Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

শুল্ক যুদ্ধ থেকে কি ট্রাম্প পিছু হটছেন

donald trump 1
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ফিরেই বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এই যুদ্ধের হাতিয়ার করেছেন শুল্ককে।

একের পর এক দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে গোটা বিশ্বের বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড়সড় ধাক্কা দিয়েছেন ট্রাম্প। পরিস্থিতি এতটাই অনিশ্চিত যে কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না, বিশ্ব অর্থনীতি কোন পথে এগোবে। মন্দার শঙ্কাও উঠেছে জেগে।  

হোয়াইট হাউস থেকে দাগানো শুল্ক তোপের আঘাতে এরই মধ্যে অনেক দেশের পণ্য বাণিজ্য ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কিছু দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দেন-দরবার করছে।

ব্যতিক্রম কেবল চীন। দেশটির যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করে যাচ্ছে।

শুল্কের ধাক্কা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেও (আইএমএফ) লেগেছে। সেখানে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যায়। বাজারে অস্থিরতা, সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা এবং বিভ্রান্তির মধ্যে বিশ্বের দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীরা একত্রিত হন। তারা চেষ্টা করেছিলেন ভেঙে পড়া পরিস্থিতির কিছুটা সামাল দিতে।

আইএমএফ-এর ওই বৈঠকে জি৭ ও জি২০ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সরাসরি শত্রুতা নয়, বরং হতাশা, বিভ্রান্তি ও গভীর উদ্বেগের মুখোমুখি হন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এমন এক সিদ্ধান্ত নেয়, যা চার বছরের মহামারি, যুদ্ধ এবং জ্বালানি সঙ্কক কাটিয়ে ওঠা বিশ্ব অর্থনীতিকে আবারও সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেয়।

বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে। কারণ এপ্রিলের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের ‘চাকরির লুটেরা ও দস্যু’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র দেশগুলোর অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে বলেই এমন মন্তব্য করা হয়।

জি৭ সম্মেলনে আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল জাপানের নীরব কিন্তু দৃঢ় ক্ষোভ। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন তাদের মনে বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচকরা আসলে কী চাইছেন, তা বোঝার অস্পষ্টতার কারণে সম্প্রতি জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড বিক্রি বেড়ে যায়। 

জাপানের অর্থমন্ত্রী কাৎসুনোবু কাতো বৈঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি ভীষণ হতাশাজনক। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করছে এবং বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।

২০২২ সালের কথা। তখন আইএমএফ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশের অর্থমন্ত্রীরা বিবিসির অর্থনীতি বিষয়ক সম্পাদক ফয়সাল ইসলামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ব্রিটেনে সবকিছু ঠিক আছে কি না?

তখন লিজ ট্রাস সরকারের ছোট বাজেট সঙ্কটের সময় যুক্তরাজ্যের জন্য বাজারের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছিল। অথচ সাধারণত যুক্তরাজ্যই এই ধরনের বাজার সঙ্কট সমাধানে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে।

পিছু হটার ইঙ্গিত

এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ড বাজারের অস্থিরতার মুখে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধে পশ্চাৎপসরণের মৃদু সংকেত আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।

চীনের সঙ্গে আলোচনায় ফেরার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেন একের পর এক শান্তির বার্তা দেওয়া হয়েছে। কখনও চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে, আবার কখনও বিশ্বের অর্থনীতিতে “সুন্দর ভারসাম্য” তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও চীনের বিরুদ্ধে লুটপাট ও দস্যুবৃত্তির অভিযোগ তোলা হয়েছিল।

কথা হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্টের সঙ্গে চীনের অর্থমন্ত্রীর বৈঠক হবে। এনিয়ে আশার আলো দেখছিলেন অনেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই বৈঠক হয়নি।

বেসেন্টের সঙ্গে দেখা করা অধিকাংশ দেশের প্রতিনিধিরা এখন বলছেন, তারা মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারছে না যে তারা যা করছে তা বাড়াবাড়ি। তাই তারা ধীরে ধীরে সেই অবস্থান থেকে সরে আসছে।

বিশ্বজুড়ে এখন একটা সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন নেই। কারণ ওয়ালমার্ট ও টার্গেটের প্রধান নির্বাহীরা প্রেসিডেন্টকে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করেছেন যে, মে মাসের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দোকানের তাকগুলো খালি হতে শুরু করবে।

বিশেষভাবে নজর দেওয়া হচ্ছে চীন থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দরের দিকে পণ্য পরিবহন ধসের দিকে। এই বন্দর ২১শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল। আইএমএফের গবেষকরা বলছেন, তারা মহাকাশ থেকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছেন, চীনের বন্দর থেকে কম এবং বেশিরভাগ খালি জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এসব বিষয় অস্বীকার করছে।

ওয়েস্ট উইংয়ের প্রহসন

এটা সত্য যে, আইএমএফ বৈঠকের শুরুতে যে বিশৃঙ্খলা ছিল, বৈঠকের শেষে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি শান্তি লক্ষ্য করা গেছে। এর কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট শুল্ক ইস্যুতে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায় এককভাবে বাজার ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ প্রশমিত করেছেন।

আর্থিক কূটনীতিকরা বলছেন, বেসেন্টের এই আধিপত্য এবং তথাকথিত পাল্টা শুল্কে ৯০ দিনের বিরতির পেছনে রয়েছে ওয়েস্ট উইংয়ের কিছু হাস্যকর ঘটনা।

গল্পটা আসলে এমন — বেসেন্ট তখনই ট্রাম্পের মনোযোগ পান, যখন হোয়াইট হাউজের আরেকজন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এক ধরনের চালাকি করেন। তিনি একটি ভুয়া বৈঠকের ফাঁদ তৈরি করে শুল্ক বাড়ানোর বড় সমর্থক ও বিতর্কিত সমীকরণের রচয়িতা পিট নাভারোকে ওভাল অফিস থেকে সরিয়ে দেন। অর্থাৎ নাভারো যাতে তখন ট্রাম্পের আশপাশে না থাকেন, সেটা নিশ্চিত করেন।

এদিকে ওয়াল স্ট্রিটের বড় বড় ব্যবসায়ী নেতারা ট্রাম্পকে পরামর্শ দেন, নাভারোকে চাকরিচ্যুত করা হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। তবে যারা ভেতরের খবর রাখেন, তারা বলছেন — ট্রাম্প কখনোই নাভারোকে বরখাস্ত করবেন না। কারণ নাভারো ২০২১ সালের জানুয়ারি ৬ তারিখের দাঙ্গার সময় ট্রাম্পের পক্ষে ছিলেন এবং এর জন্য তিনি কারাবরণও করেছিলেন।

সব মিলিয়ে সাংবাদিক ফয়সাল ইসলামের কাছে বর্তমান পরিস্থিতি যেন বাস্তব সময়ে লেখা হিলারি ম্যান্টেলের কোনও উপন্যাসের মতো মনে হচ্ছে, যেখানে ট্রাম্পের রাজসভাকে ঘিরে নানা ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, এই বিশৃঙ্খলা এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সরকার এখন এমন কিছু চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে, যা আগে অকল্পনীয় ছিল। বর্তমানে প্রত্যক্ষ শুল্কের প্রভাবের চেয়ে পুরো বিষয়টির অজ্ঞাত ভবিষ্যতই বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বেশি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুঃস্বপ্নের মতো এক পরিস্থিতি

ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে, এই অনিশ্চয়তা এখন কিছু অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক ধারণার জন্ম দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী আর্থিক চাপের সময় যাতে আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং ডলারের (ইউএস) সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ‘সোয়াপ লাইন’ চালু থাকে।

কিন্তু এখন বিশ্বের কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভাবতে শুরু করেছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের ডলার সোয়াপ লাইনকে কূটনৈতিক চাপ বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে কী ঘটতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব সোয়াপ লাইন প্রত্যাখ্যান করে বা ফেডারেল রিজার্ভকে সেগুলো সরবরাহে বাধা দেয়, সেটা কি একেবারে অকল্পনীয়? এখন ধরে নেওয়া হচ্ছে যে এটি হবে না। কারণ এর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তবে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থার জন্য এই দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি এখন আর পুরোপুরি অসম্ভব বলে মনে করা যাচ্ছে না।

আরেকটু কম অসম্ভব ধারণা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকা দেশগুলো তাদের কাছে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের ওপর কার্যত একটি কর চাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থায়নে সাহায্য করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপদেষ্টারা তাদের ভাষণ এবং গবেষণাপত্রে এ ধরনের কিছু ধারণা উত্থাপন করেছেন।

এই ধরনের পরিবেশে ভুল এবং উদ্বেগজনক ধারণাগুলো মানুষের আস্থা নষ্ট করতে শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রথম শুল্ক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণের বড় আকারের বিক্রি “কে করেছে” তা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়।

অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন এটি চীন করেছে। কিন্তু বর্তমানে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা। তাহলে কি জাপানের বিক্রিই ট্রাম্পকে শুল্ক বিরতিতে রাজি করাতে সাহায্য করেছিল? এটা কি ছিল এক ধরনের কৌশলগত কূটনৈতিক পদক্ষেপ? দুই বিশেষজ্ঞ এই সম্ভাবনার কথা বিবিসিকে জানিয়েছেন। যদিও এটা এখনও অসম্ভব বলে মনে হয়, তবে বর্তমান অস্থিরতা এই ধরনের আলোচনা সম্ভব করে তুলছে।

কেউ নতজানু নয়

স্কট বেসেন্টকে সম্প্রতি বলতে শোনা গেছে, “বিনিয়োগকারীদের জানা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ড বাজার বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ এবং স্থিতিশীল।” বাণিজ্য যুদ্ধের এমন পরিস্থিতিকে বেসেন্টের এই বক্তব্যকে একটা সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করে একজন গুরুত্বপূর্ণ অর্থমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে ফয়সাল ইসলাম বলেন, “বিশ্বের অর্থমন্ত্রীদের কেউই আমেরিকানদের কাছে মাথা নত করেননি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের নিজেদের বন্ড বাজারের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে, যা একটি অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা।”

আর এই অনিশ্চয়তার মধ্যে, কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না যে, সর্বজনীন ১০ শতাংশ শুল্কহার আসলেই আলোচনার বিষয় কি না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, এই শুল্ক রাজস্ব এতটাই বেশি হবে যে ‘অনেক মানুষের’ আয়কর পুরোপুরি বাতিল করা সম্ভব হবে। এতে মনে হয়, এই শুল্কহার টিকেই থাকবে।

একজন জি৭ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আপনি কাকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করছেন, তার উপর নির্ভর করে। আমি হোয়াইট হাউস, বাণিজ্য দপ্তর ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির তিনটি ভিন্ন অবস্থান শুনেছি। চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে জানেন? প্রেসিডেন্ট যেটা সেই মুহূর্তে চাইবেন, সেটা নির্ধারিত হবে শিল্প, বাজার এবং রাজনৈতিক চাপের ভিত্তিতে।”

যুক্তরাজ্যের ধারাবাহিক কূটনীতি

যুক্তরাজ্যের জন্য এই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ‘বেইসলাইন’ শুল্ক যুক্তরাজ্যের ওপর বড় ধরনের আঘাত হানবে। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য গাড়ির ওপর বড় শুল্ক বসানো হবে। ওষুধ শিল্পের (দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত) ওপরও শুল্ক আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণ যুক্তরাজ্যের জন্য ব্যাখ্যাতীত। কারণ, হোয়াইট হাউসের নিজের সংজ্ঞা অনুযায়ী যারা বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রাখে তারা ‘চিটিং’ করছে। অথচ এখানে যুক্তরাষ্ট্রই যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সামান্য উদ্বৃত্ত রাখছে।

এনিয়ে যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমি বুঝি কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে এত মনোযোগ রয়েছে। তবে সত্যি বলতে, আমাদের ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক হয়তো আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওরা আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী এবং প্রধান বাণিজ্য অংশীদার।”

এই মন্তব্য যুক্তরাজ্যে কিছু আলোড়ন তুলেছিল। তবে এই মন্তব্য কোনও আকস্মিক ভুল ছিল না।

এর কারণ খাদ্য নিরাপত্তার মান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপস করা যুক্তরাজ্যের জন্য ঘরোয়া রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ। যুক্তরাজ্যের ধারাবাহিক কূটনীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্র এটা এখন বুঝে নিয়েছে। বর্তমানে আলোচনা একটি প্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধি চুক্তির দিকে এগোচ্ছে।

এখন পরিষ্কার মনে হচ্ছে, যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে “উচ্চ আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চ সংহতি” ভিত্তিক একটি চুক্তি করতে চলেছে। এই খবর ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী অর্থমন্ত্রিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিশ্বে নতুন সমন্বয় প্রচেষ্টা

যুক্তরাজ্য-ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্কের উন্নতির উদাহরণ দিয়ে একজন জ্যেষ্ঠ আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা বলেন, “বিশ্ব এখন যুক্তরাষ্ট্রের অবিশ্বাসযোগ্যতার প্রতিক্রিয়ায় সমন্বয় করছে এবং নিজেদের কাজ ঠিকমতো করছে। ব্রেক্সিট ছিল একটি তিক্ত বিচ্ছেদ। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আবার দেখা-সাক্ষাৎ শুরু হয়েছে।”

এছাড়া কিছুটা স্বস্তি ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র এখনও বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে থিঙ্কট্যাংক হারিটেজ ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘প্রোজেক্ট ২০২৫’ পরিকল্পনায় দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এই আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো থেকে বেরিয়ে আসার ধারণা রাখা হয়েছিল। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর সম্প্রতি এই বিষয়ক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

স্কট বেসেন্ট এই বৈঠকগুলো ব্যবহার করে নিশ্চিত করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাংক ও তহবিলের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখবে। তবে এটি হবে তাদের মূল কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে; সামাজিক ইস্যু এবং পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রম থেকে সরে গিয়ে। ইউরোপীয় নেতারা এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখছেন।

বৃহত্তর সংঘর্ষের ইঙ্গিত

বড় প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই বাণিজ্য যুদ্ধকে ব্যবহার করে সারা বিশ্বকে নিজেদের পক্ষে টেনে এনে চীনের বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর সংঘর্ষে যেতে চায়? যদি তা হয়, তাহলে মিত্রদের এতটা ক্ষুব্ধ করা বিস্ময়কর ব্যাপার, কারণ এটি মূল কৌশলের বিরুদ্ধে যায়। এখানে একটি পরীক্ষামূলক ঘটনা হলো স্পেনের পরিস্থিতি। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ হিসেবে ২০ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে।

স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ দুই সপ্তাহ আগে বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। স্পেনের অর্থনীতি বর্তমানে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। গত বছর এটি উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে এবং চলতি বছরও একই ধারার পূর্বাভাস রয়েছে। এই অর্থনীতির ভিত্তি হলো সবুজ জ্বালানি, বিদেশি শ্রমের প্রবেশাধিকার, পর্যটন এবং চীনের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি স্থানান্তর।

যুক্তরাষ্ট্র এই সফরকে ভালোভাবে নেয়নি। তারা স্পেনের অর্থমন্ত্রী কার্লোস কুয়ের্পোর সঙ্গে ওয়াশিংটনে খোলামেলা আলোচনা করেছে।

কুয়ের্পোকে এই নিয়ে খুব একটা বিচলিত মনে হয়নি। ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত সেমাফর ওয়ার্ল্ড ইকোনমি সামিটে তিনি বলেন, “চীনের সঙ্গে আমাদের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এটা শুধরাতে হলে আমাদের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হবে। তাদের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হবে, অবশ্যই সামগ্রিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কাঠামোর মধ্যে থেকে। আর এটা সম্ভব কেবল চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি সংলাপের মাধ্যমে।”

স্পেন ইতোমধ্যেই চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ কারখানায় বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর নিশ্চিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এতে অসন্তুষ্ট। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি স্পেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চীনের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বাসযোগ্য মিত্র বানাতে চায়, তাহলে গত মাসের শুল্ক আরোপের বিশৃঙ্খলা এই কৌশলকে জটিল করে তুলেছে।

কানাডার ভূমিকা ও আগামী

কানাডার আসন্ন নির্বাচন এই বৈশ্বিক পরিবর্তনশীল আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নতুন নির্বাচিত কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য আলোচনা শুরু করতে পারেন কি না, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।

এরপর তিনি জুনে কানাডায় জি-৭ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্ধারিত ৯০ দিনের সময়সীমা শেষ হবে। অনুমান করা হচ্ছে, ট্রাম্প আলবার্টায় সফর করবেন। এটি সেই দেশ, যাকে তিনি কখনও কখনও নিজের দেশের অংশ বলেও দাবি করেন।

সামনে সম্ভাবনা ও শঙ্কা

এখনও শান্তি, স্থিতি ও উত্তেজনা নিরসনের একটি পথ খোলা আছে। তবে পরিস্থিতি আরও খারাপও হতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সপ্তাহ সামনে রয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত