শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে আদালতের নির্দেশনা মেনে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কার করেছে সরকার; যাতে বাদ পড়েছে নারী ও জেলা কোটা।
আগে যেখানে সরকারি নিয়োগে ১০ শতাংশ করে পদ নারী ও জেলা কোটায় ছিল, তা এখন আর থাকল না। এই পদক্ষেপ সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসাবে কাজ করবে বলে মত আসছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা বলা আছে।
এই অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারায় বলা আছে- “মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।”
এই অনুচ্ছেদেরই তৃতীয় ধারায় নারীদের নিয়ে বলা আছে- “জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে।”
নারী ও অনগ্রসরদের সমতার পথে এগিয়ে আনার লক্ষ্যে সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থা ছিল।
২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ কোটায় সংরক্ষিত ছিল। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার পাশাপাশি ছিল নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলনে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা বাতিল করে সরকার; যদিও আন্দোলনকারী নেতারা বলে আসছেন, পুরোপুরি বাতিল নয়, তাদের চাওয়া ছিল সংস্কার। তখনও অন্য সব চাকরিতে আগের মতোই ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুলে দেওয়া চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন হলে গত জুন মাসে হাইকোর্ট সব কোটা পুনর্হালের করে রায় দেয়।
তার প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা ফের আন্দোলনে নামে। গত সপ্তাহে সেই আন্দোলন ব্যাপক সহিংসতায় গড়ায়, নিহত হয় দেড় শতাধিক মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সান্ধ্য আইন জারি করে সেনা মোতায়েন করতে হয় সরকারকে।
এরপর গত রবিবার হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে কোটার অনুপাত পুনর্বিন্যাস ঠিক করে সরকারকে নির্দেশ দেয়। এরপর মঙ্গলবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে নিয়োগে ৯৩ শতাংশ পদ মেধার ভিত্তিতে রেখে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, অনগ্রসর নৃগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটার প্রজ্ঞাপন দেয়।
কোটার নতুন অনুপাত নিয়ে সংক্ষুব্ধ দেশের নারী অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, এতে নারীরা পিছিয়ে পড়তে পারে।
উন্নয়নকর্মী শাহানা হুদা রঞ্জনা মনে করেন নারীর জন্য কোটা থাকার প্রয়োজন এখনও রয়েছে দেশে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নারীর অগ্রযাত্রা রয়েছে, এরপরও অনেক নারী এখনও অনগ্রসর। আমাদের দেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে নারীর ফলাফল অনেক ভালো। ভীষণ ভালো করার পরও কিন্তু পরের ধাপগুলোতে তাদেরকে সেভাবে পাওয়া যায় না, যেমনটা পুরুষকে পাওয়া যায়। চাকরিতে গিয়ে সেই সংখ্যা আরও কমে যায়।
“আমি মনে করি, নারীকে এখনও কোটা দিতে হবে, ফ্যাসিলিটি দিতে হবে। কারণ, এখন নারী অনেক পরিবারে একক আয়ের মানুষ, এ বিষয়টা ভাবতে হবে। কোটা না থাকলে আমার মনে হয় সরকারি চাকরিতে বিশেষ করে প্রশাসনে নারীর সংখ্যা কমে যাবে; যেটা আমাদের জন্য মোটেই ভালো কিছু হবে না।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেও নারী কোটা তুলে দেওয়ার স্লোগান শোনা গেছে, তাদের প্ল্যাকার্ডেও এমন বক্তব্য ছিল।
নারী অধিকারকর্মীরা মনে করেন, সমাজের সুবিধাভোগী একটি জায়গায় বসে এমন কথা বলা যেতে পারে, কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে নারীদের কথা তা নয়।
রঞ্জনা বলেন, “তারা (আন্দোলনকারী নারী শিক্ষার্থী) কী বলছেন, কতটুকু বুঝে ‘কোটা চাই না’ বলছেন, সে নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”
একই কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিমও। তা ভাষ্যে, “যারা দাবি তুলেছে যে নারীর কোটা প্রয়োজন নেই, সেসব শিক্ষার্থীরা এখনও বাস্তবতার মুখোমুখি হয়নি।”
নারী কোটা তুলে নেওয়ার অবস্থায় এখনও যায়নি বাংলাদেশ, এমনটাই মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানের এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে মোট জনগাষ্ঠীর অর্ধেক নারী, সেখানে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে কোটা তুলে দিতে হবে।
“সকল ধর্মে নারীর প্রতি বৈষম্য রয়েছে, বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির অধিকার- সবকিছুতেই নারী পিছিয়ে। যদিও নারীর জন্য কাজ করা হচ্ছে, কিন্তু যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল, সেখানে আমরা যেতে পারিনি।”
বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় নারীদের অবস্থান তুলে ধরে সাদেকা হালিম বলেন, “মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও নারীরা এখনও পিছিয়ে রয়েছে।
“বিয়ে, সংসার, দায়িত্ব- সব নারীর ওপর বর্তায়, এসবের বেড়াজালে পড়ে নারীর আর এগিয়ে যাওয়া হয় না, সুযোগ পায় না। যার ফলে আর্থিকভাবেও সে ক্ষমতায়িত হয় না, পিছিয়েই থাকে সে।”
২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পর সর্বশেষ ৩৮তম বিবিএস পরীক্ষায় নারী নিয়োগের হার আগের ২৭ শতাংশ থেকে ১৭ শতাংশে নেমে আসার তথ্য দেন তিনি।
“এই যে আজ আমি সাদেকা হালিম, আমি যে কমনওয়েলথ স্কলার তিনবারের, সেটা মেধাবী হিসেবে কেবল নয়, সেখানে জেন্ডার ডাইমেনশনও বিবেচনায় এসেছে,” নিজেকে দিয়েই উদাহরণ দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
নারী কোটা বাতিল নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী এখনই কিছু বলতে রাজি হননি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নারী কোটা নিয়ে কথা বলতে হলে চট করে কিছু বলা যাবে না, অনেক গভীরতার বিষয় এটি। তাই এ বিষয়ে আমি এখনই কোনও মন্তব্য করব না।”
নারী কোটা অবশ্যই রাখা দরকার বলে মনে করেন নারীদের আইনি সহায়তা দেওয়া হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আইনজীবী এলিনা খান।
তিনি নারী কোটার পক্ষে হলেও জেলা কোটার বিরুদ্ধে। এর পেছনে তার যুক্তি- “জেলা কোটায় জীবনে দেখিনি মেধাবী কেউ এসেছেন; সব রাজনৈতিক লোক, সব সুপারিশের লোক।”
তবে পিছিয়ে থাকা এলাকার মানুষকে এগিয়ে আনার জন্য জেলা কোটার প্রয়োজনের কথাও বলছেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এর সভাপতি আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
তিনি বলেন, “নারী, পিছিয়ে পড়া জেলা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য কোটা থাকা অবশ্যই দরকার। নাহলে একই ধরনের বিতর্ক বারবার আসবে।”
সর্বোচ্চ আদালত কোটার একটি অনুপাত ঠিক করে দিলেও বলেছে, তবে সরকার চাইলে এই অনুপাত পুনর্নির্ধারণ করতে পারে।
তাই এই কোটার অনুপাত নিয়ে ভবিষ্যতে সরকার কিছু একটা করবে, সেই আশায় আছেন নারী অধিকারকর্মীরা।
এলিনা খান বলেন, “উচ্চ আদালত কিন্তু এটা বেঁধে দেয়নি, তারা পলিসি মেকার বা নীতি নির্ধারকদের কথা বলেছে। তারা (সরকার) চাইলে এটা পরিবর্তন, পরিমার্জন করা যাবে।”
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদও ভবিষ্যতে কোটার অনুপাত পরিবর্তনের সুযোগ থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “যেহেতু ভীষণ সংবেদনশীল একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা গিয়েছি, যেহেতু তড়িঘড়ি করে গেজেট করা হয়েছে, তাই হয়ত এটা সম্ভব হয়নি।
“কিন্তু এখনও আমি মনে করি, নারীর বিষয়টি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আদালতও এটা করতে পারতেন। তবে রায়ের ভেতরে কিন্তু বলা হয়েছে, সরকার চাইলে এটা পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন করতে পারবেন; সে সুযোগ এখনও রয়েছে। আর এটাতো সংবিধানেই রয়েছে, যারা অনগ্রসর রয়েছেন, তাদের মূল ধারায় আসার জন্য সুযোগ থাকা দরকার, কম হলেও দরকার।”
নৃগোষ্ঠীর কোটা ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আদিবাসী সংগঠনগুলো।
নৃগোষ্ঠীর কোটা কমিয়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “কী এমন অগ্রগতি হলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যে এক লাফে তাদের কোটা এক শতাংশে নামিয়ে আনা হলো?”
জেএসএস সমর্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এক বিবৃতিতে বলেছে, দেশে বসবাসরত ৫০টির অধিক ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠীর জন্য মাত্র ১ শতাংশ কোটা বরাদ্দ ‘অগ্রহণযোগ্য’।
“দেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম ও অনগ্রসর অংশ হলো আদিবাসীরা। তারা দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনোভাবেই উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না।”
অধিকাংশ আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে এখনও বিসিএসে প্রতিনিধিত্ব নেই উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “তাই মাত্র ১ শতাংশ কোটা ৫০টির অধিক জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের মূল স্রোতধারার সাথে অন্তর্ভুক্ত করার রাষ্ট্রীয় নীতি কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”
সরকার এখন কোটার প্রজ্ঞাপন জারি করলেও ভবিষ্যতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি যৌক্তিক হার ঠিক করবে বলে আশা করছেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।