কত দ্রুতই না রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে গেল বাংলাদেশে! ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির আমি ও ডামি নির্বাচন করার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভেবেছিল বিরোধীরা ধরাশায়ী; ফলে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। কিন্তু প্রকৃতি ও সমাজে যেমন পরিবর্তন নিয়মিত ঘটে চলেছে তেমনি পরিবর্তন ঘটছে মানুষের চিন্তায় ও আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু সবসময় তা বুঝতে পারা যায় না। অনেকদিন ধরে ছোট ছোট পরিবর্তন যখন একটা বড় পরিবর্তনের সূচনা করে তখন তা সবার কাছেই অনুভূত হয়। তেমনি রাজনীতিতেও কখনও কখনও ভূমিকম্পের মতো ঘটনা ঘটে। আগে থেকে আঁচ করা যায় না কিন্তু দুলে উঠে ভূমি, ভেঙ্গে পড়ে দালান কোঠা। সাধারণ মানুষ আঁচ করতে না পারলেও ভূমিকম্প কিন্তু আকস্মিকভাবে ঘটে না। দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে চলে তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ভূমিকম্পে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ভূমির উপরের সবকিছু। সমাজে ও রাজনীতিতেও মাঝে মাঝে এমন কাঁপন লাগে। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠা আর আগ্নেয়গিরির লাভা উদগীরণের মতো মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে তছনছ হয়ে যায় ক্ষমতাসীনদের মসনদ, ক্ষুব্ধ মানুষের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভাংচুর ও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এমনই এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। গোটা বিশ্বের আন্দোলনকারী মানুষের জন্য এটা যেমন প্রেরণা তেমনি দেশে দেশে স্বৈরাচারী শাসকদের জন্যও একটা সতর্কবার্তা।
আন্দোলন ও মৃত্যুর মিছিলে শ্রমজীবীরা
কোনও আন্দোলন-সংগ্রামে এত মৃত্যু স্বাধীনতার পর কখনও দেখেনি বাংলাদেশের মানুষ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রায় শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। পরবর্তী সময়ে সহিংস কায়দায় আন্দোলন দমন করতে গেলে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। আন্দোলনের শেষদিকে মারাত্মক সহিংসতায় এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরের সহিংসতা মিলিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে এক হাজারের মতো মানুষ। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৩৪১ জন এবং ৪ আগস্ট থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছে ৪১৬ জন। এর মধ্যে ঢাকায় মৃত্যু হয়েছে ৩৭২ জনের এবং ঢাকার বাইরে মৃত্যুবরণ করেছে ৩৮৫ জন। নিহতদের মধ্যে শিক্ষার্থী ৯১ জন, নারী ও শিশু ৯৩ জন। বাকিদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা কর্মী ছাড়া প্রায় সবাই শ্রমজীবী মানুষ। শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই শ্রমজীবী শিশু বা শিশু শ্রমিক।
শ্রমজীবীদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছে তারা প্রায় সবাই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। হকার, দোকান কর্মচারী, পরিবহন শ্রমিক, রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, গার্মেন্টসশ্রমিকসহ দরিদ্র শ্রমজীবীরাই জীবন দিয়েছেন। আহত হয়েছেন তারাই বেশি। আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্ররা কিন্তু দলে দলে দরিদ্র শ্রমিকরা এই আন্দোলনে অংশ নিল কেন, তার কারণ খুঁজতে হবে শ্রমজীবীদের অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে।
জনপ্রিয় থেকে জনরোষের মুখোমুখি সরকার
২০০৮ সালে এক ভূমিধ্বস বিজয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ আর ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলো আওয়ামী সরকারের প্রধান। এই সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন, নানা চোখ ধাঁধানো মেগা প্রকল্প সত্ত্বেও শ্রমজীবীদের বঞ্চনা চাপা দেওয়া যায় নি। বরং তা প্রকট হয়েছে দিনে দিনে। দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি আর স্বল্প-মজুরি শ্রমজীবীদের জীবনে নাভিশ্বাস এনে দিয়েছে। বৈষম্য মাপার সূচক ‘গিনি সহগ’, ‘পালমা মেথড’ সব বিচারেই বৈষম্য চরমে উঠেছে। আর ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের মুখে দেশ ইউরোপ হয়ে যাওয়া, শ্রমিকরা আগের চেয়ে ভালো আছে এসব কথা শুনে সংসার চালাতে হাঁসফাঁস করা শ্রমজীবীরা ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠেছে। এর সঙ্গে দেখেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের বিপুল সম্পদ ও বিলাসী জীবন। বেকার সমস্যার তীব্রতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ শ্রমিকদেরকে বেপরোয়া জীবনের দিকেও ঠেলে দিয়েছে। ফলে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমেছে, পুলিশের সঙ্গে মারামারি করতে, এমনকি অংশ নিয়েছে ভাংচুরেও। ছাত্রদের সঙ্গে শ্রমজীবীদের এই বিপুল অংশগ্রহণে সরকারের পতন শুধু নয়, সরকারপ্রধানের দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ারও অন্যতম কারণ।
কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন
বাংলাদেশ মূলত আন্দোলন সংগ্রামের দেশ। এবারের অভূতপূর্ব ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের আগে আরও দুটি ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল এদেশে। ১৯৬৯ এর ছাত্র-অভ্যুত্থান এবং ১৯৯০ এর ছাত্র-অভ্যুত্থান। এছাড়াও ১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালত এবং ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের মতো বিপুল ছাত্র-তরুণ-জনতার অংশগ্রহণমূলক আন্দোলন হয়েছিল। তবে, আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। সেই অনুপ্রেরণা থেকেই পরবর্তী আন্দোলনগুলোরও সূচনা। এই যে লক্ষ কোটি মানুষের অংশগ্রহণে গড়া এসব আন্দোলন তার প্রভাব সমাজে থেকে হারিয়ে যায় না। বারবার সংকটে পড়লে দেশের মানুষ এসব আন্দোলন থেকে প্রেরণা নেয়, শক্তি পায়।
এবারের আন্দোলন এত তীব্র হওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের অত্যাচার, অহমিকা ও সাধারণ মানুষকে অপমান করার বিরুদ্ধে ক্ষোভ যেমন কাজ করেছে, অতীত আন্দোলনের শিক্ষাও তেমনি ভূমিকা পালন করেছে। অতীতের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খান ১০ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারে নাই, এরশাদ ৯ বছরের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে আর ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগও ১০ বছরের বেশি থাকতে পারেনি। গণআন্দোলনের চাপে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।
ছাত্রদের কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলতে চলতেই সেটাকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর তা সাধারণ মানুষকেও আলোড়িত করেছে। দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য ও দমনপীড়ন বিরোধী মনোভাব ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছে বলেই সেটা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল।
বৈষম্যের বেদনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা
অসংগঠিত শ্রমজীবীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এই আন্দোলনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। একদিকে নিজেদের জীবনের বঞ্চনা অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনের উপর নির্মম আক্রমণ শ্রমিকদেরকে প্রভাবিত করেছে। অসংগঠিত শ্রমিকদের জীবনে প্রতিদিনের পুলিশি হয়রানি, ক্ষমতাসীন দলের চাঁদাবাজি, বস্তিতে নির্যাতন নিপীড়ন তাদের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে কিন্তু তারা প্রতিকারের পথ পায়নি। ২০২৩ সালে মজুরি আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ৪ জন শ্রমিক জীবন দিয়েও তাদের প্রত্যাশিত মজুরি পায়নি। বরং হাজার হাজার শ্রমিকের নামে মামলা হয়েছে, শত শত শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে, আহত হয়েছে অনেক। কিন্তু এবারের ছাত্র আন্দোলন তাদেরকে রাস্তায় নেমে ক্ষোভ প্রকাশের পথ করে দিয়েছে। শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমেছে, গুলি খেয়েছে, মরেছে, আহত হয়েছে এবং ক্ষোভের আগুনে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিয়েছে অনেক স্থাপনা। ছাত্রদের সমর্থনে শ্রমিকরা কেন পথে নেমে এলো এই বিষয়টি উপেক্ষা করলে আন্দোলনের সাফল্য নিয়ে অনেক আলোচনা সত্ত্বেও সমাজে বৈষম্য থেকেই যাবে।
এই আন্দোলনে রিকশা চালক, সিএনজি চালক, টেম্পো শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, রাস্তায় পণ্য বিক্রেতা, হকাররাই বেশি অংশ নিয়েছিল কারণ সরকার তাদের চাকরি দেয় নাই, তারা নিজেরা নিজেদের কাজ খুঁজে নিয়েছে কিন্তু এরপরও পুলিশ ও সরকারি দলের চাঁদাবাজরা তাদের কষ্টের রোজগারে ভাগ বসাত। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৩৬ লাখের বেশি। এই শ্রমজীবীদের ৮৫ শতাংশের বেশি অসংগঠিত খাতের শ্রমিক। যাদের চাকরি বা কাজের কোনও নিশ্চয়তা নাই, মাসিক মজুরি নাই, তারা জীবনের কোনও ভবিষ্যৎ দেখেনা, কাজ নাই তো মজুরি নাই বা হাত না চললে ভাত জোটেনা এমন অবস্থা।
আর একটা জরিপে দেখা যায় দেশে ৪ শতাধিক ধরনের কাজ আছে। কাগজ কুড়ানো থেকে প্লেন চালানো পর্যন্ত সমস্ত কাজেই নিয়োজিত আছে শ্রমশক্তি। সমাজে প্রয়োজন আছে কিন্তু সব শ্রমের আইনি স্বীকৃতি নাই। দুই একটা দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। দেশে গৃহকর্মী আছে, সংখ্যাটা ২০ লাখেরও বেশি কিন্তু গৃহকর্মীদের শ্রম আইনে স্বীকৃতি নাই, ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনগত অধিকার নাই। তেমনি ১৫ লাখের বেশি প্রাইভেট গাড়ি চালক আছে, বিআরটিএ থেকে তাদেরকে পরীক্ষা নেওয়ার পর হালকা যানবাহন এর চালক হিসেবে লাইসেন্স দেয়া হয়। তারা কাজ করছে কিন্তু শ্রম আইনে তাদের স্বীকৃতি নাই।
বিবিএস-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে দেশে ৩৫ লাখের বেশি শিশু শ্রমে নিয়োজিত। এরা তো সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দেশের অর্থনীতিতে তাদের শ্রমের ভূমিকা আছে কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল তাদের জীবনে নেই। নারী শ্রমিক দেশের সর্বত্র। মাটি কাটা, ইট ভাঙ্গা, নির্মাণ শ্রমিকের মতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করছে নারীরা। কিন্তু মজুরি বৈষম্যের শিকার তারা পদে পদে। এই ধরনের নানা বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রতিকার শ্রমিকরা পাবে এটাই তো ছিল প্রত্যাশা। এবারের গণঅভ্যুত্থানের ফলে যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেখানে শ্রমিকদের ঠাঁই থাকবে তো?
গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, ন্যায্য মজুরি
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ তৈরি করা হয়েছিল ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে প্রণীত ২৫ টি আইনের সমন্বয়ে। বলা হয়েছে এই শ্রম আইন সমগ্র বাংলাদেশেই প্রযোজ্য হবে। কিন্তু ইপিজেড ও স্পেশাল ইকনোমিক জোনে এই আইন কার্যকর নয়। বলা হয়েছে সকল শ্রমিক এই আইনের আওতায় আসবে কিন্তু আইনের প্রথমেই বলে দেওয়া হয়েছে কোন কোন শ্রমিক শ্রম আইনের সুরক্ষা পাবে না। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গৃহকর্মী, হালকা যানবাহনের চালক। শ্রম আইনে আছে নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র ছাড়া কাজে নিয়োগ করা যাবে না। কিন্তু ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক নিয়োগপত্র পাচ্ছে না যুগের পর যুগ। মালিকদের ‘লে অফ’ করার অধিকার আছে, ছাঁটাই করার অধিকার আছে, অসদাচরণের অভিযোগ তুলে চাকরি থেকে ছাঁটাই এবং পাওনা থেকে বঞ্চিত করার পথ খোলা রাখা আছে, কর্মঘণ্টা বাড়ানোর সুযোগ রেখে অতিরিক্ত সময় খাটানোর সুযোগ রাখা আছে কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার পদে পদে সংকুচিত করা হয়েছে এই আইনে।
ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংস্থা। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন প্রক্রিয়া একদিকে জটিল অন্যদিকে ট্রেড ইউনিয়ন রক্ষা করাও কঠিন করে তোলা হয়েছে। দেশের ৭ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৩২ লাখ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য। এ থেকে বোঝা যায় ট্রেড ইউনিয়ন করা এবং টিকিয়ে রাখা কতটা কঠিন। শ্রমিকদের জীবনে সংকট আছে কিন্তু সংগঠিত হওয়ার অধিকার ও আন্দোলনের সংস্থা সংখ্যায় কম ও শক্তিতে দুর্বল। ফলে মজুরি ও অধিকারের প্রশ্নে দরকষাকষি করার ক্ষমতাও কম। তাই আন্দোলন কারখানায় না করে রাস্তায় নেমে আসে শ্রমিকেরা। দ্রব্যমূল্য, বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ পানির দাম, বাস ভাড়া দফায় দফায় বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের জন্য ৫ বছর পর মজুরি বোর্ড গঠনের আইন করা হয়েছে। ফলে বাজার দর, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি কখনই তাল মেলাতে পারে না। প্রকৃত অর্থে শ্রমিকেরা মজুরি হারায়। ফলে রেশন দরে খাদ্য সামগ্রী প্রদান, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে জাতীয় ন্যুনতম মজুরি বোর্ড গঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন করার দাবি গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ ও পেনশন এবং প্রবাসী শ্রমিক
জীবিকা অর্জন করতে এসে জীবন হারানোর অনেক বেদনাময় ঘটনা বাংলাদেশে আছে। রানা প্লাজা, তাজরিন, টাম্পাকো, বিএম কন্টেইনার, সেজান জুস এই নামগুলো খুবই পরিচিত। এই পরিচিতি কিন্তু উৎপাদনের জন্য নয় বরং শ্রমিক নিহত হওয়ার জন্য। এর আগে স্পেকট্রাম, কেডিএস সহ অনেক কারখানার নাম উল্লেখ করা যাবে যেখানে আগুনে পুড়ে, ভবন ধ্বসে শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে। এসব মৃত্যুকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলা হলেও দায়ীদের শাস্তি হয়নি। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ মাত্র ২ লাখ টাকা। আহত হয়ে চিরস্থায়ী পঙ্গু হলে ক্ষতিপূরণ আড়াই লাখ টাকা। ফলে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের মানদণ্ড তৈরি এবং আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবি করেছে শ্রমিকেরা। যৌবনে শ্রম দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে অসহায় হয়ে পড়া শ্রমিকদের জন্য পেনশনের দাবি বিবেচনায় নিতে হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে উঠে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স দ্বারা। কিন্তু সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যেতে বাধ্য হয় তারা। বিদেশে হয়রানি ও দেশে বিড়ম্বনা তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। এটা নিরসনে ব্যবস্থা নিলে একদিকে বিদেশ যাওয়ার খরচ জোগাড়ের জন্য জায়গা জমি বিক্রি অথবা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে বিদেশ যাওয়ার হাত থেকে শ্রমিকরা রেহাই পাবে এবং রেমিটেন্সের পরিমাণও বাড়বে।
শ্রমিকরা যেন বঞ্চিত না হয়, তাদের দাবি যেন গুরুত্ব পায়
দেশের অর্থনীতির বিকাশ ও বৈষম্য কমানোর লক্ষেই শ্রমিকদের দাবি পূরণের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আইনে বৈষম্য, মজুরিতে বৈষম্য, নারী পুরুষ শ্রমিকের বৈষম্য, অধিকারে বৈষম্য শ্রমিকদের জীবনে প্রভাব ফেলে। তারা খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এর প্রভাব পড়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপরেও। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জিডিপি বৃদ্ধি, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, রেমিটেন্স বৃদ্ধির খবরের পাশাপাশি শ্রমিকের জীবনমান বৃদ্ধির খবর যেন আসে, অতীতের মতো উন্নয়নের ডামাডোলে শ্রমিকের কান্না যেন চাপা না পড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে সবার। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের যে আলোচনা চলছে তার সুফল যেন শ্রমিকদের জীবনেও আসে।
লেখক: শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাসদ।
ইমেইল: [email protected]