বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ১৩তম সম্মেলন বসছে আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল হিসেবে উত্তরণের প্রস্তুতিতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের জন্য এই সম্মেলনটি গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্মেলনে সব দেনদরবার ভবিষ্যৎ উন্নয়নশীল দেশের আগ্রহের জায়গাগুলো খেয়াল রেখে করতে হবে, তবে উত্তরণের মেয়াদ বাড়ানো উচিত হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কাটবে সে মোতাবেক পয়েন্ট নির্ধারণ করতে হবে। আগে করতে হবে পরিকল্পনা। সরকারকে বুঝতে হবে, এগুলো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, রাজনীতির ময়দানে তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নেন সেভাবে নিলে তো হবে না। এখানে অনেক বেশি অন্তর্ভূক্তিমূলক হতে হবে।
আগামী ২৬-২৯ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত আরব আমিরতের রাজধানী আবু ধাবিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া মন্ত্রী পর্যায়ের এ সম্মেলনে ডব্লিউটিওর সদস্য ১৬৪টি দেশের বাণিজ্যমন্ত্রীরা অংশ নেবেন। এই সম্মেলনে যোগ দিতে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছাড়বেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু।
ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা— সব মিলিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে এ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ। এটি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তার কারণ, স্বল্পোন্নত দেশ পরিচয়ে এটিই বাংলাদেশের শেষ সভা হতে পারে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মের শতবর্ষ উদযাপনের ২০২১ সালে বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণে জাতিসংঘের অনুমোদন। কোভিড-১৯ অতিমারীর মধ্যেও এই অর্জন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নে এনে দেয় এক নতুনমাত্রা। সেই ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হবে। তবে টানা চতুর্থবার সরকারে আসা আওয়ামী লীগ চাইছে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের মেয়াদ বাড়াতে।
ডব্লিউটিওর এমসি১৩ সম্মেলনে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার কার্যকারিতা পর্যালোচনা এবং সংস্থাটির ভবিষ্যত কাজের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৬ সালের নভেম্বরে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর আরও তিন বছর বাণিজ্য-সুবিধা অব্যাহত রাখার দাবি বাস্তবায়নে ডব্লিউটিওর সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের কৌশল প্রণয়ন করা উচিত। কিন্তু তাই বলে উত্তোরণের মেয়াদ বাড়ানো উচিত হবে না। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনার সুযোগও নিতে হবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল হিসেবে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি হিসেবে সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সকল দেন-দরবারে ভবিষ্যৎ উন্নয়নশীল দেশের আগ্রহের জায়গাগুলো খেয়াল রেখে করতে হবে।”
বাণিজ্য সুবিধা সম্প্রসারণের দাবি বাস্তবায়নে সরকারের প্রস্তুতির প্রসঙ্গ টেনে অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর বলেন, “এক্সপানশনের (বর্ধিতকরণ) সুযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশ চাইলে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেও তা হতে পারে।”
এলডিসি থেকে উত্তোরণ ২০২৬ সালেই করতে হবে, এটা পেছানো খারাপ হবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উচিত সংস্কারগুলো দ্রুত আনা এবং গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিত, কারণ দেশটি ইতিমধ্যে তিনটি পূর্বশর্ত পূরণ করেছে।
তবে বাংলাদেশকে ভারতের মতো কৌশলী অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারত একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যেও অবস্থিত কারখানাগুলোর জন্য ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে গত কয়েক বছর আওয়াজ তুলে যাচ্ছে। ভারত সবুজ কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখার জন্য ও সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং ই-কমার্সের উপর স্থগিতাদেশের জন্য কাজ করছে কয়েক বছর ধরে।”
বাংলাদেশের স্বার্থ চিন্তা করে এরকম অন্য দেশের সঙ্গে একত্রিত হয়ে দেন-দরবার করা উচিত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
বাংলাদেশের বাণিজ্যের বড় অংশ জুড়েই রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প খাত। এ খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসানও স্বীকার করেন এবারের সভা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, “অনেক ধরনের ক্রাইসিসের মধ্যে আমরা বেশ কিছু বছর ধরে আছি। কোভিড মহামারীর রেশ শেষ হতে না হতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং এখনের লোহিত সাগরের অবস্থা মিলিয়ে একের পর এক ধাক্কা আসছে বাণিজ্যে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর ইন্টারেস্ট রেট অনেক বেশি। ফলে রপ্তানিকারকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং সময় যাচ্ছে।”
এসব বিষয় মাথায় রেখেই দেন-দরবার করতে হবে জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “আমাদের নিজেদের সুবিধাগুলোর দিকে তাকাতে হবে। এলডিসি উত্তোরণের সময় ২০২৬ পর্যন্ত, এরপরও বাণিজ্য সুবিধাগুলো আমরা কীভাবে পেতে পারি তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আমরা এলডিসি উত্তরণের সকল শর্ত পূরণ করেছি। ফলে আমাদের তো পুরস্কার পাওয়া উচিত।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পাবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। ইইউর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এলডিসি থেকে সদ্য উত্তরণ পাওয়া দেশগুলোকে তারা আরও ৩ বছর বাণিজ্য সুবিধা দেবে তারা।
এ প্রসঙ্গে ফারুক হাসান বলেন, “ইইউর সুবিধাটা আরও কয়েকবছর বাড়ানো যায় কি না, তা আমাদের দেখতে হবে। একই সাথে আমাদের নতুন বাজারগুলোকে লক্ষ্য করে সেসব দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করা যায় কি না, সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।”
এলডিসি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ প্রস্তুতিতে পিছিয়ে
ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন সামনে রেখে গত ৯ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভা আয়োজন করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি স্বীকার করে নেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রস্তুতিতে বেশ কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। তবে তিনি বলেন, এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের প্রশ্নে সরকার পিছু হটবে না, সামনের দিকেই হাঁটবে। উত্তরণের মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগে থেকে প্রস্তুতি দরকার ছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রস্তুতি নিতে দেরি হয়েছে বলেই এবারের সম্মেলনটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, “পিছিয়ে আছি বলে পিছিয়ে থাকব, তাতো না। আমাদের ডাবল মার্চ করতে হবে। আমরা যদি সময় মতো প্রস্তুতি শেষ করতে না পারি, তাহলে তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অপমানকর।”
প্রস্তুতিতে কিছুটা পিছিয়ে থাকার কারণেই এবারের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে বাংলাদেশের জোরাল অবস্থান আশা করেন আইএমএফের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, “পিছিয়েই আছি বলেই, আমাদের ফিউচারের জন্য এবারের ট্রেড মিটিংয়ে বেশ কিছু জিনিস আমাদের পক্ষে নিতে হবে। আমাদের দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তা করে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কাটবে সে মোতাবেক পয়েন্ট নির্ধারণ করতে হবে।”
তবে এক্ষেত্রে আগে সরকারের নিজস্ব পরিকল্পনা জরুরি, সব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে বসেই পথনকশা তৈরির বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
মনসুর বলেন, “পরিকল্পনা তো ঠিকঠাক হতে হবে। সরকারকে প্রথম বুঝতে হবে, এগুলো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, রাজনীতির ময়দানে তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নেন, সেভাবে নিলে তো হবে না। এখানে অনেক বেশি অন্তর্ভূক্তিমূলক হতে হবে। সবাইকে সাথে নিতে হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে।”
“শিল্পে উদ্ভাবনশীলতা আমাদের বাড়াতে হবে, নতুনত্ব আনতে হবে, টেকসই করতে হবে, পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে। এসবকে মূল লক্ষ্য রেখে পরিকল্পনা সাজাতে হবে” যোগ করেন তিনি।
শেষ সম্মেলনে খালি হাতে ফিরেছিল বাংলাদেশ
এক প্রকার নিষ্ফল আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছিল ২০২২ সালের ডব্লিউটিও এমসি১২ সম্মেলন। যেখানে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো ঘরে ফিরছে অনেকটা শূন্য হাতেই। যদিও সম্মেলনের সময় বাড়িয়ে সদস্যদের ক্ষোভ সামাল দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টাও ছিল সেবার।
বড় কোনও ঘোষণা কিংবা সিদ্ধান্ত ছাড়াই জেনেভায় পর্দা নামে সম্মেলনের। পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে দুদিন সম্মেলনের সংবাদ সম্মেলন কয়েক দফা পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত বাতিলই করে ডব্লিউটিও। এতে চরম হতাশ হয় স্বল্পোন্নত দেশগুলো। বিশেষ কোনও গোষ্ঠীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই ওই সম্মেলন চলেছিল বলে অভিযোগ করে অংশ নেওয়া দেশগুলোর প্রতিনিধিরা।
তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জেনেভা থেকে ফেরত এসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “প্রত্যেকে তাদের স্বার্থ দেখে বা বোঝে। আমাদের কথা হলো, সবার স্বার্থ তো থাকবেই, কিন্তু যারা দায়িত্বে আছে, তাদের কাজ এটি টিকিয়ে রাখা।’