সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ তার পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের আলোকে অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করা হয়েছে।
সোমবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান।
রিট আবেদনে বেনজীরসহ তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি অনুসন্ধানের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে বেনজীরের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদকের নিষ্ক্রীয়তাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না—তা জানতে চেয়ে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে।
রিট আবেদনে দুদকের চেয়ারম্যান, কমিশনার (তদন্ত), কমিশনার (অনুসন্ধান) ও সচিবকে বিবাদী করা হয়েছে।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল প্রথমে রিট আবেদনকারী আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান দুদকে চিঠি পাঠান। এরপর গত ১৮ এপ্রিল তিনি আইনি নোটিশ পাঠান। তারপরও দুদক কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করা হয়েছে বলে জানান রিগ্যান।
রিট আবেদনকারী এ আইনজীবী বলেন, গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল দৈনিক কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় বেনজীর আহমেদের সম্পদ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। এসব সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের পরও দুদক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, তারা এখানে নির্বিকার।
গত ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় বিশেষ প্রতিবেদন ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’। কয়েকটি প্রতিবেদনে বিভিন্ন স্থানে ‘অবৈধ সম্পদের’ বিবরণ তুলে ধরা হয়। গোপালগঞ্জে তার রিসোর্টের কথাও বলা হয়। গাজীপুরে বনভূমি দখলের অভিযোগও করা হয়। তার চাকরি জীবনের আয়ের সঙ্গে এই সম্পদের মালিক হওয়া অসঙ্গতিপূর্ণ বলেও দাবি করা হয়।
বসুন্ধরা গ্রুপের আরও দুটি সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশ প্রতিদিন ও বাংলানিউজেও একই শিরোনামে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়।
রিগ্যান বলেন, স্বেচ্ছায় তদন্ত বা অনুসন্ধানের ক্ষমতা দুদকের রয়েছে, তা সত্ত্বেও কমিশন নীরব।
তিনি বলেন, “আমাদের বক্তব্য হলো বেনজীর আহমেদ দুর্নীতি করে সম্পদ অর্জন করেছেন বা করেননি। আমাদের কথা হলো এসবের তদন্ত হওয়া উচিত। মানুষ জানুক যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, তা সঠিক না বেঠিক। এজন্য দুদকে চিঠি দেই।
“এরপর আইনি নোটিশ পাঠাই। তাতেও কোনও জবাব না পাওয়ায় আমরা বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করি।”
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী এবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য তা উপস্থাপন করা হবে বলে জানান রিগ্যান।
‘অবৈধ সম্পদের পাহাড়’ গড়ার সংবাদ নিয়ে কয়েক সপ্তাহ পর শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) রাতে বেনজীর আহমেদ ঘোষণা দেন শনিবার (২০ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি লাইভে আসছেন। তখনই ধারণা করা যাচ্ছিল, তাকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ ও সমালোচনার জবাব দিতেই তিনি এ উদ্যোগ নিচ্ছেন।
শনিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পাতায় ‘আমার কিছু কথা’শিরোনামে এক ভিডিও বার্তা নিয়ে হাজির হন বেনজীর। সেখানে তিনি তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জবাব দেন। তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। একইসঙ্গে বলেন, তার সম্পদ অবৈধ বলে কেউ প্রমাণ করতে পারলে তা দান করে দেবেন তিনি।
গোপালগঞ্জের সন্তান বেনজীর দুই বছর আইজিপির দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালে অবসর নেন। আইজিপির দায়িত্ব পালনের আগে তিনি র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তারও আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ছিলেন।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় র্যাবের যে সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার নাম আসে, তার মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।
সম্প্রতি বেনজীরের নামটি আবার আলোচনায় উঠে আসে বসুন্ধরা গ্রুপের সংবাদপত্রগুলোতে একযোগে প্রতিবেদন প্রকাশের পর।
শনিবার আধাঘণ্টার ফেইসবুক লাইভে বেনজীর বলেন, চাকরিকালে গত ২০১২ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি সোশাল মিডিয়ায় একটি গোষ্ঠী কর্তৃক অবিরত এবং ক্রমাগত ‘অপপ্রচার এবং ব্যক্তিগত চরিত্রহননের অপচেষ্টার’ শিকার হয়েছিলেন। অবসরকালে তিনি যখন নিরিবিলি জীবন কাটাচ্ছিলেন, তখন আবার একই রকম ‘অপপ্রচারের’ শিকার হলেন।
বেনজীর দাবি করেন, তার ও তার পরিবারের যে সম্পত্তি আছে, তার প্রতিটির বিপরীতে অর্থের উৎসসহ সংশ্লিষ্ট ট্যাক্স ফাইলে যথাযথভাবে উল্লেখ করা আছে। তিনি ও তার পরিবার নিয়মিতভাবে কর পরিশোধ করে সেরা করদাতার সম্মাননাও পেয়েছেন।
ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ‘প্রকৃত সত্য এবং তথ্য’ তুলে ধরার একটি নৈতিক তাগিদ থেকে শনিবার লাইভে আসা বলে জানান সরকারি চাকরিতে শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই কর্মকর্তা।
প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে বেনজীর নীরবতা ভাঙার একদিন পরই রবিবার (২১ এপ্রিল) সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য দুদকে আবেদন করেন।
দুদক চেয়ারম্যান বরাবর এ আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট ও মাধবপুর) আসনের এই সংসদ সদস্য।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ব্যারিস্টার সুমন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তখনকার বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে বড় ব্যবধানে হারান।
সোশাল মিডিয়ার আলোচিত মুখ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের এ সহযোগী সংগঠন থেকে ২০২১ সালে বহিষ্কার করা হয় তাকে। তবে নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী বলেই বলে আসছেন ব্যারিস্টার সুমন।