বাংলাদেশের নবযাত্রায় পাটখাতকে গুরুত্ব না দিলে টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি দাঁড় করানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশ যদি নতুন দেশ হিসেবে দাঁড়াতে চায়, তাহলে পাটকে কেন্দ্র করেই তা করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই করতে পাটের কোনও বিকল্প নেই “
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত ‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটখাত চালু : সমস্যা সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, “পাট ও পাটকলের সঙ্গে অনেক শ্রমিকের ভাগ্য জড়িত। স্বাধীনতার পর এমন কেউ আসেনি যারা পাটখাতকে গুরুত্ব দিয়ে কোনও নীতিমালা তৈরি করেছে। সব সরকারই পাটখাতকে কম গুরুত্ব দিয়েছে।”
২০০২ সালে আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “পাটকলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক যুক্ত হয়। ২০০২ সালে আদমজী পাটকল বন্ধ করা হলো, যা সেসময় পাট গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বা পাট সচিব জানতেন না। কীভাবে হলো এটা? আমরা তখন দেখলাম, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রশংসা করছে বিশ্বব্যাংক। আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদও আদমজী বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রশংসা করেছিলেন।
“আদমজী পাটকল বন্ধ করার পর নতুন পাট নীতি নিল ভারত। সব ধরনের বস্তা, ব্যাগে পাট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল তারা। সারা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এখন কেউ এসে যদি বলে পাটের চাহিদা কমছে, সেটা মিথ্যাচার হবে।”
পাট শিল্পকে শুরু থেকেই প্রধান শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হলে পরিবেশবান্ধব শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হতে পারত বলেও মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, “আদমজীর পর সব সরকার এক এক করে পাটকল বন্ধ করতে থাকল। এসব পাটকল বন্ধ করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হলো, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ টাকা দিয়ে এসব পাটকল আধুনিকায়ন করা যেত। পাটজাত পণ্য বৈচিত্র্যময় করা যেত।”
ভেঙে পড়া পাটশিল্পে কীভাবে প্রাণ সঞ্চার করা যায়, সে পরামর্শও দেন আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, “এখন এটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে ঝুঁকি নিতে হবে। গবেষণা করতে হবে। দ্রুত মুনাফা আসবে না, তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগ করবে না। সরকারকেই পাটশিল্পে বিনিয়োগ করতে হবে।”
শনিবার রাতে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ টেনে আনু মুহাম্মদ বলেন, “গোলাম দস্তগীর গাজীকে কোনও এক পাইকারি মামলায় জেলে নেওয়া হয়েছে। পাটকল বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের যেভাবে বঞ্চিত করা হলো, সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সেই অপরাধ তদন্ত করতে হবে।
“আমি বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টাকে বলব, অবিলম্বে পাটখাতে কী কী দুর্নীতি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখুন। কীভাবে শ্রমিকদের ঠকানো হয়েছে, তার শ্বেতপত্র বের করুন। আগামীতে সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তার রূপরেখা দিন। এসব করার ক্ষমতা এই অর্ন্তবর্তী সরকারের আছে।”
সেমিনারে লিজ ও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির নামে বন্ধ করা দেশের ২৬টি পাটকলের ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যক্তিখাতে চলে গেছে বলে অভিযোগ করে জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ।
একই সঙ্গে ২৬টি সরকারি পাটকলসহ দেশের ৭৭টি পাটকল পরিচালনায় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) বর্তমান কাঠামোকে পরিবর্তনেরও দাবি জানায় সংগঠনটি।
পরিষদের নেতা শামীম ইমাম বলেন, “ক্রমাগত লোকসানের দোহাই দিয়ে ২০২০ সালের ২ জুলাই ২৬টি সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এতে ৫১ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যায়। ৪০ লাখ পাটচাষী এবং পাটচাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ৪ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
পরিষদের আরেক নেতা আব্দুল্লাহ আল ক্বাফী রতন বলেন, “আওয়ামী লীগ সরকার বন্ধ পাটকলগুলো পিপিপির সহযোগিতায় পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিল। লিজ বা পিপিপির মাধ্যমে সরকারি কলকারখানা পরিচালনার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এটা লুটপাটের পথ অবারিত করে।”