হাত দিয়ে সেটা দিলে তা কখনোই শ্রমিকের কাছে পৌঁছাবে না। শ্রমিকের কাছে পৌঁছানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই রেশন দিতে হবে।”
মালিকপক্ষ বলছে তাগাদা আছে
শ্রমিকদের রেশনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারকে বিজিএমইএ তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে—এমনই জানালেন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতিটির সভাপতি এস এম মান্নান (কচি)।
তিনি বলেন, “আমাদের কথা হয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং শ্রমমন্ত্রীর সাথে। আমরা নিয়মিত সরকারকে তাগদা দিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, এবার এটা আলোর মুখ দেখবে।”
এবারের বাজেটের পর থেকেই প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “সামনেই বাজেট। বাজেটটা গেলেই আমরা মন্ত্রণালয়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলব। এমনিতে সরকার আগ্রহী, ফলে খুব একটা সংকট হবে না বলেই আশা করি।
“বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ফ্যামিলি কার্ড বরাদ্দ করলে আলোচনাটা শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথে করার ব্যাপারেই আগ্রহী বিজিএমইএ।” সংগঠনটির সভাপতি বলেন, “আমাদের শ্রমিকদের ইস্যুটা তো শ্রম মন্ত্রণালয় দেখে। ফলে আমরা আলোচনাটা শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথেই করতে চাই।”
তিনি বলেন, “আমরা নিজেরা আলোচনা করছি। ফ্যামিলি কার্ডটা কীভাবে বরাদ্দ হবে। অনেকেই পাড়া-মহল্লা হিসাব করে দিতে চায়। কিন্তু আমার মনে হয়, এভাবে দেওয়ার থেকে সুষ্ঠুভাবে দেওয়ার জন্য কারখানাভিত্তিক হিসাবটাই ভালো হবে।”
যা বলল শ্রম মন্ত্রণালয়
পোশাক শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, দ্রুতই প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের কোনও দ্বিমত নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ ব্যাপারে খুব সিরিয়াস। আজকেই (বুধবার) আমাদের সভা হয়েছে, সেখানে মন্ত্রী মহোদয় এই বিষয়ে কথা বলেছেন আমাদের সাথে।
“নীতিগতভাবে আমরা একমত। এখন শুধু পরিকল্পনা তৈরি করা বাকি। আমরা আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা পরিকল্পনা সাজাবো।”
সবাইকে সঙ্গে নিয়েই পরিকল্পনা হবে বলে তিনি জানান।