প্রাকৃতিক জগতের শব্দ দ্রুত নৈঃশব্দে রূপ নিচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে পদক্ষেপ না নিলে সেই শব্দ “শ্রুতিগত জীবাশ্মে” পরিণত হবে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।
প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও প্রাণবৈচিত্র্য পরিমাপে শব্দও ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে। আমাদের বন, মাটি ও মহাসাগরগুলোর নিজস্ব শব্দ রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বণ্যপ্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে প্রাকৃতিক আবাসস্থলগুলো নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে। পাখির সকালের ডাক, স্তন্যপায়ী প্রাণীর গর্জন এবং পোকামাকড়ের গ্রীষ্মের গুঞ্জন কমে যাচ্ছে।
ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভ সিম্পসন বলেন, “সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক বাস্তুতন্ত্রে মৃত্যুর মতো নীরবতা নেমে আসছে। কিছু বাস্তুতন্ত্রে আমরা হয়তো কেবল আবিষ্কার করেছি যে, তারা এমন শব্দ করে, অথচ কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে আর কোনও শব্দ নেই।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক শব্দ রেকর্ডকারী বার্নি ক্রাউস বলেছেন, পরিবর্তনগুলো গভীর এবং সর্বত্র ঘটছে। তিনি গত ৫৫ বছরে সাতটি মহাদেশ থেকে ৫ হাজার ঘণ্টার বেশি প্রাকৃতিক শব্দ রেকর্ড করেছেন। তবে তিনি যেসব প্রাকৃতিক আবাসস্থল থেকে শব্দগুলো রেকর্ড করেছেন সেগুলোর ৭০ শতাংশই এখন ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পারডু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্রায়ান পিজানোস্কিও ৪০ বছর ধরে প্রাকৃতিক শব্দ শুনছেন এবং কার্যত বিশ্বের সমস্ত প্রধান ধরনের বাস্তুতন্ত্র থেকে শব্দ রেকর্ড করেছেন।
তিনি বলেন, “অতীতে যেসব প্রজাতির শব্দ রেকর্ড করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেক প্রজাতিই এখন আর নেই। আমাদের অনেকের কাছেই এমন সব প্রাকৃতিক আবাসস্থলের শব্দের রেকর্ডিংও আছে যেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানকার প্রজাতিগুলো কী ছিলো সেটাও আমরা জানি না। সেই অর্থে আমাদের কাছে থাকা ওই শব্দগুলো হলো শ্রুতিগত জীবাশ্ম।”
অসংখ্য গবেষণায় এখন উঠে আসছে, কীভাবে প্রাকৃতিক শব্দপুঞ্জগুলো বদলে যাচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে এবং নিস্তব্ধ হয়ে পড়ছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের ২ লাখ স্থান নিয়ে নেচার জার্নালে প্রকাশিত ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় গত ২৫ বছরে উভয় মহাদেশে শাব্দিক বৈচিত্র্য ও সাউন্ডস্কেপের তীব্রতা ব্যাপক হারে কমে গেছে।
গবেষকরা বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততার একটি মৌলিক পথ হলো প্রাকৃতিক শব্দ। অথচ তা দিনদিন কমে যাচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ওপরও এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাস্তুতন্ত্রের শব্দের পরিবর্তন বাতাসে, বনে, মাটিতে এমনকি পানির নিচেও ঘটছে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী পানির নিচে সোভিয়েত রাশিয়ার সাবমেরিনগুলোর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করত। তবে প্রবাল প্রাচীরের কাছাকাছি গেলে প্রবালের শব্দের কারণে তাদের ওই গতিবিধি পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম কঠিন হয়ে পড়ত।
২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাইড্রোফোন ব্যবহার করে প্রবাল প্রাচীর পর্যবেক্ষণ করছেন সিম্পসন। তিনি বলেন, “যখনই আমরা কোনও স্বাস্থ্যকর প্রাবাল প্রাচীরের কাছে যাই, সেটির বিচিত্র শব্দ শুনে আমরা বিস্মিত হই। একটি সুস্থ প্রবাল প্রাচীরে যেন শব্দের উৎসব চলে।”
কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে ১৯৫০ সাল থেকে শুরু করে এখন বিশ্বের অর্ধেকের বেশি প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করে তাহলে ৯৯ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে যাবে।
সিম্পসন বলেন, রাসায়নিক দূষণের ফলে মরে যাওয়া প্রবাল প্রাচীরগুলোতে এখন পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছে।
কানাডিয়ান সাউন্ড ইকোলজিস্ট হিলডেগার্ড ওয়েস্টারক্যাম্প বলেন, “এই শব্দ ও নীরবতা আমাদের সঙ্গে আয়নার মতো কথা বলে।” তিনি গত অর্ধ শতাব্দী ধরে সাউন্ডস্কেপ রেকর্ড করছেন। এই সময়ে পৃথিবীতে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা গড়ে প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে।
অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্র নথিভুক্ত করার অভিপ্রায়ে হিলডেগার্ড ১৯৭৩ সালে বিশ্ব শব্দপুঞ্জ (ওয়ার্ল্ড সাউন্ডস্কেপ) প্রকল্পে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, “আমরা শব্দপুঞ্জ শোনা শুরু করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, সবকিছুর শব্দ, তা যতই অস্বস্তিকর হোক না কেন- বার্তাটিও যতই অস্বস্তিকর হোক না কেন।”
তিনি বলেন, “শোনার কাজটি সান্ত্বনাদায়ক এবং অত্যন্ত অস্বস্তিকরও হতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটি আমাদের বাস্তবতার মুখোমুখি করে।”
সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এবং বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য নিরীক্ষণের উপায় হিসেবে এখন ভিজ্যুয়াল ডেটার পাশাপাশি শাব্দিক ডেটাও ব্যবহার করা হচ্ছে। আরও অত্যাধুনিক ও সস্তা রেকর্ডিং সরঞ্জামের সহজলভ্যতা এবং সেইসঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেগ বাড়ায় প্রাকৃতিক শব্দ পর্যবেক্ষণও ব্যাপক হারে বেড়েছে।
মাইক্রোফোনগুলো আরও উন্নত হওয়ায় বিজ্ঞানীরা সেগুলোকে এমন প্রাণের শব্দ পর্যবেক্ষণ করতে ব্যবহার করছেন যা সাধারণত মানুষের কানে শোনা যায় না। সুইজারল্যান্ডের অ্যাকোস্টিক ইকোলজিস্ট মার্কাস মেডার চাপের মুখে গাছ কেমন শব্দ তৈরি করে তা নিয়ে গবেষণা করছেন। এজন্য তিনি গাছের জীবন্ত টিস্যুর আওয়াজ শোনার জন্য গাছের বাকলের মধ্যে মাইক্রোফোন ঢুকিয়ে পরীক্ষা চালান। তিনি গাছের ভেতর নাড়ির স্পন্দনের মতো শব্দ শুনতে পান।
প্রথমবার একটি পাহাড়ি তৃণভূমির মাটিতে মাইক্রোফোন ঢুকিয়ে তিনি বিচিত্র শব্দ শুনতে পান, যেন সম্পূর্ণ নতুন এক শব্দের রাজ্য আবিষ্কার করেছেন।
অথচ কীটনাশক ব্যবহার করে চাষাবাদ করা কৃষি জমিতে প্রায় কোনও শব্দই শোনা যায় না। মেডার বলেন, “কীটনাশক ব্যবহারে মাটি মরা মানুষের মতো নীরব হয়ে যায়।”
অনেক গবেষকের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাওয়া শব্দপুঞ্জগুলো বৈজ্ঞানিক আগ্রহের পাশাপাশি দুঃখেরও কারণ। অধ্যাপক ব্রায়ান পিজানোস্কি বলেন, “এটি একটি দুঃখজনক কাজ, তবে এটি আমাকে প্রকৃতির হারানো সৌন্দর্য সম্পর্কে গল্প বলতেও সাহায্য করছে। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে প্রাণবৈচিত্র্য কী তা ব্যাখ্যা করতে আমার সমস্যা হয়। কিন্তু আমি যদি একটি রেকর্ডিং বাজাই এবং বলি যে আমি কী বলছি- এটি এই জায়গার কণ্ঠস্বর। আমরা তা সংরক্ষণের জন্য কাজ করতে পারি বা নাও পারি।”
তিনি বলেন, “মানুষের আবেগ উস্কে দেওয়ার জন্য শব্দ সবচেয়ে শক্তিশালী উদ্দীপক। শাব্দিক স্মৃতি খুব শক্তিশালী। আমি একজন বিজ্ঞানী হিসেবে এটি নিয়ে ভাবছি, কিন্তু ভাবতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হব না তা প্রায় অসম্ভব।”
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান