ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের সমস্যাটি ঝুলিয়ে না রেখে সমাধান করে ফেলার পক্ষপাতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তার মতে, বছরের পর বছর এই বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখায় প্রতিবেশী দুই দেশের কারোরই কোনও উপকার হচ্ছে না।
সার্ক কার্যকর হলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দ্রুত সম্ভব বলেও মনে করেন নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি, বিশেষ পরিস্থিতিতে যিনি এখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন।
ঢাকায় থেকে ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নদীর পানি বণ্টন ও সার্ক নিয়ে কথা বলেন ড. ইউনূস। পিটিআইর বরাতে শুক্রবার তা ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. ইউনূস।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির উদ্যোগ নিলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা আলোর মুখ দেখেনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছিল। তবে প্রাপ্যতা অনুসারে বাংলাদেশ পানি পায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদী রয়েছে ৫৪টি; ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেেশর যেমন প্রাপ্য পানি না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে, তেমনি পানি প্রবাহের তথ্য না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা নিয়েও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল ওঠে।
এই প্রেক্ষাপটে পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য দূর করতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে তার সরকার।
“আলোচনায় বসেই এই সমস্যার সমাধান করা যায়। আমি যদি জানি কতটা পানি আমি পাব, তাতে আমি খুশি না হলেও যদি চুক্তি স্বাক্ষর করি, তাও ভালো। বিষয়টির সমাধান দরকার।”
ড. ইউনূস এই প্রসঙ্গে বলেন, অবশ্যই আন্তর্জাতিক রীতি মেনে দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের সুরাহা হওয়া দরকার। বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশের যে সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে, তাও বজায় রাখা উচিৎ।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার কোনও চাপ তৈরি করবে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “চাপ অনেক বড় শব্দ। আমি সেটা বলছি না। আমরা আলোচনা করব। কিন্তু আমাদের একসঙ্গে বসা উচিৎ এবং এই সমস্যার সমাধান করা উচিৎ।”
১৯৮৩ সালে একটি স্বল্প মেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি ঝুলে আছে প্রায় দেড় দশক ধরে।
২০১১ সালে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তির সব ঠিকঠাক ছিল। শেষ মুহূর্তে বাধা হয়ে দাঁড়ান মমতা। তিনি যুক্তি দেখান, পশ্চিমবঙ্গই যথেষ্ট পানি পাচ্ছে না।
এরপর বিজেপি সরকারে এলে ভারত-বাংলাদেশ প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেই আলোচনা ওঠে তিস্তা নিয়ে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকার আশ্বাস দিয়ে গেলেও মমতাকে মানানো যায়নি বলে চুক্তিও হয়নি।
ড. ইউনূস বলেন, “এটা নতুন কোনও বিষয় নয়, পুরনো বিষয়। অনেক বার আমরা এনিয়ে কথা বলেছি। পাকিস্তান শাসনামলেই এ আলোচনা শুরু হয়েছে।
“আমরা সবাই চেয়েছি বিষয়টি চূড়ান্ত হোক। এমনকি ভারত সরকারও সেজন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সরকার রাজি হলো না। এখন এসব সমাধান করা উচিৎ।”
সাম্প্রতিক বন্যা নিয়ে ড. ইউনূসের সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, “প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে যদি চুক্তি নাও থাকে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানের দেশ হিসেবে ভারতের পানি ছাড়ার আগে আমাদেরকে জানানোর কথা। কিন্তু এবার তা প্রতিপালিত হয়নি।”
পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সে বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, “ভারতের হাইকমিশনার আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমি বলেছি, বন্যার সময়ে কীভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে বিষয়ে আমরা একত্রে কাজ করতে পারি। এমন পরিস্থিতিতে কোনও চুক্তির দরকার নেই।
“মানবিক ভিত্তিতে একত্রে কাজ করে আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারি। এতে জনদুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব হবে। সত্যি বলতে এমন মানবিক পদক্ষেপই সাহায্য করবে।”
সাক্ষাৎকারে সীমান্ত হত্যারও নিন্দা জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, হত্যা করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বহু দিন ধরেই বাংলাদেশ-ভারতের আলোচনার বিষয় হয়ে আছে। ভারতের পক্ষ থেকে সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার আশ্বাস থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
১৯৮৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গঠিত হলেও এর অকার্যকর হয়ে থাকা নিয়ে কথা বলেন ড. ইউনূস।
তিনি বলেন, বড় আশা নিয়ে সার্ক গঠন হয়েছিল, কিন্তু এটা এখন কাগুজে জোটে পরিণত হয়েছে। অথচ সার্ক কার্যকর থাকলে আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান সহজ হতো।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল ও ভুটানকে নিয়ে ১৯৮৫ সালে সার্কের যাত্রা শুরু হলেও পরে আফগানিস্তান এতে যোগ দেয়।