এই প্রথম নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট সময় জানালেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিকে কিংবা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে।
দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি তোলার প্রেক্ষাপটে সোমবার বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস নির্বাচনের সময়ের কথা জানান।
বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই বছরের ৭ জানুয়ারি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকলেও গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাদের পতন ঘটে।
এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে জোর দিলেও নির্বাচনের কোনও সময় জানানো হচ্ছিল না। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল আবার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছিল।
এই প্রেক্ষাপটে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, “মোটা দাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”
কোন অবস্থায় ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা যায়, তা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি সকল প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি।
“তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি ‘যদি’ অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়ত সম্ভব হবে।”
আবার তা পিছিয়ে যেতে পারে কীভাবে- তাও তুলে ধরে তিনি বলেন, “আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন হয়েছে। সংবিধান অনুসারে তাদেরই নির্বাচনের দিন-তারিখ ঘোষণা করার কথা।
ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, “সবকিছুই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এর সঙ্গে যদি আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে চাই, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিস্তৃতি ও গভীরতা অনুসারে নির্বাচন কমিশনকে সময় দিতে হবে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। নির্বাচন সংস্কারে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে একটি কমিশন কাজও করছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি বাস্তবায়নে প্রতিটি কমিশনই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের কথা আমি একটু আলাদাভাবে বলতে চাই, কেননা এই দুটি কমিশনের সুপারিশের ওপর প্রধানত নির্ভর করছে আমাদের আগামী নির্বাচন প্রস্তুতি ও তারিখ।”
পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের হাতে অনেক কাজ। সবচেয়ে বড় কাজ ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। এটা এমনিতেই কঠিন কাজ। এখন কাজটা আরও কঠিন হলো এজন্য যে গত তিনটা নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না।
গত ১৫ বছরে যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হয়েছে, তাদের সবার নাম ভোটার তালিকায় তোলা নিশ্চিত করতে হবে, বলেন তিনি।
“এটা একটা বড় কাজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখানে গলদ রাখার কোনও সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন পর এবার বহু তরুণ-তরুণী জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেবে। অতীতে তাদেরকে সে অধিকার এবং আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। তাই এবারের নির্বাচনে তাদের ভোটদান একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। এই অভিজ্ঞতাকে মসৃণ করার সমস্ত আয়োজন করতে হবে।”
আওয়ামী লীগের শাসনকালে ভোটের প্রতি যে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছিল মানুষের মনে, তার বিপরীতে আগামীতে সবাইকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, “এখন থেকে সবাই মিলে এমন একটা ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পারি যে স্থানীয় নির্বাচনসহ সকল নির্বাচনে সকল কেন্দ্রে প্রথমবারের ভোটাররা ১০০ শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোটদান নিশ্চিত করবে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে ভবিষ্যতে কোনও সরকার মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেবার সাহস করতে পারবে না।
“আমার একান্ত ইচ্ছা এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের তরুণ-তরুণী ভোটারা শতকরা ১০০ ভাগের কাছাকাছি সংখ্যায় ভোট দিয়ে একটি ঐতিহ্য সৃষ্টি করুক। নির্বাচন কমিশন এবং সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার আহ্বান সবাই মিলে আমরা যেন এই লক্ষ্য অর্জনে নানা প্রকার সৃজনশীল কর্মসূচি গ্রহণ করি।”
নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি যাচাই করে ভুয়া ভোটার বাদ দেওয়ার ওপরও জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা। পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন ভোট দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা করার কথাও বলেন তিনি।