অর্থ আত্মসাতের মামলায় অভিযোগ গঠনকে বর্তমান সরকার আমলে ‘ক্রমাগত হয়রানি’র ধারাবাহিকতা হিসাবে দেখছেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার ঢাকার আদালতে এই মামলায় অভিযোগ গঠনের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এটা হয়রানি। আমার বোধের মধ্যে আসছে না, কেন এই হয়রানি? প্রতি বছর নতুন নতুন কাহিনী রচনা হচ্ছে।”
এক যুগ আগে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের সময় থেকে আওয়ামী লীগ সরকার তার পেছনে লেগে আছে বলে ইউনূসের অভিযোগ।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় অভিযোগ গঠনের ঠিক আগে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ এখন একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মামলায় ছয় মাসের সাজার রায়ের ছয় মাস পর বুধবার গ্রামীণ টেলিকমের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় ইউনূসের বিচার শুরুর আদেশ দেয় আদালত। দোষ প্রমাণিত হলে এই মামলায় তার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
অভিযোগ গঠনের সময় আদালতে হাজির ছিলেন ইউনূস; নিজেকে নির্দোষ দাবি করে মামলা েথকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন তিনি, তবে বিচারক তা আমলে নেননি।
বরাবরের মতো গ্রামীণ চেকের ফতুয়া পরা ইউনূস এরপর আইনজীবীদের সঙ্গে এজলাস থেকে বেরিয়ে এসে শুরুতেই তাকে কাঠগড়ায় রাখা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তিনি বলেন, “একটা সভ্য দেশে কেন এমন হতে হবে? কেন একজন নাগরিককে খাঁচার মধ্যে পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যেখানে বিচার এখনও শুরুই হয়নি।”
দুদকের এই মামলায় ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে স্থানান্তর ও হস্তান্তরের অভিযোগ আনা হয়েছে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ইউনূসসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে তারা অপরাধ করেছেন বলে দুদকের দাবি।
অর্থ পাচারের অভিযোগ নিয়ে ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, “মানি লন্ডারিং, আত্মসাৎ, প্রতারণা, এগুলো তো আমি শিখি নাই; প্রকাণ্ড রকম শব্দগুলো আমার উপর আরোপ করা হচ্ছে।
“অর্থ আত্মসাৎ করতে তো আমরা আসি নাই। বরং নিজেদের অর্থ ব্যয় করে এসেছি। এটাই আমাদের ইতিহাস।”
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওরার পর বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে ২০১১ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে সরানো হয়। তখন আদালতে গিয়েও পক্ষে আদেশ পাননি তিনি।
তখন থেকেই হয়রানির মধ্যে আছেন বলে বুধবারও অভিযোগ করেন নোবেলজয়ী এই বাংলাদেশি।
তিনি বলেন, “প্রতি বছর নতুন নতুন কাহিনী রচনা হচ্ছে, বহু রকম। একটি হলো আমি রক্তচোষা, একটা হলো আমি সুদখোর, একটা হলো আমি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছি …
“এটা হলো হয়রানি। বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। এটা শুধু আজকের হয়রানি না, এটা ক্রমাগতভাবে চলছে। আমার বোধের মধ্যে আসছে না, কেন এই হয়রানি?”
এমন অভিযোগ ইউনূস আগেও করেছিলেন। তা প্রত্যাখ্যান করে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আদালতের ওপর সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ নেই।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় রায়ে বিচারক বলেছিলেন, “মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ইউনূসের অপরাধের বিচার হয়েছে, নোবেলজয়ী হিসেবে নয়।”
বাংলাদেশ ‘একদলীয়’ শাসনে
রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতিকে শেষ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ‘একদলীয়’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
দুদকের মামলার অভিযোগ গঠনের আগের দিন মঙ্গলবার এই সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। সেখানে ইউনূসকে বিশ্বজুড়ে ‘ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের প্রবক্তা’ হিসাবে তুলে ধরে বলা হয়, সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালে ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রুষ্ট করেছিল।
৮৩ বছর বয়সী ইউনূস সাক্ষাৎকারে বলেন, “বাংলাদেশে আর কোনও রাজনীতি অবশিষ্ট নেই। এখানে কেবল একটি দলই সক্রিয় এবং সবকিছু তাদেরই দখলে, তারাই সবকিছু করে, তাদের নিজের মতো নির্বাচন করে।
“তারা তাদের লোকদের বিভিন্ন উপায়ে নির্বাচিত করে- প্রকৃত প্রার্থী, ডামি প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী- সবাই কিন্তু একই দলের।”
‘একজন নাগরিকের পক্ষে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করা কি অপরাধ’- এই প্রশ্ন তুলে সাক্ষাৎকারে ইউনূস রয়টার্সকে বলেন, তবে রাজনীতির জন্য নিজেকে উপযুক্ত মনে না হওয়ায় মাত্র ১০ সপ্তাহের পর তিনি এ ধরনের রাজনৈতিক দল গঠনের ধারণা বাদ দিয়েছিলেন।
বর্তমান বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশ পুনরুজ্জীবিত করা কঠিন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইউনূসের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রয়টার্স। তিনি ড. ইউনূসের মন্তব্যকে দেশের মানুষের জন্য ‘অপমানজনক’ মন্তব্য করে বলেন, “বাংলাদেশে গণতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে কার্যকর রয়েছে।”
ইউনূসের কথা দেশের মানুষও একমত নয় বলে দাবি করেন আনিসুল হক।