Beta
রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪

কমলা হ্যারিস জয়ী হলে ইউনূস সরকার ইতিবাচক সুবিধা নিতে পারবে

এম হুমায়ুন কবির

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, রিপাবলিকানরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসুক বা ডেমোক্র্যাটরাই আসুক ড. ইউনূস সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পাল্টাবে না। তবে, ডেমোক্র্যাটরা জয়ী হলে ড. ইউনূসের সরকার ইতিবাচক সুবিধা আদায় করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি, কাজ করেছেন জাতিসংঘে। এখন তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট। কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবিরের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

কমলা হ্যারিস জয়ী হলে ইউনূস সরকার ইতিবাচক সুবিধা নিতে পারবে

এম হুমায়ুন কবির

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, রিপাবলিকানরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসুক বা ডেমোক্র্যাটরাই আসুক ড. ইউনূস সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পাল্টাবে না। তবে, ডেমোক্র্যাটরা জয়ী হলে ড. ইউনূসের সরকার ইতিবাচক সুবিধা আদায় করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি, কাজ করেছেন জাতিসংঘে। এখন তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট। কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবিরের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন

সকাল সন্ধ্যা: সম্প্রতি দেশের একটি সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে, ‘মার্কিন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে হাসিনা’। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট শিবির জয় পেলে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হবে না। অন্যদিকে রিপাবলিকান শিবির বিজয়ী হলে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন অবস্থানের হেরফের হতে পারে, যা থেকে হয়ত আওয়ামী লীগও সুবিধা পেতে পারে। অবশ্য কূটনীতিকদের কেউ কেউ মনে করেন নির্বাচনের ফল যা-ই হোক বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পাল্টাবে না। আপনার কী মনে হয়?

এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে যে পক্ষই জিতুক— ডেমোক্র্যাট দলের কমলা হ্যারিসই জয়ী হোন কিংবা রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্পই জয়ী হোন— সে কারণে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থানের খুব একটা হেরফের হবে বলে আমার মনে হয় না। এর কয়েকটা কারণ বলি। প্রথমত, মোটা দাগে হলেও পরররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মোটামুটি একটা সহমত আছেই। যদিও অনেকে বলছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, মূলত ভূ-রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষেত্রেই হয়ত সেইসব পরিবর্তনগুলোর প্রভাব দেখা যেতে পারে। যেমন ধরুন— ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ও ব্যবসা-বাণিজ্য এগুলো নিয়ে হয়ত কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে পারে, যদি ট্রাম্প জিতে আসতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে পর্যায়ের সে পর্যায়ে, যে-ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের কথা বললাম তেমন কোনও প্রভাব দেখা যাবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের বিষয়ে সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে— যেমন মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো প্রসঙ্গ— এই বিষয়গুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে-ই জিতুক না কেন তাতে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে তেমন কিছু আসে যায় না।

দ্বিতীয়ত, দৃষ্টান্ত হিসেবেও যদি আমরা দেখি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রিপাবলিকান পার্টিই হোক কিংবা ডেমোক্র্যাট, একই ধরনের পররাষ্ট্র নীতিই যুক্তরাষ্ট্র অনুসরণ করে থাকে। একটা উদাহরণ দিই— বাংলাদেশে র‌্যাবের ওপর যে স্যাংশনটা যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে, এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার আগের বছর ২০২০ সালের অক্টোবরে, সেটা মার্কিন কংগ্রেস হয়ে সিনেট হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে তাদের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে এসেছিল। এখানে লক্ষ্য করা দরকার, এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের সময়ে এবং বিষয়টা কার্যকর করা হলো পরবর্তী সময়ে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের সরকারের আমলে। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশের বিষয়ে সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে— যেমন মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো প্রসঙ্গ— এই বিষয়গুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে-ই জিতুক না কেন তাতে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে তেমন কিছু আসে যায় না।

সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেমন নোবেল লরিয়েট হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বে সুপরিচিত তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট শিবিরের রাজনীতিকদের সঙ্গে তার সখ্যও সুবিদিত। এমনকি জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার পতনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও নেপথ্য ভূমিকা আছে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বরাবরই এমন অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এই দিক থেকে চিন্তা করলে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটদের বিজয়ে ছাত্র-গণ-অভুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত ড. ইউনূসের সরকার আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করেন কি?   

এম হুমায়ুন কবির: এই প্রশ্নটির উত্তর আমি দুই ভাগে দিচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রে আমার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা এবং সেখানে থেকে কাজের সুযোগে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান দুই শিবিরের রাজনীতিকদের কাছেই সুপরিচিত মানুষ এবং সবাই-ই তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করেন। কাজেই, প্রথম কথা হলো, রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আসুক বা ডেমোক্র্যাট পার্টিই আসুক সে কারণে ড. ইউনূস সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা পাল্টাবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয় কথা হলো, যদি ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয় সেটা কি বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে কি না? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ অবশ্যই, কারণ তাতে একটা ধারাবাহিকতা থাকবে। ড. ইউনূসকে যেমন তাঁরা চেনেন-জানেন তেমনি তিনি ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছেন, সেখানে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে তিনি বৈঠক করে এসেছেন। এছাড়াও বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আইএমএফ-এর মহাপরিচালকের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। এই অবস্থায় আসন্ন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস যদি জয়ী হোন তাহলে ড. ইউনূসের সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এখন যে সমন্বয়টা আছে সেটার ধারাবাহিকতা থাকবে এবং সেটা থেকে বাংলাদেশ ইতিবাচক সুবিধা নিতে পারবে।

তবে, মনে রাখতে হবে এই সুবিধা নেওয়ার বিষয়টা কেবল আমাদের প্রত্যাশা দিয়ে হবে না সেজন্য আমাদের কাজ করে দেখাতে হবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা সংস্কারকে সমর্থন করছে, বাংলাদেশে একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করছে, তাঁরা বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়, একইভাবে এখানে মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দেখতে চায়। এখন আমরা যদি এসব ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করে দেখাতে পারি, সত্যিকার অগ্রগতি দেখাতে পারি তাহলে আমরা বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আরেকটু ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারব এবং আমাদের প্রত্যাশিত সহযোগিতা আদায় করতে পারব।       

সকাল সন্ধ্যা: এবারের মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশী ভারতের বিশেষ নজর রয়েছে। কোনও কোনও বিশ্লেষক বলছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনিরা এই নির্বাচনে একটি প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। আপনার বিশ্লেষণ কী?

এম হুমায়ুন কবির: এখানে দুটো বিষয়ই ঘটতে পারে। একটা হলো, আপনি যেমনটা বলছেন যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনিদের মধ্যে একটা বিশেষ উদ্দীপনা দেখা যেতে পারে, কেননা তিনি নির্বাচিত হলে এটা ভারতীয়দের জন্য একটা গর্বের ব্যাপার হবে। আবার একটু পেছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রে ‘হাউডি মোদি’ নামে একটা বিশাল অনুষ্ঠান করেছিলেন। ওই আয়োজনের বাইরেও এটা মনে রাখতে হবে যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনিদের একটা বিশাল অংশ রিপাবলিকানদের সমর্থন করে এবং সেই সংখ্যাটি একেবারে কম নয়। এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা খুব বড় কোনও জনগোষ্ঠী নয়। আবার ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ভোটও ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দুই শিবিরে বিভাজিত হতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণাও সেইরকম। কাজেই একটা এথনিক গ্রুপ হিসেবে ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে একাট্টা হয়ে ভোট দেবে এমনটা আমাদের কাছে এখনও প্রতীয়মান হচ্ছে না।

সকাল সন্ধ্যা: এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফল কি ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ওপর কোনও প্রভাব ফেলবে? এ প্রসঙ্গে আপনার মূল্যায়ন কী? 

এম হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন তাতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কোনও হেরফের হবে বলে মনে হয় না। খেয়াল করলে দেখবেন, ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দুই দেশের ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক ক্রমাগত বর্ধিত হয়েছে। আমার ধারণা যুক্তরাষ্ট্র-ভারত এই সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।  

সকাল সন্ধ্যা: অভিবাবসন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অনেকদিন ধরেই একটা আলোচিত বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসী গ্রুপগেুলোর ওপর এই নির্বাচনের প্রভাব কেমন হতে পারে বলে মনে করেন? যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে এনআরবি বা নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশিদের মনোভাব সম্পর্কে আপনার কিছু জানা আছে কি? অতীতের পর্যবেক্ষণ থেকে কি কোনও ধারণা পাওয়া যেতে পারে যে, বাংলাদেশি বা অন্যান্য অভিবাসীদের জন্য ডেমোক্র্যাট সরকার বা রিপাবলিকান সরকার কারা বেশি সহায়ক ভূমিকায় থাকতে পারে?  

এম হুমায়ুন কবির: এবারের নির্বাচনে ভোটারদের কাছে প্রধান বা মুখ্য বিষয় হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতি আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে অভিবাসন। এটা ঠিক যে অভিবাসন প্রশ্নটি এখন যুক্তরাষ্ট্রে খুবই আলোচিত হচ্ছে। অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যে অভিবাসন প্রশ্নের ওপরই নির্ভর করবে কে বা কারা জিতবেন। বিশেষত, যে সাতটি ‘সুইং স্টেট’-এর কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে নেভাডা, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা ও মিশিগান— এই চারটি রাজ্যে ইমিগ্রান্টরা বা অভিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক। যার ফলে এই অভিবাসী জনগোষ্ঠীর ভোটের ওপরই এসব রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল অনেকাংশে নির্ভর করবে এবার।

এখন আমাদের অভিবাসী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর কথা যদি বলি, তারাও মার্কিন নির্বাচনে এই অভিবাসন প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু তাদের সংখ্যা আসলে উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। যদি ট্রাম্প জেতেন তাহলে তাদের অনেকে হয়ত মুশকিলে পড়বেন। কেননা, এ বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান খুবই স্পষ্ট— যে অভিবাসীরা এখনও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের বৈধতা পাননি বা যারা এখনও নিয়মিতকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে পারেননি তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বদ্ধপরিকর। সেক্ষেত্রে আমাদের যে অভিবাসী বাংলাদেশিরা এখনও এমন প্রক্রিয়ায় ঢুকতে পারেননি তাদের জন্যও আশঙ্কার বিষয় আছে।

অভিবাসন প্রশ্নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— ‘চেইন মাইগ্রেশন’। কেউ একজন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পেলে বা ‘গ্রিন কার্ড’ পেলে তিনি পরবর্তকালে তার বাবা-মা, ভাই-বোন বা অন্য আত্মীয়দের সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। এই যে প্রক্রিয়া এটাকেই ‘চেইন মাইগ্রেশন’ বলা হয়ে থাকে। গত দফায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চেইন মাইগ্রেশনের প্রক্রিয়া বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। আমার ধারণা এবার নির্বাচিত হলে ট্রাম্প প্রশাসন হয়ত সেটা বন্ধ করে দিতে পারেন। আবার ‘এইচ-ওয়ান-বি’ ভিসায় গিয়ে যারা কাজ করছেন, বাংলাদেশি অনেক ভাই-বোনেরাও এমন স্ট্যাটাসে আছেন, নির্বাচিত হলে ট্রাম্প সেগুলোও বন্ধ করে দিতে পারেন। অর্থাৎ রিপাবলিকানদের অভিবাসন নীতিতে অন্যান্যদের মতো বাংলাদেশি অভিবাসীরাও সংকটে পড়বেন। আবার যদি ডেমোক্র্যাটরা জয়ী হোন তাহলে তারা হয়ত এখন মার্কিন কংগেসে ঝুলে থাকা আইনটি পাশ করার চেষ্টা করতে পারেন, ইমিগ্রেশনের পদ্ধতির উন্নতির চেষ্টা করতে পারেন, সেক্ষেত্রে অভিবাসীরা ইতিবাচক সুবিধা পেতে পারেন।

আমার ধারণা এবার নির্বাচিত হলে ট্রাম্প প্রশাসন হয়ত সেটা বন্ধ করে দিতে পারেন। আবার ‘এইচ-ওয়ান-বি’ ভিসায় গিয়ে যারা কাজ করছেন, বাংলাদেশি অনেক ভাই-বোনেরাও এমন স্ট্যাটাসে আছেন, নির্বাচিত হলে ট্রাম্প সেগুলোও বন্ধ করে দিতে পারেন। অর্থাৎ রিপাবলিকানদের অভিবাসন নীতিতে অন্যান্যদের মতো বাংলাদেশি অভিবাসীরাও সংকটে পড়বেন।

আরেকটি কারণেও এবারের মার্কিন নির্বাচন আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর অনেক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী যুক্তরাষ্ট্রে যান পড়ালেখা করার জন্য। গতবছরও এই সংখ্যাটা ছিল প্রায় ১৩ হাজারের মতো। ট্রাম্প বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ছাত্রছাত্রীদের যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করার যে সুযোগ-সুবিধা এখন বিদ্যমান আছে সেটারও একটা পুনর্মূল্যায়ন হতে পারে। কাজেই বাংলাদেশি অভিবাসী এবং উচ্চশিক্ষার্থে সেখানে যেতে চাওয়া বাংলাদেশি উভয়ের জন্যই এবারের মার্কিন নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সকাল সন্ধ্যা: এবার আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গে আসি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে বলে দৃশ্যমান। অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে মন্তব্য, দেশের পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা এবং দুর্গাপূজা ঘিরে ইলিশ-কূটনীতি সহ নানা ঘটনায় আমরা সেসবের আঁচ দেখতে পেয়েছি। অন্যদিকে, শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার পর হাসিনা-উত্তর বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম এবং সেখানকার রাজনৈতিক মহলের নানা কথাবার্তাতেও বাংলাদেশ নিয়ে অনেক নেতিবাচক মন্তব্য দেখা গেছে।

এম হুমায়ুন কবির: ভারতেরসঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে যে কথাবার্তা হচ্ছে সেটা দুই দিক থেকেই হচ্ছে। বাংলাদেশে যেমন ভারত-বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে তেমনি ভারতেও বাংলাদেশ-বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে। গত ১৫ বছর ভারত যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে, সেটাকে বাংলাদেশের মানুষ ইতিবাচকভাবে নেয়নি এবং নেয়নি বলেই তারা একটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করেছে। এখন ভারতের জন্য যেটা সমস্যা হচ্ছে যে, এই উৎখাত প্রক্রিয়াটা নিয়ে ভারতের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। ভারত এটা হয়ত আন্দাজ করতে পারেনি, বুঝতে পারেনি, অথবা তারা এতে হচকিত হয়েছে যে— এটা কিভাবে সম্ভব!

সে যা-ই হোক, ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক পরিবর্তনটার গুরুত্ব এবং এর চরিত্র বোঝার ব্যাপারে ভারতের খানিকটা বিভ্রান্তি এখনও আছে বলেই আমার মনে হয়। ফলে ভারতের নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য আমরা দেখছি। যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ বিগত তিন-তিনটা নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছে তাই তারা বিগত সরকারের সঙ্গে গত ১৫ বছর ভারতের ভূমিকাকে সংশ্লিষ্ট করে দেখেছে তাই এখানে ভারত-বিরোধিতা এতটা দৃশ্যমান হয়েছে।

এখন যেভাবে চারদিকে ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে, সেগুলোর অনেক কিছুই সামাল দেওয়ার জন্যই হয়ত আমাদের একে অপরকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। কাজেই সেই বিষয়গুলোও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমার ধারণা এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে কাজ করতে থাকলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে শীতলতাটুকু তৈরি হয়েছে সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

আমি যেটা মনে করি যে, যেহেতু ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই আমরা দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পরষ্পরের সংশ্লিষ্ট, দুই দেশই আমরা পারষ্পরিকভাবে বহুমাত্রিকভাবে নির্ভরশীল, সেহেতু নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আরও বেশি যুক্তিসঙ্গতভাবে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে হবে উপলব্ধি করতে হবে। পারষ্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের ওপর জোর দিয়ে একটা কাজের সম্পর্কের ভিত্তিতে একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে এবং পারষ্পরিক মর্যাদা রক্ষা করে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে— যেটা ড. ইউনূস বলেছেন। তা না হয়ে দ্বিপক্ষিক সম্পর্কটা যদি ভাবাবেগতাড়িত হয় সেটা আমাদের কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না। কেননা, এখন যেভাবে চারদিকে ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে, সেগুলোর অনেক কিছুই সামাল দেওয়ার জন্যই হয়ত আমাদের একে অপরকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। কাজেই সেই বিষয়গুলোও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমার ধারণা এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে কাজ করতে থাকলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে শীতলতাটুকু তৈরি হয়েছে সেটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।      

সকাল সন্ধ্যা: শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগে থেকেই আমাদের ভূ-রাজনীতিতে রোহিঙ্গা-সংকটসহ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা টানাপোড়েন চলছিল। সম্প্রতি আমরা এই অঞ্চলে মিয়ানমার-রাশিয়া যৌথ নৌ-মহড়াও দেখলাম। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে আশ্রয় দিয়ে রাখা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ এখনও কোনও অগ্রগতির দেখা পায়নি। এ বিষয়ে অন্তবর্তী সরকারের নতুন কোনও প্রচেষ্টা কিংবা কূটনৈতিক পর্যায়ে কোনও অগ্রগতির কথা আপনার জানা আছে কি? রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের কী করণীয়?    

এম হুমায়ুন কবির: এখানে দুটো বিষয় আছে। একটা হলো, রাশিয়ার সাথে এখন মিয়ানমারের যে যৌথ নৌ-মহড়া এটা একেবারেই তাদের দ্বিপাক্ষিক বিষয়। তারা আগেও করেছে। আর রাশিয়া ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবেই আছে। রাশিয়া ও মিয়ানমার তাদের এই সম্পর্ককে আরেকটু সম্প্রসারিত করে আন্দামান অঞ্চলসহ বঙোপসাগরে বর্ধিত করতে চাচ্ছে।

আর, দ্বিতীয় যে বিষয়টি বললেন সেটা রোহিঙ্গা সংকট। এ বিষয়ে আমার নিজস্ব উপলব্ধির কথা বলতে পারি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বিগত সরকারও সচেষ্ট ছিল। দুই বার তো উদ্যোগ নেওয়াই হয়েছে। কিন্তু সীমান্তে সব আয়োজন করার পরও প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। যেহেতু, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। সে কারণে রোহিঙ্গারা তখন যাননি। সেখান অবস্থার কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন এখনও হয়নি। বরং এখন সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছে আরাকান আর্মি আর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে। সেক্ষেত্রে রাখাইন প্রদেশে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। এখন অন্তবর্তী সরকারও হয়ত উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ যে খুব স্বল্প সময়ে ফলপ্রসু হবে এমন কোনও বাস্তবতা নেই। তাই আমি মনে করি, যে-ই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, মিয়ানমারে কী ঘটছে সেটার দিকে যেমন নজর রাখতে হবে তেমনি আমাদের যেটা প্রায়োরিটি যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে হবে সেই প্রচেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে, মনোযোগ ধরে রেখেই সেটা অব্যাহত রাখতে হবে।          

সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এম হুমায়ুন কবির: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত