Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

ইউটিউবের ‘রাজা’র গায়ে মামলার কালি

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইউটিউবার মিস্টার বিস্ট। ছবি: বিবিসি।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইউটিউবার মিস্টার বিস্ট। ছবি: বিবিসি।
[publishpress_authors_box]

প্রায় ৩২ কোটি ভক্ত, বহু-মিলিয়ন ডলারের ব্যক্তিগত ভাগ্য এবং বিশ্বব্যাপী একটি বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য।

তিনি ইউটিউবের সবচেয়ে বড় ইনফ্লুয়েন্সার। নাম জিমি ডোনাল্ডসন, তবে সবাই চেনে মিস্টার বিস্ট নামে।

অন্তর্জালের সিংহাসন থেকে তাকে চ্যুত করতে চাইলে অনেক কিছু লাগবে। তবে আদালতের ৫৪ পৃষ্ঠার একটি নথি এখন পর্যন্ত তাকে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিতে পারে।

আসন্ন প্রাইম ভিডিও শো বিস্ট গেমসের পাঁচজন নারী প্রতিযোগী যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসে তার প্রযোজনা সংস্থা এমআরবি২০২৪ এবং অ্যামাজনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করছে।

বিস্ট গেমসে অংশগ্রহণ করার জন্য নাম লিখিয়েছেন ১ হাজার প্রতিযোগী, যা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় রিয়েলিটি প্রতিযোগিতা সিরিজ হিসেবে রেকর্ড করতে চলেছে।

এই প্রতিযোগিতার বিজয়ীকে দেওয়া হবে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার। কিন্তু মামলার কারণে ভিডিও শোটি সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে।

মামলায় পাঁচ নারী অভিযোগ করেন, তারা সম্মিলিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এমন একটি পরিবেশে, যা পরিকল্পিতভাবে দুর্ব্যবহার এবং লিঙ্গবৈষম্যমূলক সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করে।

এই অভিযোগ অন্তর্জালে ‘সবচেয়ে ভালো’ ছেলেদের একজন হিসেবে মিস্টার বিস্টের যে খ্যাতি আছে, তার ওপর একটি বড় আঘাত।

৫৪ পৃষ্ঠার ওই নথিতে এমন অভিযোগও রয়েছে, মিস্টার বিস্টের শোগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের প্রায়ই ঠিকমতো খাবার খেতে দেওয়া হতো না এবং তারা অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়তেন।

এতে আরও দাবি করা হয় যে, খাবার বিক্ষিপ্তভাবে এবং অল্প পরিমাণে সরবরাহ করা হতো, যা প্রতিযোগীদের স্বাস্থ্য বিপন্ন করে তোলে।

একটি সেকশনে অভিযোগ করা হয়, আসামিরা প্রতিকূল কাজের পরিবেশসহ যৌন হয়রানির একটি সংস্কৃতি ও কাঠামো তৈরি করে তা বজায় রেখেছে এবং লালন করেছে।

আগস্টে নিউ ইয়র্ক টাইমস ভিডিও শোটির এক ডজনেরও বেশি (এখনও অপ্রকাশিত) অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে কথা বলেছিল। তারা জানতে পারে যে প্রতিযোগিতার সেট থেকেই অনেককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল।

এক প্রতিযোগী অভিযোগ করেন, কখনও কখনও তাদের কোনও খাবার ছাড়াই ২০ ঘণ্টার বেশি সময় পার করতে হয়েছে। সময়মতো ওষুধও তাদের দেওয়া হয়নি।

মিস্টার বিস্ট ও অ্যামাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বিবিসি, কিন্তু তারা এখনও কোনও মন্তব্য করেননি।

প্রশ্ন হল, এই অভিযোগ কি ইউটিউবের জনপ্রিয়তার রাজার বড় ধরনের ক্ষতি করবে?

ক্রমবর্ধমান খ্যাতি এবং দাতব্য কাজ

মিস্টার বিস্টকে নিয়ে বিতর্ক এবারই প্রথম নয়। তবে প্রতিবারই তিনি অবাধেই সব বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।

জুলাইয়ে ২৬ বছর বয়সী এই আমেরিকান বলেছিলেন, তার সাবেক কো-হোস্ট আভা ক্রিস টাইসন এক কিশোরীর সঙ্গে সম্পর্কের জড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরে তিনি তদন্তকারী নিয়োগ করেছিলেন।

আভা অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন তখন। তবে অতীতের আচরণের জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলেন।

তবে মিস্টার বিস্ট অভিযোগটিকে গুরুতর আখ্যায়িত করে এতে তার বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।

এর পরে তার ব্যবসায়িক অনুশীলন নিয়েও আরও কিছু অভিযোগ একটি বেনামী ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়। সেই অভিযোগকারী নিজেকে মিস্টার বিস্টের একজন সাবেক কর্মচারী বলে দাবি করেন।

বিবিসি স্বাধীনভাবে দাবিটি বা সেই ব্যক্তির পরিচয় যাচাই করতে পারেনি।

মিস্টার বিস্টের কিছু জনহিতকর কর্মকাণ্ড, যেমন- আফ্রিকায় কূপ নির্মাণ এবং অন্ধ ও বধির লোকদের অপারেশনের জন্য অর্থ দানসহ কিছু কাজ ঘিরে সমালোচনারও জন্ম হয়েছে।

এক ব্যক্তি গত বছর দ্য ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, “আমার মতো বধির লোকেরা মিস্টার বিস্টের সর্বশেষ অনুপ্রেরণা পর্নের চেয়ে ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য।”

তারপরও তার সাম্রাজ্য বড় হতে থাকে। গত বুধবার এই মামলার আগের দিন তিনি তার মতোই বিখ্যাত মুখ কেএসআই ও লোগান পলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের কথা প্রকাশ করেন। লাঞ্চেবলকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য ডিজাইন করা একটি নতুন ফুড লাইন আনার ঘোষণা দেন তারা।

গত বছর তার এই উল্কার গতিতে উত্থান নিয়ে বিবিসিতে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই তিনি কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন।

তার ভিডিওগুলো তৈরিতে বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিওটি ৬৫ কোটি ২০ লাখ বার দেখা হয়েছে। এতে তিনি নেটফ্লিক্সের হিট স্কুইড গেমটি বাস্তব জীবনে পুনরায় তৈরি করেন। এতে বিজয়ীকে ৪ লাখ ৫৬ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হয়।

তার বেশিরভাগ জনহিতৈষী কর্মকাণ্ড কম বিতর্কিত। যেমন- বাড়ি, গাড়ি ও অর্থ দান। এসব দাতব্য কাজ তাকে ইন্টারনেটের ভালো মানুষদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়।

তার ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তিনি বিশ্বজুড়ে অভাবি মানুষদের ২ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি বেলার খাবার দিয়েছেন।

মানুষ ক্রমাগত তার সোশ্যাল চ্যানেলে ভিড় করতে থাকে। গত জুনেই তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইবার সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ চ্যানেল হয়।

পরিসংখ্যান-পরীক্ষক সোশ্যালব্লেড এর হিসাব অনুযায়ী, মিস্টার বিস্ট শুধু গত ৩০ দিনে নতুন ৫০ লাখ গ্রাহক পেয়েছেন।

এটি কেবল একটি পরিসংখ্যান। কারণ, কত লোক তার চ্যানেল থেকে চলে গেছে, তা জানা যাচ্ছে না। তবে এটা নিশ্চিত যে প্রতিনিয়ত যত মানুষ তার ভিডিও দেখা বন্ধ করে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ নতুন করে তার ভিডিও দেখা শুরু করে। ফলে তার ইউটিউব চ্যানেলের গ্রাহক সংখ্যা না কমে বরং বেড়েই চলেছে।

ইউটিউবে ক্ষমা প্রার্থনা

মিস্টার বিস্টই একমাত্র ইউটিউবার নন, যিনি বিতর্কের মধ্য দিয়েও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। অনেকে তার চেয়ে অনেক বেশি উল্লেখযোগ্য ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের কয়েকজন জনসাধারণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়াও বিভিন্ন পরিণতির মুখোমুখি হয়েছেন।

২০১৮ সালে লোগান পল একটি ভিডিও আপলোড করার পরে তার গ্রাহকদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হন। সেসময় তার গ্রাহক ছিল প্রায় দেড় কোটি। ভিডিওটিতে একজন আত্মহত্যাকারীর মরদেহ দেখানো হয়।

গ্রাহকদের ক্ষোভের কারণে তিনি ভিডিওটি মুছে দিতে বাধ্য হন। এরপর ক্ষমা চেয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করেন।

বর্তমানে তার গ্রাহক ২ কোটি ৩০ লাখ। তিনি অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় একটি স্পোর্টস ড্রিঙ্কের মালিক। আগস্ট পর্যন্ত তিনি ডব্লিউডব্লিউই-র যুক্তরাষ্ট্রের চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি পে-পার-ভিউ বক্সিং বাউটও করেছেন।

পিউডিপি, জেমস চার্লস ও জেফ্রি স্টারসহ আরও কিছু জনপ্রিয় ইউটিউবারও বিভিন্ন বিতর্কের মুখে পড়েন এবং ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন।

সাম্প্রতিকতম একটি উদাহরণ হলো হার্শেল ‘গাই’ বিহম যিনি অনলাইনে ড. ডিজরেস্পেক্ট নামে পরিচিত। কয়েক মাস আগে তিনি ২০১৭ সালে এক নাবালককে বার্তা পাঠানোর অভিযোগের দায় স্বীকার করেন।

তবে জোর দিয়ে বলেন, “অবৈধ কিছুই ঘটেনি, কোনও ছবি শেয়ার করা হয়নি, কোনও অপরাধ সংঘটিত হয়নি”।

এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি পোস্ট করার পর দুই মাস তিনি অফলাইনে ছিলেন।

অন্যান্য জনপ্রিয় স্ট্রীমারদের সমালোচনা সত্ত্বেও এই মাসের শুরুতে তার কামব্যাক লাইভস্ট্রিম ৩০ লাখেরও বেশি ভিউ আকর্ষণ করেছে।

স্ট্রিমস চার্ট অনুযায়ী, ডক্টর ডিজরেসপেক্ট এই বছর যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় সর্বাধিক দেখা স্ট্রীমার ছিলেন।

গ্রাহকরা ইউটিউবারদের দ্রুতই ক্ষমা করে দেয়।

মিস্টার বিস্টের ভাগ্যে কী আছে

মিস্টার বিস্টের ভক্ত সংখ্যা ক্রমাগত বাড়লেও এবার যে গুরুতর বিতর্কে তিনি পড়েছেন, তার পরবর্তী পদক্ষেপই দীর্ঘমেয়াদে তার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ধারণ করে দেবে।

স্যাভি মার্কেটিং-এর প্রধান কৌশল কর্মকর্তা জেমস লুন বলেছেন, ইউটিউব তারকা মিস্টার বিস্ট অনেক শিল্পে বিস্তৃত ‘বহুমুখী’ ব্র্যান্ড নিয়ে ‘অবিশ্বাস্যভাবে অনন্য অবস্থানে’ রয়েছেন।

তিনি বলেন, “আমরা প্রকৃতপক্ষে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। সক্রিয় পদ্ধতি, সমস্যাগুলোকে স্বচ্ছভাবে মোকাবেলা করা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে তিনি তার ব্র্যান্ডকে রক্ষা করতে পারবেন।”

ব্র্যান্ড বিশেষজ্ঞ ক্যাথরিন শাটলওয়ার্থ বলেছেন, মিস্টার বিস্টের যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, তাতে তিনি হয়তো অনেক সুবিধা পাবেন। কিন্তু সর্বশেষ মামলাটি মোকাবেলা করা কঠিন হতে পারে।

“ফিস্টেবল চকোলেট বার বা লাঞ্চলির মতো পরিবার ও শিশুদের জন্য তার ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

“কারণ ক্রয় ক্ষমতাসম্পন্ন অভিভাবকরা নিরাপত্তা, ন্যায্যতা এবং নৈতিকতার সঙ্গে জড়িত বিতর্কের প্রতি কম সহনশীল হন।”

২০২৩ সালের আগস্টে মিস্টার বিস্টের গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানের অর্ধেক ছিল। তার মানে মাত্র একবছরে তার গ্রাহক সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তার খ্যাতি বেড়ে যাওয়ায় তিনি এখন অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ইন্টারনেট দুনিয়া অধীর আগ্রহে তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে, যারা এখন পর্যন্ত একটি জটিল গল্পের শুধু একদিক সম্পর্কে জেনেছেন।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত