আমাদের দেশে এখন ‘নারী প্রশ্ন’ নতুন করে সামনে এসেছে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে। এই আন্দোলনের মুখে নতুন একটি রায় দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর আগে গত ২১ জুন কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানি হয়, কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের আগের রায় বাতিল হয়। এখন নতুন রায়ে মেধায় ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ নির্ধারণের আদেশ দেওয়া হয়। কোটা থেকে প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে, এমনটাও জানা গেছে। তবে, সরকার চাইলে নিজেদের মতো কোটা নির্ধারণেরও সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু সরকার সেটা না করে আদালতের রায়ে ওই ৭ শতাংশ কোটার গেজেট জারি করেছে। নতুন এই ব্যবস্থায় দেখা যায়, নারীর জন্য কোনও কোটা নেই। সেই প্রেক্ষিতেই এত কথার অবতারণা।
গত জুলাই মাসের শুরু থেকে পুরো মাস জুড়েই দেশের শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সবচেয়ে বড় ইস্যু বা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। দেশের নাগরিক হিসেবে, সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষের সঙ্গে কী ঘটছে না ঘটছে সেটা নিরীক্ষণ করা একান্ত কর্তব্য। সে জন্যই সংবাদ মাধ্যমে চোখ রেখে এই আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখছিলাম। সেই সূত্রে এই আন্দোলন সম্পর্কে পর্যবেক্ষণগুলো এক এক করে বলি।
প্রথমত, আমার মতে, সড়ক অবরোধ করে জনজীবনে দুর্ভোগ তৈরি করা ছিল এই আন্দোলনের একটি ভুল পদক্ষেপ। সড়কে সমাবেশের সময় দেখা গেছে নাগরিকেরা শিক্ষার্থীদের ন্যয্য দাবির প্রতি সংহতি দেখিয়ে অনেকেই বাস গাড়ি ছেড়ে হেঁটে যাত্রা করেছেন গন্তব্যে। কিন্তু সড়কে কেবল চাকরিজীবীরা অফিস করতে যান না, চলাচল করেন অনেক বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষ। সড়কে কাজ করেন অনেক ফেরিওয়ালা, শ্রমিকের মতন খেটে খাওয়া মানুষ। দিন আনি দিন খাই পদ্ধতিতে কায়িক শ্রমে চলা এই সকল মানুষের জন্য একদিন কাজে ব্যঘাত মানে হয়তো বৃদ্ধ ও শিশুসমেত পরিবারের পাঁচ, সাত বা দশ জনের জন্য অনিবার্য অনাহার। এই জ্যামের নগরীতে কর্মজীবী মানুষের জন্যও গৃহকর্মীর দায়িত্বে রেখে আসা শিশুর কাছে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা কেন দুই মিনিট দেরিও মধ্যবিত্ত বাবা মায়ের জন্য শাস্তি স্বরূপ।
প্রতিবাদ জানানোর আরও নানা পদ্ধতি হতে পারে। যেমন দেশ জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন। পেনশন স্কিম নিয়ে আপত্তি জানানোর পদ্ধতি হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন কর্মবিরতি বা ক্লাস বর্জন। শিক্ষার্থীরাও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করতে পারতেন, শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ করতে পারতেন, গণস্বাক্ষর অভিযান চালাতে পারতেন, দেয়াল লিখন করতে পারতেন, এমনকি সংগঠিত হয়ে কর্মসূচি দিয়ে মন্ত্রণালয় ঘেরাও করতেও পারতেন— এমন অনেক কিছুই হতে পারত তাদের প্রতিবাদের ভাষা। কিন্তু তা না করে আন্দোলনের শুরুতে তারা সড়ক অবরোধের মাধ্যমে জনজীবনে ভোগান্তি তৈরি করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তারা কোটা সংস্কার এবং কোটা বাতিল এই দুইটি বিষয় নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেননি। কেন বললাম তা ব্যখ্যা করছি, ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনের পর সব প্রকার কোটা বাতিল করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে তাঁর যুক্তি ছিল, মুক্তিযোদ্ধা কোটা না থাকলে অন্য কোনও কোটাই প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য নয় যে, এটা কোনও গ্রহণযোগ্য যুক্তিই হতে পারে না। অথচ সে সময় শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে তেমন কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। ফলে ‘সংস্কার’ এবং ‘বাতিল’ এই দুইয়ের মধ্যে কোনটা তারা চান সে বিষয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। গত ছয় বছর কোনও প্রকার কোটা পদ্ধতিই কাজ করেনি কর্ম কমিশনের প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের নিয়োগে।
তৃতীয়ত, আদালতে বিচারাধীন কোনও বিষয় নিয়ে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করাটা আন্দোলনের যৌক্তিকতাকে খর্ব করে। যেখানে আদালতের রায় দেওয়ার দিনও ধার্য হয়ে গিয়েছিল, সেই রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করাই হতো সবচেয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজ। আমি বলছি না এই আন্দোলন অযৌক্তিক বা অন্যায্য। কিন্তু ভুল পদক্ষেপের কারণে যৌক্তিক দাবি প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার সুযোগ দেওয়া কোনওভাবেই কাম্য হতে পারে না। এক একটি দাবি আদায়ের আন্দোলন এক একটি যুদ্ধের মতো, যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তি এবং সাহসের মতো কৌশলও অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কৌশলগত পদক্ষেপ যৌক্তিক দাবিকে শক্তিশালী করে, দাবি আদায়ের পথকে প্রশস্ত করে। আর ভুল কৌশল অবলম্বন করলে উল্টোটা ঘটে।
চতুর্থত, এই বারের (২০২৪) আন্দোলনেও আন্দোলনকারীদের একাংশ নারী কোটা বাতিলের পক্ষে আওয়াজ তুলেছে। তারা পুরো কোটা ব্যবস্থা বাতিলপন্থী না সংস্কারপন্থী তা আমার জানা নেই। কিন্তু, ‘‘আমি নারী পাই না ভয়, কোটা ছাড়াই করব বিশ্বজয়’’ শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ডের ছবি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে। এই শ্লোগানটিকে আত্মঘাতী বলা হলেও হয়ত অত্যুক্তি হবে না। প্রথমবার ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর অভিমানের মুখে কোটা তুলে দেওয়ার পর কেটে গেছে অর্ধযুগ। বিগত ছয় বছরে সরকারী কর্ম কমিশনের নিয়োগে নারীর হিস্যা শতকরা ২৬ ভাগ থেকে নেমে শতকরা ১৯ ভাগ হয়ে গেছে।
নিশ্চয়ই ২০১৮ সালে যারা আন্দোলন করছিলেন এখন তাদের অনেকেই আর ছাত্র নেই, বা তাদের চাকরির বয়স নেই ফলে আন্দোলনেও তারা আর মাঠে নেই। কিন্তু বর্তমান আন্দোলনকারীদের ‘নারী কোটা’ না থাকার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কোনও ধারণা তো নেইই, কোনও তথ্য উপাত্তও নেই বলেই মনে হয়। তারা একটি ফলস কনশাসনেসকে ধরে বসে আছেন যে নারী এখন আর অনগ্রসর নয়— যে ধারণা পুরোপুরি ভুল।
শিক্ষার্থীদের কাছে যেমন তথ্য উপাত্ত ও পরিসংখ্যান নেই, তেমনি আদালতের কাছেও নেই কোনও পরিসংখ্যান বা গবেষণা ফলাফল। আদালত কোনও ব্যাখ্য-বিশ্লেষণ ছাড়াই নারী কোটা না রেখেই রায় দিয়ে দিয়েছেন। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী প্রাণ দিয়েছেন, হতাহত হয়েছেন, অন্ধ হয়ে গিয়েছেন, আন্দোলন থামিয়ে দিতে রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নে জনগণের মধ্যে যে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে , তাতে তাড়াহুড়ো করে যেনতেন ভাবে একটি রায় দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করবার চেষ্টা করা হয়েছে বলে ধারণা করলে হয়ত ভুল হবে না।
এই আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতায় শুধু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নন, প্রাণ দিয়েছেন বৃদ্ধ থেকে শিশু, শ্রমজীবী ও রিকশাচালক থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। এই আন্দোলনের অস্থিরতা কমাতে দেশজুড়ে গ্রেফতার ও আটক হয়েছেন শত শত শিক্ষার্থী। ফলে এই মুহূর্তে চলমান এই আন্দোলনের ভুলত্রুটি বা এই রায়ের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলা অমানবিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তারপরও কাউকে না কাউকে কথাগুলো বলতেই হবে। কেননা মহাভারতের ঘটোৎকচের মতন এখানেও নারীকেই উৎসর্গ করা হয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। তাই নারী ও মানবাধিকার কর্মীরা এই রায় নিয়ে সরব হচ্ছেন, কথা বলছেন এবং লিখছেনও।
এবারে আসি নারী কোটা না থাকা কেন জনস্বার্থ পরিপন্থী— সেই প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে অনগ্রসর জাতি, গোষ্ঠী বা শ্রেণির জন্য বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এই ব্যবস্থা চিরস্থায়ী নয়, বরং ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের অনগ্রসর অংশের সর্বস্তরে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হয়। সে হিসেবে নারী কোটা বাতিল চাওয়া বা করা বা হওয়া— এই সবকয়টিই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক । শিক্ষার্থীদের দাবি ও আদালতের রায় উভয়কেই এই দোষে দুষ্ট করা যেতে পারে।
সংবিধান ছাড়াও একটি রাষ্ট্রের আরও নানা রকম দায়বদ্ধতা থাকে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সিডও সনদে অনুস্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। সিডও হচ্ছে ‘কনভেনশন অন এলিমিনেশন অব অল ফর্ম অব ডেসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন’। এতে স্বাক্ষর করবার অর্থ হচ্ছে কেবল শিক্ষা ও সরকারি চাকরি নয়, সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসন করতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।
পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই নারীর জন্য কোটা ব্যবস্থা বিদ্যমান। বিশেষত অনুন্নত ও পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোতে নারীর অবস্থা এমনিতেই নাজুক থাকে। যেমন, পাকিস্তানে নারী, জাতিগত সংখ্যালঘু ও স্বল্পোন্নত অঞ্চলের ব্যক্তিদের জন্য সরকারি চাকরিতে পদ সংরক্ষণ করা হয়েছে। নেপালের সংবিধান দলিত, আদিবাসী, নারী ও মদেসি সম্প্রদায়ের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটার নিশ্চয়তা দেয়। ভারতেও একইভাবে নানা অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠী-শ্রেণির জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ করা আছে।র
এমনকি কানাডায় বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু, নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি চাকরিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কোটা ব্যবস্থা না থাকলেও, সংখ্যালঘু ও নারীদের কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগে ন্যায্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপের নীতি রয়েছে। কানাডা ও আমেরিকাকে মনে করা হয় উন্নত রাষ্ট্র। এই উন্নত ও শিক্ষিত রাষ্ট্রগুলোও যেখানে মনে করছে নারী ঐতিহাসিকভাবেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে, যে কারণে নারীর জন্য বিশেষ সুবিধা বা সুযোগ তারা বহাল রাখছে। সেখানে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মেয়েরা অনেক এগিয়ে গিয়েছে, তাদের জন্য আর কোটার প্রয়োজন নেই— এই দাবি নিতান্ত হাস্যকর নয় কি?
নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনের জন্য কোটা পদ্ধতি প্রচলন পুরুষ বা অন্য লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষের জন্য বৈষম্যমূলক নয় কোনও মতেই। বরং একে বলা হয় ‘পজেটিভ ডেসক্রিমিনেশন’। ততদিন পর্যন্ত এই পদ্ধতির প্রয়োজন রয়েছে যতদিন না নারী সর্বক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেক স্থান অর্জন না করছে। বলা বাহুল্য অর্ধেক স্থান অর্জন করবার জন্য এখনও হাঁটতে হবে বহু দূরের পথ।
এই রায় সম্পর্কে আরও একটি বিষয় না বললেই চলছে না। তা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে যে হিসেব দেখানো হচ্ছে তাতে মস্ত বড় একটা ফাঁকি রয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কিছু কিছু খবরেও বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু এই শতকরার হিসাবের ফাঁকিটা একটু ঠাণ্ডা মাথায় অংক করলেই বোঝা যায়। আগে ৫৬টি কোটার মধ্যে ৩০টি ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান সন্ততিদের জন্য বরাদ্দ যা মোট কোটার ৫৩.৫৭ শতাংশ। এখন ৭টি কোটার মধ্যে ৫টি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য বরাদ্দ যা মোট কোটার ৭১.৪২ শতাংশ। ফলে এই রায়কে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো এবং প্রতারণামূলক বললেও অত্যুক্তি হবে না।
তবে, সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই যে কোটার বাইরে চাকরি প্রার্থীদের জন্য ৯৩ শতাংশ স্থান ছেড়ে দেওয়া হলো তা যদি বহাল থাকে তাহলে তাতে সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হবে নারীকেই। ন্যায্য দাবি আদায়ের এই যুদ্ধে নারীই হয়ে গেলো বলির পাঁঠা। অথচ শিক্ষার্থীদের যে ‘মূল দাবি’, তৃতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা প্রকৃত প্রতিযোগিতার পথকে খর্ব করে, সেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম বা নাতি-নাতিনরা কোটা পাবে না বটে, তবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটার ভাগ মোট কোটার সাপেক্ষে আনুপাতিক হিসাবে বেড়ে গেল। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই আন্দোলনের ফলে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা সামনে এসেছেন যারা দাবি করেছেন যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা তাঁরা সমর্থন করেন না। অনেকেই এই কোটা ব্যবস্থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননাকর বলেও মনে করেন। সরকারি চাকরিতে ‘কোটা ব্যবস্থার যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত সংস্কারের’ দাবি জানিয়েছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ -৭১। সংগঠনটি মনে করে, অনেক বছরের ব্যবধানে, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পার হওয়ার পর আগেকার কোটা ব্যবস্থার যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তবসম্মত সংস্কার হতে পারে— যাতে নতুন প্রজন্মের সত্যিকার মেধাবীরা বঞ্চিত না হয়।
সবশেষে বলা যেতে পারে, কোটা ব্যবস্থা মূলত অনগ্রসর গোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বাস্তবায়ন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারমাত্রই যেমন ‘অনগ্রসর’ ধরে নেওয়া যৌক্তিক না তেমনি নারীকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, শারিরীক প্রতিবন্ধী এহেন নানা মানুষের তুলনায় অগ্রসর হিসেবে পুরুষের সমান অগ্রসর বলে ধরে নেওয়াও ততটাই অবিমৃষকারীতার লক্ষণ।
অন্যদিকে, তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কোটা নির্দিষ্ট করা এই রায়ের একটি ইতিবাচক দিক যাকে বাহবা জানাতেই হয়। তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গে হরিজন, যৌনকর্মী, বেদে সম্প্রদায় বা এমন আরও নানা প্রান্তিক ও সত্যিকারের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্যও কোটা বহাল করা বাঞ্ছনীয়। তাহলেই সংবিধানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণ হতে পারে, বৈচিত্রের ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হতে পারে।
কাজেই এই কথা দাবি করা যেতেই পারে যে, এই রায় কোনও দিক থেকেই ন্যয্য হয়নি। এই রায় ছাত্রসমাজ মেনে নেয়নি, নারীসমাজও মেনে নেবেনা। ফলে এই কোটা ব্যবস্থা নিয়ে রাষ্ট্র ও ছাত্র-তরুণদের চলমান দ্বন্দ্ব দীর্ঘস্থায়ী হবে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।
ইমেইল: [email protected]